১৭ এপ্রিল ২০২৩, সোমবার, ১১:৪৯

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে সাতশ’ ফুট পর্যন্ত

আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরা: টানা দুই সপ্তাহ ধরে সাতক্ষীরায় বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। অতি দাবদাহে গলে যাচ্ছে সড়কের পিচও। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে জেলার মানুষ। কাঠফাটা রোদে দুঃসহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। রাতেও মিলছে না শান্তি। এমন অবস্থায় প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হচ্ছে না কেউ। সপ্তাহ জুড়ে ৪০ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে এ জেলায়। আগামী শুক্রবার পর্যন্ত তাপমাত্রা একই অবস্থায় থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। চৈত্রের শেষে ও বৈশাখের শুরুতে অনাবৃষ্টির কারণে জেলার পুকুরগুলো প্রায় শুকিয়ে গেছে। সুপেয় পানির অভাবে রান্না থেকে শুরু করে খাওয়া ও গোসল করতে বিপাকে পড়েছে জেলার কয়েক লক্ষ মানুষ। সরকারি যে সব দীঘি ও পুকুরে সারা বছরই পানি থাকে প্রভাবশালীরা তা দখল করে রেখেছে। অন্যদিকে সাতক্ষীরা শহরে অব্যাহত ভাবে পুকুর ভরাট চলছে। ফলে চরম বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এক দিকে জেলা ব্যাপী তীব্র সুপেয় পানি সংকট অন্যদিকে সাতক্ষীরার পৌর এলাকায় আইন অমান্য করে একের পর এক ভরাট করা হচ্ছে পুকুর। জমির মালিকেরা কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে এসব পুকুর ভরাট করছেন। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের তেমন কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না। গত দুই বছরে পৌর এলাকায় অন্তত ২০টি পুকুর ভরাট করা হয়েছে, যার অধিকাংশ জমিতে তৈরি করা হয়েছে ভবন। পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি পানির সংকটে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরা শহরের কামাননগর এলাকার মিন্টু ও নূর আলী গাজী, ইটেগাছার আবুল কাসেম, পলাশপোল এলাকার নওসাদ চৌধুরী, আসাদুল মোল্যা, হাজু ঘোষ, আফতাবুজ্জামান, খুলনা মোড়ের আবদুর ছাত্তার, সুলতানপুর এলাকার তৌহিদুল ইসলাম, মো. আলম, কাটিয়ার রেজাউল করিম, লুৎফর রহমান প্রমুখ ব্যক্তির পুকুর ভরাট করা হয়েছে। এর বাইরে সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের পুকুর ও লুৎফর রহমানের পুকুর দুটি আংশিক ভরাট হওয়ার পর পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় লোকজনের হস্তক্ষেপে ওই অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের সাতক্ষীরার সহকারী পরিচালক শরীফুল ইসলাম বলেন, তাদের জনবল কম। সব জেলায় তিনিসহ তিনজন রয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পুকুর ভরাটের কথা জানতে পারেন না। তবে জানতে পারলে তারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। গত দেড় বছরে তারা তিনটি পুকুর ভরাট বন্ধ করেছেন। এ বিষয়ে কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা জরিমানা করেননি।

উপকূলের এমন অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই সুপেয় পানির জন্য যুদ্ধ করছেন। তাদের কেউ পুকুর, বৃষ্টি বা বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট থেকে সংগ্রহ করা পানি পান করছেন। যারা এসব উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাদেরকে লবণাক্ত পানি পান করতে হচ্ছে। এতে নানা ধরনের রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সাতক্ষীরা সদর ও শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে পাওয়া গেছে এমন চিত্র। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়েছে। আগে শুধুমাত্র উপকূলীয় অঞ্চলের নদীর পানি পানের অযোগ্য ছিল। এখন অনেক এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানিও পান করা যায় না। ফলে এসব অঞ্চলে সুপেয় পানির ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে।

সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের খবর অনুযায়ী বর্তমান সময়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সাতশ’ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে। তবে স্থান বিশেষে তা পাঁচশ’ ফুট পর্যন্ত রয়েছে। ছাড়া পারিবারিক ভাবে বসানো হাজার হাজার নলকূপেও পানি নেই। এতে পানি সংকটে পড়েছে জেলার প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী পানিতে সর্বোচ্চ ২৬০০ এমজি পার লিটার লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। উপকূলীয় এলাকায় যার গ্রহনযোগ্যতা মাত্র ১০০০ এমজি পার লিটার। ফলে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার ফলে বিভিন্ন কঠিন ও জটিল রোগের সম্মুখীন হচ্ছে এখানকার সাধারণ মানুষ। জনস্বাস্থ্য বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, জেলার ২৫ লাখ জনগোষ্ঠীর ৮৫ শতাংশ মানুষের খাবার পানি সরবরাহ করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। কিন্তু পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মানুষ খাবার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বছরের মার্চ মাসে ২ হাজার ১১৫ মিলিমিটার এবং এপ্রিল মাসে ৫ হাজার ৪৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়া জরুরি। কিন্তু চলতি বছরে এখনো বৃষ্টিপাতের পরিমাণ তেমন দেখা মেলেনি। এ বছর বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণাঞ্চালে পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এ সমস্যা নিরসনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তীব্রগরমে বাড়ির আশপাশের পুকুরের পানি তলানিতে ঠেকেছে, পানি দিয়ে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। ফলে যেসব জায়গায় পুকুর ফিল্টার রয়েছে, তা অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

সম্প্রতি সাতক্ষীরায় জেলা পরিষদের মালিকানাধীন প্রভাবশালীদের দখলে রাখা ১৩০টি জলাশয় উদ্ধার করার দাবি করেছে জেলা পরিষদ। এরমধ্যে ৭৩টি জলাশয় খনন, পুনঃখনন ও সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে জেলা পরিষদ। ৪৮টি জলাশয়ের টেন্ডার দেওয়ার প্রক্রিয়াও শেষ হয়েছে। ৯টি টেন্ডারের অধীনে ৩০টি জলাশয়ের সংস্কার কাজ চলছে। দুটি জলাশয় প্রভাবশালীদের দখলমুক্ত করতে না পারায় বাকি ২৮টি জলাশয়ের কাজ চলছে। জলাশয়গুলোর কাজ সমাপ্ত হলে লক্ষাধীক মানুষ সুপেয় পানির সুবিধা পাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি পুকুর, দীঘি ও জলাশয় পুন:খনন প্রকল্প জেলা পরিষদের উদ্যোগে সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পে জেলা পরিষদের অধীন ৭৩টি পুকুর ও দীঘি পুনঃখনন করা হবে। এতে সুপেয় পানির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বেদখল হয়ে যাওয়া পুকুর ও দীঘি উদ্ধার হবে বলে জানান কর্তৃপক্ষ।

সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.আমিনুল ইসলাম বলেন,জেলা পরিষদের মালিকানাধীন ১৩০টি পুকুর ও দীঘি রয়েছে। এরমধ্যে আপাতত ৭৩টি পুনঃখনন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে ২০১৯ সালের জুনে। তিনি আরো বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জেলার সুপেয় পানির সংকট কিছুটা হলেও কমবে। বিশেষ করে শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালীগঞ্জ উপজেলার মানুষ বেশি উপকৃত হবেন। প্রকল্পের অধীনে যতগুলো পুকুর ও দীঘি পুনঃখনন হচ্ছে, তার মধ্যে ৬৬টিই এ তিন উপজেলার। সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জেলার মানুষের পানির কষ্ট দূর হবে। তাছাড়া দীর্ঘদিন বেদখলে থাকা সরকারি জলাশয় গুলো উদ্ধার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
-

https://dailysangram.com/post/522339