১৭ এপ্রিল ২০২৩, সোমবার, ১২:১১

লোডশেডিংয়ে নির্ঘুম রাত, সেচকাজেও সংকট

তাপদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। এর মধ্যেই বেড়েছে বিদ্যুতের ভোগান্তি। গত কয়েক দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড হলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গরম বেড়ে যাওয়ায় এসি ও ফ্যান বেশি চলছে। পাশাপাশি রমজান ও সেচ মৌসুম চলার ফলে বিদ্যুতের চাহিদা এক লাফে অনেক বেড়েছে। উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

ঢাকার বাইরে অনেক এলাকায় দিনে ৮-১০ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। গরমে অতিষ্ঠ মানুষ রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। ঈদের আগে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে সেচ কার্যক্রম। তাপমাত্রা না কমা পর্যন্ত ভোগান্তি কমবে না বলে মন্তব্য করেছে বিদ্যুৎ খাত-সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে গত বছর সরকার গ্যাস ও তেল আমদানি কমিয়ে দেয়। ফলে ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং করে সরকার। গত ফেব্রুয়ারি থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। ফলে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। এখন দিনে গড়ে ১০০ কোটি ঘনফুটের ওপর গ্যাস দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুতে। আগে এটা ছিল ৮০-৮৫ কোটি ঘনফুট। ফার্নেস অয়েলেরও দাম কমেছে। পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক নতুন কয়েকটি কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এতে চলতি মৌসুমের শুরু থেকে চাহিদার কাছাকাছি ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন। ফলে তেমন লোডশেডিং ছিল না।

এক সপ্তাহ থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং বাড়তে থাকে। গত ১৩ এপ্রিল রাত ৯টায় দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট। সে সময়ও ৩০৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। সেদিন সর্বোচ্চ লোডশেডিং ছিল ৭৭৬ মেগাওয়াট। ১৪ এপ্রিল লোডশেডিং ছিল সর্বোচ্চ ১ হাজার ২৮০ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। শনিবার বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৪ হাজার ১০৪ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ৮৯৬ মেগাওয়াট। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রকৃত লোডশেডিং আরও বেশি। সূত্রের তথ্যমতে, শনিবার বিদ্যুতের ঘাটতি আড়াই হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়। সক্ষমতা থাকলেও চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদিত না হওয়ার জন্য জ্বালানি সংকট এবং কেন্দ্র মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য বন্ধ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা।

জানা গেছে, গ্যাস ও জ্বালানি তেল সংকটে শনিবার ৪ হাজার ১৫৬ মেগাওয়াট এবং কেন্দ্র মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য ২ হাজার ৬৪৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে, গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে দিনে কমপক্ষে ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু পেট্রোবাংলা সরবরাহ করছে গড়ে ১০০ কোটি ঘনফুট। এ ছাড়া বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের ত্রুটির কারণে প্রায় বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে।
শহরে কম, গ্রামে বেশি

কয়েক দিন ধরে লোডশেডিং বেড়েছে। দিনে-রাতে সব সময়ই বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে দিনে ১০ ঘণ্টাও লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। তবে সে তুলনায় ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর পরিস্থিতি ভালো।

খুলনা নগরীর শেরেবাংলা ফিডারের অধীন শেখপাড়া পুরাতন মসজিদ এলাকার বাসিন্দা ইয়াছির আরাফাত জানান, শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়, রাত ২টা ৩১ মিনিটে, রোববার ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে, দুপুর সাড়ে ১২টায় লোডশেডিং হয়। প্রতিবার এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ ছিল না।

দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) প্রধান প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কেন্দ্রীয়ভাবে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় তাঁরা লোডশেডিং দিতে বাধ্য হচ্ছেন। খুলনার কয়রা উপজেলার কালনা বাজারের ব্যবসায়ী মহসীন মোল্লা জানান, দিনে-রাতে পাঁচ থেকে ছয়বার লোডশেডিং হচ্ছে। প্রতিবার এক থেকে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। এতে দোকানের ফ্রিজে রাখা মালপত্র নষ্ট হচ্ছে।

রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীন নগরীর বর্ধিত অংশে দু’দিন ধরে বিদ্যুৎ শুধু যাচ্ছে আর আসছে। রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি রেজাউল ইসলাম মিলন বলেন, আধা ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করায় ঈদের আগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্রেতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। রংপুর বিভাগের আট জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ৯০০ মেগাওয়াট। বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট।

কুড়িগ্রামে এক সপ্তাহ ধরে দিনে ও রাতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হচ্ছে। শহরের গাড়িয়ালপাড়ার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম বলেন, রোববার সেহরির খাবার খাওয়ার সময় ৪টার দিকে বিদ্যুৎ চলে যায়। পরে ফজরের নামাজ পড়ার সময় বিদ্যুৎ আসে। আবার বিকেল ৫টার দিকে বিদ্যুৎ চলে যায়। জেলা হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় চিকিৎসারত রোগীর স্বজন জ্যোৎস্না বেওয়া বলেন, ‘সকাল থাকি কারেন্ট নাই। রুমের বাইরে গাছের বাতাসও নাই। হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছি। খুব গরম।’

ফরিদপুরে শনিবার রাত ১১টা থেকে এক ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হচ্ছে। রোববারও দিনভর একই নিয়মে চলে লোডশেডিং। বাগেরহাটে দিনে ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। নড়াইলের কালিয়ার গ্রামগুলোতে শনিবার লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষ দুর্ভোগ পোহালেও পৌরসভার বাসিন্দারা স্বাভাবিক বিদ্যুৎসেবা পেয়েছেন।

কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ১৫-২০ মিনিট থেকে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। একবার গেলে আর আসার নাম নেই। রোববার ভোর ৪টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত ১৪ ঘণ্টায় আটবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে দৈনিক ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। পিরোজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি দুই ঘণ্টা পর এক ঘণ্টা লোডশেডিং করছে। ঝিনাইদহের অধিকাংশ এলাকায় ইফতার, তারাবি ও সেহরির সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চার-পাঁচ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না।

ঢাকায় এলাকাভেদে দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং হচ্ছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জানান, তাঁর এলাকায় সরবরাহজনিত কারণে এখনও লোডশেডিং হয়নি। তবে বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ ও সঞ্চালন সমস্যার কারণে লোডশেড করতে হয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2304168164