২৯ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ৯:৩১

বাংলাদেশিরা বড় অসহায়

হাতে টাকা নেই, ঘরে খাবার নেই। অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাচ্ছে

সুদানের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তার চেয়ে বেশি খারাপ আমাদের। বিশেষ করে আমরা যারা খার্তুমে আছি। দেশের মঞ্চ কাঁপানো বক্তব্যে আমরা রেমিট্যান্স যোদ্ধা, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধির কারিগর, দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। রাজনীতিবিদ, সুধীপাড়া, বুদ্ধিজনদের মুখে বুকের ছাতি চওড়া হয়ে যাওয়া জমকালো সব মন্ত্রমুগ্ধ বাণীর ফোয়ারা ছুটলেও বিদেশ-বিভুঁইয়ে বিপদে পড়লে স্বদেশের টিকিটিও চোখে পড়ে না।

উলটো করছি-করব-দেখছি বলে শুরু হয় সোনামণিদের মনভোলানো টালবাহানা। সেনা-আধা সেনা লড়াইয়ে সুদানের মৃত্যুপুরী খার্তুম থেকে বাঙালিদের নিরাপদে দেশে ফেরা বন্দোবস্ত নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেই ‘হাওয়াই মিঠাই’ জুটছে আমাদের প্রবাসীদের পোড়া কপালে! তল্পিতল্পা গুছিয়ে বড় অসহায় অবস্থায় বসে আছি আমরা বাংলাদেশিরা-দূতাবাসের দেখা নেই।

গড়পড়তা হিসাবে সুদানে প্রায় ২-৩ হাজার বাঙালি। এর মধ্যে ৬০০ জন মাত্র নিবন্ধিত হয়েছে খার্তুমের বাংলাদেশ দূতাবাসের দেশে ফেরার তালিকায়। সেটাও শোনা কথা। ১৫ এপ্রিল যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রত্যাবাসন আয়োজন দূরের কথা, বসবাসের জন্য ‘ডেঞ্জার জোন’ হয়ে ওঠা খার্তুম থেকে সরিয়ে নেওয়ার কোনো পদক্ষেপ নেই আমাদের দূতাবাসের। অথচ আমাদেরই চোখের সামনে দিয়ে খার্তুমে থাকা সব বিদেশি নাগরিকদেরই সরিয়ে নিয়ে গেছে তাদের নিজ নিজ দেশগুলো। শুধু বাংলাদেশিরাই পড়ে আছে!

দেশের প্রবাসী দরদিদের অনেকেরই হয়তো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে! শুনতে অপ্রিয় হলেও এটাই আমাদের নিষ্ঠুর সত্যি। শুধু আমরাই পড়ে আছি। রক্তাক্ত শরীর, খালি পেট, পলকে পলকে মৃত্যুভয় আর চোখ ভরা হতাশা নিয়ে তাকিয়ে আছি দিনের পর দিন-কখন সুমতি ফেরে আমাদের খার্তুম দূতাবাসের। কখন মনে হয় তাদের-পেটের দায়ে বিদেশে পড়ে থাকলেও আমরাও বাংলাদেশের মানুষ। তাদের দেশেরই নাগরিক।

ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের কথা বাদই দিলাম, অনেক আগেই তারা সরিয়ে নিয়ে গেছে নাগরিকদের। এশিয়ার মধ্যেও ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইন্দোনেশিয়া তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিয়ে গেছে আরও দু-তিন দিন আগে। শুধু আমরাই পড়ে আছি। তবে আমাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম প্রতিদিন চাঙ্গা রাখছে আমাদের খার্তুম দূতাবাস। বলছে, ‘আজ আপনাদের তালিকা করা হচ্ছে।

কাল সিল মারা হবে। তারপর এগুলো পাশ হবে। এরপর সৌদি আরব থেকে জাহাজ আসবে। তখন আপনার গাড়ি ধরে সুদানের সমুদ্রবন্দর পোর্ট সুদানে যাবেন।’ ওই পর্যন্তই। এটুকুই। এর মধ্যেই আবার কানে আসছে নতুন কথা-এবার নাকি জাহাজ সংকটে পড়েছে আমাদের দূতাবাস। পোর্ট সুদানে নিতে দেরি হচ্ছে আমাদের। খার্তুম থেকে পোর্ট সুদান যাওয়ার বাসেরও নাকি সংকট। আর এজন্যই আমাদের মৃত্যুর মুখে রেখে খার্তুমের দূতাবাস ছেড়ে সপরিবারে নিরাপদ পোর্ট সুদানে বিলাসবহুল হোটেলে উঠেছেন আমাদের বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মীরা।

সেখানে বসেই আমাদের দেশে ফেরার কাগজপত্র ঠিক করছেন তারা। শুনছি ২ মে একটা সম্ভাব্য তারিখও ঘোষণা করেছেন আমাদের অভিভাবক দূতাবাসের কর্তাব্যক্তিরা। বেঁচে থাকলে ওই দিনই বিরাট গাড়িবহরে পোর্ট সুদানে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে আমাদের জাহাজে সৌদির আরবের জেদ্দায় নিয়ে যাবে। তরপর জেদ্দা থেকে ঢাকায় ফেরার ব্যবস্থা করবেন। জাহাজ খরচটা সম্ভবত দূতাবাসই বহন করবে। তবে খার্তুম থেকে পোর্ট সুদানের দীর্ঘ পথ খরচ দিচ্ছেন আমাদের বাঙালিদেরই এক রেমিট্যান্স যোদ্ধা আবুল খায়ের। তুলা ব্যবসায়ী। প্রায় ৭ বছর ধরে খার্তুমে আছেন। খার্তুমে তার তুলার ফ্যাক্টরি।

দেশে ফেরার অনিশ্চয়তার চেয়েও আমাদের বাঙালিদের এখন বড় ভয় টিকে থাকা। আরও এক মিনিটি কিংবা আরও এক ঘণ্টা অথবা কপাল জোরে আরও একদিন বেঁচে থাকা। কারণ খার্তুম এখন পুরোপুরি অবরুদ্ধ। আর খার্তুমের ইন্দুরমান, মারগাজি, বাগের, বাহারি, আরবি, সারেছিত্তিন, ইমারাতেই প্রবাসী বাঙালিদের বাস। অবরুদ্ধ খার্তুমের এই পুরো অঞ্চল এখন থমথমে। শুক্রবার আমরা যখন আমাদের এ অসহায় অবস্থার কথা যুগান্তরকে জানাচ্ছি তখনও সারেছিত্তিন (তুহিন), আব্দুল্লা তায়িবে (রুপক) আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিমান।

ভীষণ ভয়ে আছি আমরা বাঙালির। ঘরে ঘরে ঢুকে মেরে ধরে যা পারছে সব নিয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ লুটপাট করছে স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী। আর কিছু সরকারি লোকও। আমরা যারা এখন পড়ে আছি, আমাদের আশপাশে কোনো লোক নেই। সুদানিরা বেশিরভাগই সব চলে গেছে বাইরের অঞ্চলে। খাবার সংকট, দোকানপাট বন্ধ। টাকা থাকলেও কোথাও খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, লাইন দিয়ে মোবাইল চার্জ দিচ্ছি আমরা বাঙালিরা। একটু চার্জ হতেই আবার ঘরে। একেক ঘরে, একেক জটলায় ১০-১৫ জন করে বাঙালি। এখানে বাংলাদেশিরা বেশিরভাগই দর্জি বা কাপড় ব্যবসায় জড়িত। তাদের শোরুমগুলোতে থান কাপড়, শার্টিং-শুটিং, কোটের কাপড় আছে। সেগুলো এখন লুট হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে দুজন বাংলাদেশি দর্জির দোকান তালা ভেঙে মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে।

সংকট যেন মহামারি আকার ধারণ করছে খার্তুমে। হাসপাতালে বন্ধ। কোনো চিকিৎসা নেওয়া যাচ্ছে না। যে হাসপাতালগুলো খোলা আছে সেখানে গিজগিজ করছে যুদ্ধাহত অসহায় মানুষ। দেখা দিয়েছে চরম পানি সংকট। নীলনদ থেকে সাপ্লাইর পানিই এখন শুধু অবলম্বন। চালের বস্তা ছিল ৮ হাজার পাউন্ড, এখন তা ২০ হাজার পাউন্ডে দাঁড়িয়েছে। ৪০০ ডলারের উপরে বাংলাদেশিরা বেতন পায় না। এর বেশিরভাগই পান ২০০-৩০০ ডলার।

দর্জি ব্যবসায় জড়িত বাঙালিদের ২-৩ মাসের বেতন আটকে আছে। ঘরে-ফ্রিজে জমানো খাবারও ফুরিয়ে গেছ। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে অনেকেরই। কিন্তু দূতাবাস খাবার সরবরাহের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কে বাঁচল, কে মরল, কে কী খেল এসব নিয়ে দূতাবাসের কোনো মাথাব্যথা নেই। দূতাবাস কর্তৃপক্ষ কবে, কখন আমাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবে সেটা এখন আল্লাহর হাতে।

দেশে সরকারের পক্ষ থেকে টিভিতে বলা হচ্ছে আমাদের নিয়ে যাবে, এগুলো সব কথা, সুদানের খার্তুমে এর কোনো আলামত নেই। যুগান্তরের মাধ্যমে সরকারের কাছে বিপদগ্রস্তদের জোর মিনতি-জরুরিভাবে, অতি দ্রুত ২-৩ দিনের ভেতর খার্তুমের মৃত্যুপুরী থকে সরিয়ে পোর্ট সুদানের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাক। তারপর যেদিন ইচ্ছে সেদিন আমাদের কাগজপত্র করুক দূতাবাস। অন্য দেশের দূতাবাসগুলো ঠিক এ কাজটাই করছে।

খার্তুম থেকে নাগরিকদের পোর্ট সুদানে নিয়ে সেখানে থেকে কাগজপত্র ঠিক করে দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করছে। আর আমাদের এখনো মুলা ঝুলাচ্ছে। ফরম বিতরণ করছে। সেগুলো কিনতে আবার ৩০ তারিখ পর্যন্ত ডেডলাইন দিয়েছে। ৩০ তারিখ যখন কাছাকাছি এলো, তখন দূতাবাস থেকে বলা হচ্ছে বিনা খরচে নেওয়া হবে। অথচ এই কথাগুলো কিন্তু দূতাবাস আগেই বলতে পারত। তাহলে আমাদের এত হয়রানি হতে হতো না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/669419