১০ মে ২০২৩, বুধবার, ৫:৪৩

বন্ধের শঙ্কায় পায়রা

দেশে ‘শতভাগ বিদ্যুৎ’ তকমা কেতাবেই রয়ে যাচ্ছে। গ্রাহক পযায়ে গত ১৪ বছরে ১১ দফা দাম বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। তবুও লোডশোডিং থামছে না। বেশি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনেও শিল্প প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ গ্রাহকদের ভোগান্তি নিয়তি হয়ে গেছে। মে মাসের প্রচ- তাপদাহের মধ্যেও লোডশেডিংয়ের নামে এখনো ৫ থেকে ৬ ঘন্টা মানুষকে অন্ধকারে থাকতে হচ্ছে। দায়িত্বশীলদের বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর পরিকল্পনার অভাব এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়ায় একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ডলার সংকটে যথাসময়ে কয়লা আমদানী করতে না পারায় রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুই সাপ্তাহ ধরে বন্ধ। এখন পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রও বন্ধের উপক্রম হয়েছে।

জানতে চাইলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা (কেন্দ্র ব্যবস্থাপক) শাহ্ আবদুল মওলা বলেন, গত তিন বছরে এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। টাকা পরিশোধ করে কয়লা কিনতে হয়। এরপরও ডলারের সংকট থাকায় ৬ মাস পর পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা-ও এখন বিল দেওয়া যাচ্ছে না। মজুত কয়লা দিয়ে এ মাস হয়তো কোনোরকমে চালানো যাবে। এর মধ্যে ডলার না পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।

দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগেরই জ্বালানি হচ্ছে গ্যাস, কয়লা ও তেল। শিল্পে ব্যবহৃত ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোও পরিচালনা করা হয় গ্যাস ও তেল দিয়ে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ও তেল অপরিহার্য কাঁচামাল। গ্যাসের বড় অংশ দেশ থেকে জোগান দেওয়া হয়। কিছু আমদানি করা হয়। কিন্তু জ্বালানি তেলের পুরোটাই চলছে আমদানির মাধ্যমে। এসব আমদানির এলসি খুলতে প্রয়োজন হয় ডলার। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে গত কয়েক মাস ধরে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের কয়লাভিত্তিক বড় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন নিয়ে আবারও টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। সময়মতো ডলার না পাওয়ায় কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ডলার না পেলে উৎপাদন বন্ধ হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রায়ও বন্ধের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কয়লার অভাবে দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ হয়ে রয়েছে। এ কারণে সারাদেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। গত কয়েকদিন থেকে ঢাকা ছাড়া সকল জেলায় ৪-৫ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকছে না বলে জানা গেছে। বর্তমান সরকারে আমলে ১৪ বছরে গ্রাহক পর্যায়ে ১১ দফা দাম বাড়ানো হয়েছে। তবুও লোডশোডিং থামছে না।

ডলার সংকটে চরম বিপর্যয়ের মুখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি আমদানি। ফলে গ্যাস, কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। পটুয়াখালীর কয়লাভিত্তিক পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। দিনে গড়ে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে কেন্দ্রটি। বিদ্যুৎ সরবরাহের দিক থেকে এটি দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসি) এটি নির্মাণ করে। ডলার-সংকটের কারণে কয়লা আমদানি নিয়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো একই সমস্যায় পড়েছে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। দীর্ঘদিন ধরে কয়লার টাকা বকেয়া রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালিয়ে আসছে তারা। গত জানুয়ারিতে কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানি। এরপর মজুতকৃত কয়লা দিয়ে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রটি। এমন পরিস্থিতিতে গত ফেব্রুয়ারিতে কিছু ডলারের ব্যবস্থা করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কেন্দ্রটির উৎপাদন সচল থাকে। এখন নতুন করে বকেয়া বিলের চাপে পড়েছে কেন্দ্রটি। পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি। আর দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু করে একই বছরের ২৬ আগস্ট। পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে চুক্তি করে পিডিবি। সঞ্চালন লাইনের জটিলতায় দেড় বছর ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট বন্ধ রাখতে হয়। এরপর বিকল্প উপায়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এখন অবশ্য ঢাকাতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে কেন্দ্রটি। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট আছে। দুটি ইউনিট চালু করা হলে দিনে ১০ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন হবে।

গত ডিসেম্বরে একটি ইউনিট উৎপাদনে আসার পর এ পর্যন্ত কয়েক দফায় বন্ধ হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ মালিকানায় নির্মিত বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। গত ১৫ এপ্রিল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর চার দিন পর এটি আবার চালু হয়। কিন্তু কয়লার অভাবে ২৪ এপ্রিল থেকে এটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে আমদানি করা কয়লার জাহাজ গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামে পৌঁছার কথা রয়েছে। তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম চালানো হচ্ছে। আবার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে হঠাৎ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট চালু হলে দিনে ১০ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন হবে। বর্তমানে তাদের ৬ লাখ টন কয়লার ক্রয়াদেশ দেওয়া আছে। নতুন করে ডাকা দরপত্রে অংশ নিয়ে আরও ৬০ লাখ টন কয়লার ক্রয়াদেশ পেয়েছে দেশের একটি শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ। শুরু থেকে তারাই কয়লা সরবরাহ করছে এই কেন্দ্রে। ৬০ লাখ টন কয়লা দিয়ে আগামী তিন বছর রামপাল কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা হচ্ছে এসব কয়লা। ২০১০ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় নেওয়া হয় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প। ২০১২ সালে গঠিত হয় বিআইএফপিসিএল। ২০১৩ সালে পিডিবির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি হয় ওই কোম্পানির। ২০১৬ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরুর কথা থাকলেও সেটি হয় ২০১৭ সালে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল কেন্দ্রটির। কিন্তু বারবার শুধু সময় পিছিয়েছে। সুন্দরবনের কাছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছেন পরিবেশবাদীরা।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া পার্টনারশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাঈদ একরাম উল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, ডলার-সংকটের কারণে কয়লা আমদানি নিয়ে সমস্যা। কয়লার জাহাজ চলে আসবে। এরপর দুই দিনের মধ্যে উৎপাদন শুরু হবে। মজুত কয়লা দিয়ে এ মাস হয়তো কোনোরকমে চালানো যাবে। এর মধ্যে ডলার না পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।

চুক্তির প্রায় ১০ বছর পর গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে কেন্দ্রটি। কিন্তু কয়লার অভাবে ১৪ জানুয়ারি থেকে বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন। মূলত ডলার-সংকটে ঋণপত্র খুলতে না পারায় কয়লা আমদানি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এক মাস পর আবার উৎপাদনে ফেরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দিনে ৫ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন। এক জাহাজ কয়লা এনে এক সপ্তাহের মতো বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন সচল রাখা যায়।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, দেশে তেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম চালানো হচ্ছে। আবার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে হঠাৎ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। এখন দেশের অনেক এলাকায় প্রতিদিন গড়ে এক ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে। যেকোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর আগে পিডিবিকে জানাতে হয়। এরপর বিদ্যুৎ উৎপাদন সূচির সঙ্গে তা সমন্বয় করে পিডিবি। এদিকে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার ইনকিলাবকে বলেন, কয়েক দিনের মধ্যের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। তবে কবে থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে, তা এখনো চূড়ান্ত নয়। ডলার-সংকটের কারণে কয়লা আমদানি নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। কয়লার জাহাজ চলে আসবে মঙ্গলবার। এরপর দুই দিনের মধ্যে উৎপাদন শুরু হবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট আছে। দ্বিতীয় ইউনিট আগামী জুনে চালুর কথা রয়েছে।

জ্বালানি তেলের সংকটের কারণে ২৪ মেগাওয়াটের রিজেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট ও ১০০ মেগাওয়াটের এনার্জি প্যাক পাওয়ার প্ল্যান্টও বন্ধ রয়েছে। কাপ্তাই লেকে এবার পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এ কারণে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দে র পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে চারটিই বন্ধ। একটি ইউনিট সচল রয়েছে। এর আগে একটি ইউনিট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ ছিল। বর্তমানে ইউনিটটি সংস্কার করে সচল করা হয়েছে। তবে পানি স্বল্পতার কারণে উৎপাদন চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।

https://dailyinqilab.com/national/article/573364