২৯ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ৯:১৮

গণতন্ত্র মানবাধিকার ও গণমাধ্যম

-ইবনে নূরুল হুদা

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতন্ত্র, মানবাধাধিকার ও গণমাধ্যম একে অপরের সহায়ক ও পরিপূরক। বস্তুত, গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আর পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের অন্যতম চালিকাশক্তি। কোন সমাজে ভিন্নমতের অনুশীলন ও চর্চা না থাকলে সে সমাজকে সভ্য বা গণতান্ত্রিক বলা যায় না। রাষ্ট্রের সকল শ্রেণি, পেশা, দলমত ও সকল ধর্মের অনুসারীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রদর্শনও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আওতাভুক্ত। দার্শনিক ভলতেয়ায়ের ভাষায়, ‘আমি তোমার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য আমি জীবন দিতেও কুন্ঠিত নই’। মূলত, এটিই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আধুনিক সভ্যতার মানদ-। আর পরমত সহিষ্ণুতা গণতন্ত্র ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ; একটি অন্যটির সাথে অবিচ্ছেদ্য। স্বাধীন গণমাধ্যম এক্ষেত্রে অপরিহার্য অনুষঙ্গ।

আধুনিক বিশ্বকে গণতান্ত্রিক বিশ্ব মনে করা হয়। গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানেরও অন্যতম মূলনীতি। গণতন্ত্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে বাকস্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যম। যার মাধ্যমে মানবাধিকার বিকশিত হয়। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরও আমাদের দেশে স্বাধীন গণমাধ্যমের স্বপ্ন পূরুণ হয়নি। ফলে গণতন্ত্রও বিকশিত হতে পারেনি। মানবাধিকারের ক্ষেত্রেও আমরা বেশ পশ্চাদপদ। সাম্প্রতিক সময়ে এ অবস্থার বড় ধরনের অবনতিই ঘটেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন আইনী মারপ্যাচে দেশের গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত করার অভিযোগ উঠেছে জোরালোভাবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রায় সব সূচকেই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানবাধিকারের বিষয়টিও রীতিমত তলানিতে এসে ঠেকেছে। আর সে বাস্তবতায় ওঠে এসেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর প্রতিবেদনে।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা এই প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসের মধ্যে দেশে ৫৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। গত ৩১ মার্চ মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংগঠনটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন স্থানে ৩ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে র‌্যাব ও পুলিশের শারীরিক নির্যাতনে ২ জন এবং র‌্যাবের গুলীতে ১ জন নিহত হয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত তিন মাসে বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ১০২টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬ জন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ১৩৭৪ জন। এদিকে গত তিন মাসে ১২৪ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ৩৪ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১১৬ জন নারী। এদের মধ্যে ৬৮ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে এবং আত্মহত্যা করেছেন ৩০ জন। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮ জন নারী। যা অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতির কথায় স্মরণ করিয়ে দেয়।

এদিকে ২০২২ সালের রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর সূচককে ১৮০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম বলে জানা গেছে। ২০২১ সালের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২। সে হিসাবে এবার এক বছরেই ১০ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। সূচকে শীর্ষ দশটি দেশের নয়টিই ইউরোপ মহাদেশের। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সবচেয়ে এগিয়ে নরওয়ে। তারপর ক্রমান্বয়ে এসেছে ডেনমার্ক, সুইডেন, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, কোস্টারিকা, লিথুয়ানিয়া এবং লিশ্টেনস্টাইনের নাম রয়েছে।

একথা বললে অত্যূক্তি হবার কথা নয় যে, আমাদের দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘আরএসএফ’ প্রকাশিত ২০২০-এর রিপোর্টে দেখা গেছে, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ১৫১তম স্থানে-যা এর আগের বছর ছিল ১৫০তম স্থানে। ২০১৮ সালে ছিল ১৪৬তম স্থানে। এতে প্রমাণ হয় গণমাধ্যমের স্বাধীন পথপরিক্রমা ক্রমেই অমসৃণ হয়ে উঠছে। ফলে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রশ্নবিদ্ধই রয়েছে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সক্রিয় এই সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, বৈশি^ক মহামারি করোনার মধ্যেও বাংলাদেশে অন্তত ৮ জন সংবাদমাধ্যম কর্মীকে পুলিশসহ অন্যরা আক্রমণ করে গুরুতর আহত করেছে। বিভিন্ন আইনে মামলা হয়েছে অন্তত ৯ জনের বিরুদ্ধে। ডিটেনশনে দেয়া হয়েছে ৫ জনকে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কর্মরত অপর আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট’ বা সিপিজে বাংলাদেশের বিদ্যমান গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একইভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ বাংলাদেশে কমপক্ষে ২০ হাজার ওয়েবসাইট ব্লক এবং অনলাইন মাধ্যমের ওপর বিধি-নিষেধ এবং নজরদারির কথা জানিয়েছে।

এমনকি দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্রসহ অনেক সংস্থাই বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিম্নমুখী পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও সংশ্লিষ্ট পত্রিকার রিপোর্টার শামসুজ্জান শামসের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেফতার সে অভিযোগকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় বলে মনে করছেন গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অতিগুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের গণমাধ্যম অতীতে যেমন শৃঙ্খলমুক্ত ছিল না; এখনও নয়। সে ধারাবাহিকতায় অতীতে The Newspaper (Announcment Of declaration) Act-1975 এর মাধ্যমে মাত্র ৪ টি রাষ্ট্রায়ত্ব পত্রিকা রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছিল। যা কারো অজানা নয়।

অবশ্য ৯০’র গণঅভূত্থ্যানের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণমাধ্যম কর্মীদের অব্যাহত দাবির মুখে আন্দোলনরত রাজনৈতিক জোটের ঘোষণা অনুযায়ী জরুরি ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ সংশোধন ও ১৬, ১৭ ও ১৮ ধারাসমূহ বাদ দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করেছিল। তবে পরবর্তীতে সে অবস্থার বিচ্যূতি ঘটানো হয়েছে। ফলে গৃহীত আইনগুলোর মৌলিকত্ব আর টিকে থাকেনি। আর বেসরকারি টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৯৯ সাল থেকে হলেও এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারছে না। ফলে সর্বাধুনিক এই গণমাধ্যমটি মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি।

বর্তমান সরকার জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৩ এর খসড়া প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞসহ সর্বসাধারণের মতামত প্রদানের সুযোগ দেওয়ায় একটা নতুন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়েনি। কারণ, সরকার যে বিষয়েই বিধিপ্রণয়ন করছে বা করেছে তা তাদের অনুকূলেই করা হচ্ছে। এই সঙ্কীর্ণ বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসা কোন ভাবেই সম্ভব হয়নি। সকল ক্ষেত্রেই দেশ, জাতি, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের বিষয়টি উপেক্ষতি থেকেছে বা থাকছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমসহ ব্যক্তি পর্যায়ে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসমূহ বড় ধরনের তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর বিপ্লব ঘটিয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেও বৃত্ত ভাঙা সম্ভব হয়নি। ফলে সমস্যার কোন সমাধান হয়নি।

মূলত, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হওয়ায় আমাদের গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথচলাও মসৃণ হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। অভিযোগ উঠেছে, শুধুমাত্র ভিন্নমতের কারণে গত ১০ বছরে প্রায় ২ হাজারের মত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। একই কারণে ৩৭ লাখ মানুষকে বিভিন্ন মামলার আসামী করা হয়েছে। মামলা দেয়া হয়েছে প্রায় দেড় লাখ। ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যাকা-ের শিকার প্রায় ২ হাজার মানুষ। গুম হয়েছেন সহ¯্রাধিক। বিরোধী দলগুলোর পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে এমন অভিযোগ করা হলেও সরকার তার এই দাবি নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। ফলে অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলার সুযোগ থাকছে না।

আমাদের দেশে যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে তা রুশোর কথায় বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ফরাসি দার্শনিক রুশো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলতে রাজী হননি। তার ভাষায়, জনপ্রতিনিধিরা জনস্বার্থে কাজ করেন না। তারা কাজ করেন নিজেদের স্বার্থে। তিনি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন, যাতে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। পক্ষান্তরে প্লেটো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সবচেয়ে অযোগ্য শাসনব্যবস্থা মনে করতেন। তার মতে, যেহেতু গণতন্ত্র বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা সেহেতু গণতন্ত্র কখনই উন্নতমানের শাসনব্যবস্থা হতে পারে না। কারণ, প্রত্যেক জাতি-রাষ্ট্রেই বিজ্ঞানী, সুপ-িত এবং যোগ্য লোকের তুলনায় অযোগ্য অশিক্ষিত এবং অজ্ঞ লোকের সংখ্যাই বেশি। তাই বেশিরভাগ লোকের শাসন অর্থই অযোগ্য লোকের শাসন। গণতন্ত্র সংখ্যায় বিশ্বাসী, গুণে নয়। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে এসব কথা শ্রুতিকটু মনে হলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা একেবারে উপেক্ষা করার মত নয় বরং অনেকটাই বাস্তবসম্মত।

সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও উদার গণতন্ত্র চর্চার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আমরা মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক পরও এখনো আমাদেরকে গণতন্ত্র ও ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারকে নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হয়নি। গণতন্ত্রে চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা আর উপাসনার স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়ার কথা থাকলেও এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন নিতান্তই গৌণ। মূলত শাসনকাজে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা না গেলে সে সমাজ আর গণতান্ত্রিক থাকে না। এক্ষেত্রে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ এড্রেস’ বেশ প্রাসঙ্গিক। তার ভাষায়, ‘গণতন্ত্র জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা গঠিত সরকার, জনগণের জন্য সরকার।’

আমাদের দেশের প্রচলিত গণতন্ত্রে জনগণের শাসনের নামে গুটিকয়েক ব্যক্তিই রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগটা দীর্ঘদিনের। নিকট অতীতে জনগণের অধিকার শুধু ভোট দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সে অবস্থারও গুরুতর অবনতি ঘটেছে। জনগণের ভোট দেয়ার অধিকারটাও কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে গুরুতর অভিযোগ এখন মানুষের মুখে মুখে। যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে বেশ বাজারও পেয়েছে। তাই এই অশুভ বৃত্ত ভাঙার জন্য জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। কারণ, একক কোন শক্তির পক্ষে এই বৃত্ত ভাঙা কোনভাবেই সম্ভব নয়।

মানব সভ্যতায় গণতন্ত্রের ইতিহাস অতিপ্রাচীন। প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে গণতন্ত্রের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলো ছিল ক্ষুদ্রায়তন এবং স্বল্প জনসংখ্যার। সে কারণে সভা-সমিতির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরাসরি জনগণের মতামত নেয়া সম্ভব ছিল। এটাই ছিল প্রত্যক্ষ বা বিশুদ্ধ গণতন্ত্র। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় রাজ্যসমূহের আয়তন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। বর্তমানে রাষ্ট্রগুলোর বিশাল আয়তন ও বিপুল জনসংখ্যার কারণে সকল জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সম্ভব নয়। কাজেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের হয়ে, জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তারা নির্বাচিত হয়ে জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে আশা করা হয়। এটাকে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়। এ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এর প্রতিফলনটা খুবই গৌণ। সঙ্গত কারণেই সুশাসন আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি।
যেহেতু আমাদের দেশে সাংবিধনিকভাবেই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র চালু আছে। কিন্তু নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই এর যথাযথ প্রয়োগটা বারবারই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরেও আমরা এখনও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারিনি। তাই আমাদের দেশের নির্বাচনগুলো জনমতের যথাযথ প্রতিফলন ঘটছে না বলে জোরালো প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের রাজনীতির সাথে বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের সাথে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে।

মূলত, আমাদের রাজনীতি গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে বেশ আগেই। ক্ষমতাসীনদের একটি অংশ জনগণের কল্যাণে কাজ করার পরিবর্তে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকছেন নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি নিয়ে । আর দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অনুপস্থিতির কারণেই রাষ্ট্রের কোন ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা নেই। শৃঙ্খলিত গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনার অভাবেই এসব ক্ষেত্রে কোন প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সুশাসনের আশাবাদটা আজও আমাদের কাছে অধরায় থেকে যাচ্ছে। ফলে জনজীবনে শান্তি ফিরে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
অনেক সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যূতি সত্ত্বেও সারা বিশ্বে গণতন্ত্র এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জননন্দিত শাসনব্যবস্থা। কারণ, এই পদ্ধতিতে ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযোগ থাকে। ফলে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। আর এটিই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মৌলিকত্ব, বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য। ভোটের মাধ্যমে জনগণ মতপ্রকাশের বা সঠিক রায় প্রদানে ভুল করলেও সেটা গণতন্ত্র এবং জনগণের শাসন। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, আমরা এখন ভোট দানের অধিকার শুধু নয় বরং স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকারও হারিয়েছি। অনাকাক্সিক্ষতভাবে গণমাধ্যমগুলোকে ফরমায়েসী বা আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার মহড়াও প্রত্যক্ষ করছি। একই সাথে গণমাধ্যমে স্বাধীন স্বত্ত্বা নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি করা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট। অথচ গণমাধ্যম হচ্ছে সমাজ-রাষ্ট্রের দর্পণ। তাই গণতন্ত্রকে সার্থক ও সফল করতে হলে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে।

এ বিষয়ে নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি বক্তব্য বেশ চমকপ্রদ। তিনি ২০০৪ সালে বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে লিখিত ’’What’s the Point of Press Freedom? প্রবন্ধে ইংরেজ শাসনের শেষের দিকে ১৯৪৩ সালে সংঘঠিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অনুপস্থিতিকেই দায়ী করেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর অপ্রয়োজনীয় আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় ব্রিটেনের তৎকালীন পার্লামেন্ট ভারতের প্রকৃত সমস্যার কথা জানতে পারেনি। ফলে শাসকগোষ্ঠী দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় যথাযথ ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে সম্ভব হয়নি।
গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম সম্পর্কে আমেরিকার ফেডারেল কোর্টের বিচারপতি রবার্ট এইচ জ্যাকসনের বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূণ। তার ভাষায়, ‘নাগরিকদের ভুল করা থেকে রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব নয়; বরং নাগরিকদের দায়িত্ব হলো সরকারকে ভুল করা থেকে রক্ষা করা।’ মূলত নাগরিক জীবনের সমস্যা, সম্ভাবনা ও মতামতের প্রতিফলনের উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ হচ্ছে গণমাধ্যম। তাই গণতন্ত্রকে অর্থবহ ও ফলপ্রসূ এবং মানবাধিকারে নিশ্চয়তা প্রদান করতে হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো অধরায় থেকে যাবে; কার্যকারিতা হারাবে রাষ্ট্রীয় সত্তা। যা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত!

https://dailysangram.com/post/523157