১৪ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৩৩

ইসির সাংবাদিক নীতিমালা জারি

টিআইবি ডিআরইউসহ বিভিন্ন সংগঠনের তীব্র আপত্তি

মালা নিনির্বাচনের খবর সংগ্রহে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য জারি করা নির্বাচন কমিশনের নীতিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশল অব বাংলাদেশ (টিআইবি), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ (ডিআরইউ) বিভিন্ন সংগঠন। গতকাল পৃথক বিবৃতিতে তারা এ নীতিমালা বাতিলেরও দাবি জানিয়েছে।

টিআইবি বলেছে, ইসির এ নীতিমালা আজ্ঞাবহ সাংবাদিকতায় বাধ্য করার অপচেষ্টা। টিআইবি মনে করছে, নির্বাচন কাভারেজ নিয়ে কমিশনের বিধি-নিষেধের তালিকা যত দীর্ঘ হচ্ছে, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র ততটাই দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে।
এদিকে এ নীতিমালা বাতিলে সাংবাদিকদের দাবির মুখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, নীতিমালায় অধিকতর সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজনের কোনো প্রয়োজন আছে কি না তা দেখা হবে। সে বিষয়গুলো আমরা দেখে যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নেব। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে দায়িত্বপ্রাপ্ত গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য বুধবার একটি নীতিমালা জারি করে নির্বাচন কমিশন। ওই নীতিমালায় ভোটের দিন সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল চলাচলসহ বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এতে বলা হয়, ভোটকক্ষে সাংবাদিকেরা ১০ মিনিটের বেশি অবস্থান করতে পারবেন না।

একইসঙ্গে দুয়ের অধিক মিডিয়ার কর্মীরা ভোটকক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না। ভোটকক্ষ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা যাবে না। এ নীতিমালা জারির পরই তা প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন নিয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন ‘রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি)’। এ নীতিমালা বাতিলের দাবি জানিয়ে গতকাল টিআইবি ও ডিআরইউ পৃথক বিবৃতি দিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, নির্বাচনি সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মীরা মোটরসাইকেল ব্যবহার, ১০ মিনিটের বেশি ভোটকক্ষে অবস্থান ও ভোটকক্ষ থেকে কোনোভাবেই সরাসরি সম্প্র্রচার করতে পারবে না বিধানাবলি সংবলিত নীতিমালা নির্বাচন কমিশন জারি করেছে। এ নীতিমালা সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ভূমিকা পালনে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা টিআইবির।

এছাড়া প্রিজাইডিং অফিসারকে অবহিত করে ভোটগ্রহণ কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ, ছবি তোলা ও ভিডিও ধারণ করতে পারবে এবং রিটার্নিং অফিসার স্বীয় বিবেচনায় যৌক্তিক সংখ্যক সাংবাদিককে অনুমোদন ও কার্ড ইস্যু করতে পারবেন-মর্মে যে বিধান রাখা হয়েছে, তা মূলত গণমাধ্যম কর্মীদের আজ্ঞাবহ সাংবাদিকতায় বাধ্য করার অপচেষ্টা।

বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমকে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের চোখ ও কান বলে অভিহিত করেছে। আবার সম্প্রতি জারি করা পরিপত্রের মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু নিজেদের জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করতে এ জাতীয় মুখরোচক মন্তব্য করেছে এবং কার্যক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কার্যক্রম শেকলবদ্ধ করে তুলছে।

মোটরসাইকেল স্থানীয় পর্যায়ে সংবাদকর্মীদের দায়িত্বপালনের একটি অপরিহার্য বাহন। অধিকন্তু, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক কেন্দ্র আছে যেখানে গাড়ি বা অন্য কোনো যানবাহনে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তা ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে একটি গাড়ি ভাড়া করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়।

এ রকম একটি পরিস্থিতিতে নির্বাচনের দিন গণমাধ্যমকর্মীদের মোটরসাইকেল ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ দুরভিসন্ধিমূলক। ১০ মিনিটের বেশি সংবাদকর্মীদের ভোটকক্ষে অবস্থান করতে না পারার যে বিধান করা হয়েছে, এর যৌক্তিকতা কী! নির্বাচন কমিশন চিহ্নিত গোপন বুথের ডাকাতদের রক্ষায় এই নিয়মের আমদানি কি-না- তা স্পষ্ট হওয়া জরুরি।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন সংবাদকর্মীদের ভোট কাভারেজের অনুমতি দিয়ে কার্ড দেওয়ার পর ভোটকক্ষে ঢুকতে কেন্দ্রে প্রিজাইডিং কর্মকর্তার বাড়তি অনুমতির প্রয়োজনীয়তা কী, তা বোধগম্য নয়। তা ছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি কোনো ভোটকক্ষে অনিয়ম সংঘটিত হয়, সেক্ষেত্রে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা কী অনুমতি দিবেন? আর অনুমতি না দিলে নির্বাচনি অনিয়মের ছবি তোলা ও তথ্য সংগ্রহ কী ধরনের বাধার সৃষ্টি হবে, তা নীতিমালা তৈরিতে কমিশনের বিচার্য ছিল বলে বোধগম্য হচ্ছে না। মুখে নির্বাচনি স্বচ্ছতার কথা বলে আবার কোন বিবেচনায় ভোট কক্ষ থেকে সরাসরি সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হলো, কিংবা এর মাধ্যমে কী বৈশ্বিক চর্চা কমিশন অনুকরণের চেষ্টা করছে, সেটি সত্যিই কৌতূহলোদ্দীপক।

নীতিমালায় সাংবাদিকের সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষমতা প্রসঙ্গে ড. জামান বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, পক্ষপাতমূলক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রভাব বলয়ে সাংবাদিকের সংখ্যা ঠিক করার এখতিয়ার একজন কর্মকর্তার ইচ্ছাধীন হয়ে পড়াটা মোটেও সুখকর নয়।

উপরন্তু কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ডের অনুপস্থিতি ছাড়াই কাকে কীভাবে নির্বাচন করা হলো, আর কাউকে কেন বাদ দেওয়া হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। যেখানে নির্বাচনের সময় অনেক স্বনামধন্য গণমাধ্যমের কর্মীরাও নির্বাচনের কাভারেজের অনুমতি পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন বাস্তবতায় প্রকাশিত নীতিমালাটি কমিশন বাতিল করবে এই দাবি জানাচ্ছি। প্রয়োজনে বৈশ্বিক চর্চার সঙ্গে মিলিয়ে ও গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় আলোচনার মাধ্যমে একটি যথোপযুক্ত নিয়মাবলি তৈরির আশু উদ্যোগ নেবে।

অপরদিকে আরেক বিবৃতিতে ডিআরইউ সভাপতি মুরসালিন নোমানী ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল বলেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো ধরণের আলোচনা ছাড়াই মোটরসাইকেল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত সাংবাদিকতাবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করেছে ইসি; যা মুক্ত সাংবাদিকতার পরিপন্থি। সংবাদ সংগ্রহে মোটরসাইকেলে নিষেধাজ্ঞা সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণ করার শামিল বলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মনে করে।

সাংবাদিকদের পেশাগত কাজে সহযোগিতা করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। কারণ দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য পেশাদারিত্ব অক্ষুণ্ন রেখে সাংবাদিকরা কাজ করে যাচ্ছেন। নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে ইসি যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে তা প্রত্যাখ্যান করছে ডিআরইউ।

নেতারা আরও বলেন, অবিলম্বে প্রণীত নীতিমালা বাতিল করে সাংবাদিক সংগঠনসমূহের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সাংবাদিক সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। নতুবা সাংবাদিকরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবেন।

এদিকে নীতিমালা নিয়ে গতকাল অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা। ওই বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, বিষয়টা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি। আমরা নীতিমালার ওপর মতামতগুলো পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত জানাব। তিনি বলেন, আমরা সংবাদ সংগ্রহে সাংবাদিকদের জন্য একটা নীতিমালা জারি করেছি।

এটা নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। সেটা আমরা মিডিয়া থেকে জানতে পেরেছি। বিষয়টা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি। তিনি আরও বলেন, আমরা বলতে চাই কোনো ডকুমেন্ট কিন্তু চিরস্থায়ী নয়। যদি প্রয়োজন হয়, সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন করা যায়। আমরা যে নীতিমালা জারি করেছি, সেটা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আরও আলোচনা করব।

বিভিন্ন সূত্র থেকে যেসব মতামত বা সমালোচনা আসবে বা এসেছে, সেগুলো আমরা বিবেচনায় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব। নীতিমালায় কোনো অধিকতর সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজনের কোনো প্রয়োজন আছে কি না তা দেখা হবে। সে বিষয়গুলো আমরা দেখে যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নেব। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

সিইসি বলেন, নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছতা চায়। কমিশন সুশৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক সেই জিনিসটা চায়। সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা সব বিষয়ে একটি শৃঙ্খলা বিধানের চেষ্টা করব। অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেই জিনিসটা মাথায় রেখেই হয়তো নীতিমালাটা করেছি। তারপরও যেহেতু আপনারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কাজটা করবেন, আপনাদের মতামতগুলো নিয়ে আমরা বসে আরও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব এবং আপনাদের যথা সময়ে অবহিত করব।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/665402