৫ মে ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৩৫

বাজারে স্বস্তি মিলছে না

রাজধানীর বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে আদা-রসুনও। আলুর দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কেজিতে ৩৬ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে খোলা চিনি। ফার্মের মুরগির ডিম ডজনে পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজারে সংকট দেখা দেওয়ায় নতুন করে পেঁয়াজ, রসুন ও আদার দাম বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে আলুর দামও। আমদানিকারকরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। এ কারণে বাজারে এসব পণ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

গতকাল রাজধানীর শ্যামবাজার, কারওয়ান বাজার, রামপুরা, উত্তর বাড্ডার বাজার ঘুরে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহের তুলনায় পেঁয়াজ কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় আলু কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৩৭ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আদা ও রসুনের দাম আরো বেড়েছে। দেশি ও আমদানি রসুন কেজিতে ১০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি আদা কেজি ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা চিনির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা। সরকার খোলা চিনির সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দিয়েছে ১০৪ টাকা কেজি।
সপ্তাহের ব্যবধানে অপরিবর্তিত আছে মুরগির দাম। ব্রয়লার মুরগি কেজি ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা এবং সোনালি মুরগি কেজি ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের ডিম ডজনে পাঁচ থেকে দশ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়। সবজির দাম কিছুটা বাড়লেও চাল, ডাল, আটা, ময়দার দামে তেমন পরিবর্তন হয়নি। উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল হয়ে আছে এসব পণ্য।

রামপুরায় বাজার করতে আসা শেখ ইব্রাহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের আগে বাজার থেকে দুই কেজি পেঁয়াজ কিনেছি মাত্র ৭০ টাকা দিয়ে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানেই দুই কেজি পেঁয়াজের দাম হয়ে গেল ১১০ টাকা। বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যার কারণে ব্যবসায়ীরা নানা কারণ দেখিয়ে তাঁদের ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। এতে করে দিন দিন আমাদের ওপর চাপ বাড়ছেই।’

বাড্ডার কাঁচাবাজারে কথা হয় বীথি রানীর সঙ্গে। পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়ে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পণ্যের দাম বেড়ে পরিবারের খরচ যেভাবে বেড়েছে, আমাদের আয়-রোজগার সেভাবে বাড়েনি। এ অবস্থায় সরকারের উচিত নিত্যপণ্যের দাম যাতে স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে, সেটি নিশ্চিত করা। এমনিতেই মানুষ খুবই কষ্টে আছে, দামের এই লাগাম টানতে না পারলে মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে।’

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা জনস্বার্থে জরুরি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই মুহূর্তে বিলাসীপণ্য আমদানি বন্ধ রাখা যৌক্তিক। নিত্যপণ্য আমদানি বন্ধ রাখলে দেশের মানুষ বিপাকে পড়বে। তাই সরকারকে বিষয়টি অতি গুরুত্ব দিয়ে এখনই দেখতে হবে। আমদানির পাশাপাশি দেশে উৎপাদনেও আরো জোর দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার যে প্রবণতা চলছে, সেটার লাগামও টানতে হবে।

টিসিবির বাজারদর : ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গতকাল সরকারি ছুটির দিন থাকায় বাজারদরের তালিকা প্রকাশ করেনি। তবে বুধবারের বাজারদরের তালিকায় জানিয়েছে, রাজধানীর বাজারগুলোতে আগের সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা, এখন দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি রসুন কেজিতে ২০ থেকে ৬০ টাকা দাম বেড়ে ১৩০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি রসুন কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহে দেশি আদা কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ২২০ থেকে ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আলু কেজিতে পাঁচ থেকে দশ টাকা বেড়ে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারের মেসার্স সারোয়ার জেনারেল স্টোরের ব্যবসায়ী মো. গোলাম হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম মূলত ঈদের পর থেকে বাড়তে শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহে কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে গেছে। আলুর দামও কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। আদা ও রসুন ঈদের আগে থেকেই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে।’

আমদানিকারকদের ভাষ্য : রাজধানীর শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও আমদানিকারক মো. মাজেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পেঁয়াজ, রসুন ও আদা আমদানি করা এখন জরুরি। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এসব পণ্য আমদানি করার জন্য এলসি দিচ্ছে না। আগামী সপ্তাহের মধ্যে যদি জরুরি ভিত্তিতে আমাদের এলসি করতে না দেওয়া হয়, তাহলে কোরবানির ঈদের আগেই উচ্চমূল্যে ভোক্তাদের পেঁয়াজ, রসুন ও আদা কিনতে হবে। কারণ আমদানি বন্ধ থাকার কারণে এখনই বাজারে এসব পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।’

মো. মাজেদ বলেন, ‘দেশে আদার যে চাহিদা তার মাত্র ৫ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়, বাকিটা আমদানি করা হয়। রসুন চাহিদার ৫০ শতাংশ উৎপাদন হয়, বাকিটুকু আমদানি করে আনা হয়। পেঁয়াজ দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশই উৎপাদন হয়, ২০ শতাংশ আমদানি করতে হয়।’

কারওয়ান বাজারের ব্রয়লার হাউসের ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘সপ্তাহের ব্যবধানে মুরগির বাজারে তেমন পরিবর্তন নেই। আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি কেজি ২৩০ টাকা ও সোনালি মুরগির কেজি ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’

হিলিতে আমদানি বন্ধ : প্রায় দুই মাস ধরে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ আছে বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই অজুহাত দেখিয়ে দুই মাসে পেঁয়াজ কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ৪৫ থেকে ৪৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গতকাল সকালে হিলি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আড়তগুলোতে দেশি পেঁয়াজ প্রকারভেদে ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সে পেঁয়াজ আবার খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা কেজি। পেঁয়াজ ব্যবসায়ীর বলছেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির খবরে কিছুটা কমতে শুরু করেছে দেশি পেঁয়াজের দাম।

সবজির বাজার : রাজধানীর বাজারগুলোতে বেশ কিছু সবজির দাম কেজিতে পাঁচ থেকে দশ টাকা বেড়েছে। বাজারগুলোতে বেগুনের কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা, কাঁচা পেঁপে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, টমেটো ৪০ থেকে ৫০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, উচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা, পটোল ৬০ থেকে ৭০ টাকা, ঢেঁড়স ৪০ থেকে ৫০ টাকা, শসা দেশি ৬০ থেকে ৭০ টাকা, হাইব্রিড শসা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, ঝিঙা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১০০ থেকে ১২০ টাকা, গাজর দেশি ৭০ থেকে ৮০ টাকা, চায়না গাজর ১০০ থেকে ১২০ টাকা, কাঁচা আম ৪০ গাজর ৫০ টাকা, চালকুমড়া প্রতিটি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, লাউ আকারভেদে প্রতিটি ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

উত্তর বাড্ডা বাজারের সবজি ব্যবসায়ী মো. মেহেদী কালের কণ্ঠকে বলেন, মৌসুম না হওয়ায় গত সপ্তাহের তুলনায় বাজারে বেশ কিছু সবজির দাম কেজিতে পাঁচ থেকে দশ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

বগুড়ায় সবজির দাম বাড়তি : বগুড়ার খুচরা ও পাইকারি বাজারে বেশির ভাগ সবজির দামই বাড়তি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে সবজির দাম অনেকটাই বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। বগুড়ায় সবজির সবচেয়ে বড় বাজার খ্যাত মহাস্থান হাটে কৃষকরা যে দামে সবজি বিক্রি করেছেন, তার চেয়ে মণে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশিতে বিক্রি হয়েছে শহরের আড়তগুলোতে। আবার আড়তের বাজারদরের চেয়ে কেজিতে অন্তত পাঁচ টাকা বেশি দরে সবজি বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে।

বুধবার মহাস্থান হাট ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা করলা বিক্রি করছেন প্রতি মণ এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা। পটোল বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা মণ দরে। কাঁচা মরিচ তিন হাজার ২০০ টাকা, বেগুন প্রকারভেদে এক হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার টাকা, মিষ্টিকুমড়া এক হাজার ১০০ টাকা, টমেটো ৮৫০ টাকা, মুলা ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা, ঢেঁড়স এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা, সজনে ডাঁটা চার হাজার টাকা, পাকরি জাতের আলু এক হাজার ৪০০ টাকা ও কার্ডিনাল এক হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়। মহাস্থান হাটের কাঁচামালের আড়ত হিসেবে পরিচিত শাহ সুলতান সবজি ভাণ্ডারের মালিক বাবুল মিয়া বাবু জানান, গত সপ্তাহে প্রতিটি সবজি যে দামে বিক্রি হয়েছে, এ সপ্তাহে তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/05/05/1276956