১১ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:৩১

পেনশনের জন্য ঘুরছেন ৬০ হাজার শিক্ষক

যশোরের মধুপুর বাহাদুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সুকুমার চন্দ্র অবসরে গেছেন ২০২০ সালের ১ জুন। ইতোমধ্যে তার অবসরজীবনের প্রায় ৩ বছর হতে চলল। কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত তার প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা পাননি। ওই বছর একইদিন অবসরে গেছেন বরিশালের খাঞ্জাপুর পাঙ্গাশিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গৌরী শঙ্কর। তার টাকাও এখন পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়নি। এই দুই শিক্ষক কবে নাগাদ তাদের অবসরের ভাতা পাবেন সেটি অনেকটাই অনিশ্চিত। অথচ সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই অবসরের সব অর্থ পেয়ে যান। বেসরকারি শিক্ষকরা অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুকুমার ও গৌরী শঙ্করের মতো প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী তাদের অবসর ভাতা পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তাদের পাশাপাশি আরও সাড়ে ২৪ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী ঘুরছেন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থের জন্য। সবমিলে প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর আর্থিক দাবি ঝুলে আছে। এজন্য অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন।

চাকরি ছাড়ার পর এসব শিক্ষকের আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। নিজের পাওনা টাকা না পাওয়ায় অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে অনেকের শেষজীবন। এছাড়া বৃদ্ধ বয়সে চিকিৎসা দরকার। কারও বা সন্তানের লেখাপড়া কিংবা কন্যাকে বিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু টাকার অভাবে সবই আটকে আছে কিংবা ধারদেনা করে কাটাতে হচ্ছে। অবসরে যাওয়ার পর টাকা না পেয়ে মারা যাওয়ার দৃষ্টান্তও আছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অবসর বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এটা ঠিক যে সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার পরপরই তাদের প্রাপ্য অবসর সুবিধা পেয়ে যান। কিন্তু শিক্ষকদের মাসের পর মাস ঘুরতে হচ্ছে। এই অবস্থার মূল ও একমাত্র কারণ হচ্ছে বোর্ডের তহবিল সংকট। তবে এটাও ঠিক যে, এক সময় এই জট আরও দীর্ঘ ছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক দফায় বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছেন। এর মধ্যে চলতি অর্থ অর্থবছরেও ১শ কোটি টাকা আছে। সেই অর্থে শিক্ষকের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। নইলে এই জট আরও লম্বা হতো। তিনি আরও বলেন, বিশেষ বরাদ্দের জন্য সরকারের কাছে অতিরিক্ত ১ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। সেটি বরাদ্দ পেলে ১৫ থেকে ২০ হাজার শিক্ষকের দাবি মেটানো সম্ভব হতো।
আর কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব শাহজাহান আলম সাজু যুগান্তরকে বলেন, অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টে নিয়মিত আয়ের পথ আছে। কিন্তু প্রতিমাসে যে পরিমাণ দাবি আসে, সেই তুলনায় বরাদ্দ নেই। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক ইনক্রিমেন্ট সংক্রান্ত বাড়তি অর্থ। ফলে প্রতিমাসে অনেককে বিদায় করার পরও কিছু দাবি অনিষ্পন্ন থেকে যাচ্ছে। আর এই প্রক্রিয়ায়ই জট বাড়ছে। এখন বিশেষ ও এককালীন বড় বরাদ্দ না করা হলে শিক্ষকদের ঘুরতে হবে। পাশাপাশি বাজেটে এমপিওর (বেতন-ভাতা) মতোই অবসর-কল্যাণ খাতে পৃথক বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।

জানা গেছে, অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে অর্থের উৎস হচ্ছে দুটি। এগুলো হচ্ছে, এমপিও খাত থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের দেওয়া চাঁদা এবং স্থায়ী আমানত থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ। কিন্তু এই আয়ের তুলনায় ব্যয়ের চাহিদা অনেক বেশি। দেখা গেছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে মোট অবসরভাতার দাবিদার ছিলেন ২২ হাজার ৪৩৩ জন। যেহেতু প্রতিমাসেই কিছু আবেদন অনিষ্পন্ন থাকে। তাই পরের ১৬ মাসে বা ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই জট বেড়ে যায়। তখন পর্যন্ত অপেক্ষমাণের তালিকায় সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৬শ। এরপর গত ১৫ মাসে সংখ্যা আরও ৩ হাজার বেড়ে এখন হয়েছে সাড়ে ৩৫ হাজার। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা দরকার। অন্যদিকে অবসর বোর্ডে প্রতিমাসে গড়ে ৮৩৩টি আবেদন যুক্ত হচ্ছে।

এই বোর্ডে প্রতিমাসের আবেদন নিষ্পত্তিতে দরকার ৯৫ কোটি টাকা। বোর্ডের আয়ের মধ্যে আছে ৪ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিও থেকে কেটে রাখা ৬ শতাংশ হারে মাসিক চাঁদা ৬৭ কোটি টাকা। এছাড়া বোর্ডের স্থায়ী আমানত থেকে সুদ আসে সাড়ে ৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতিমাসে ঘাটতি থাকছে সাড়ে ২৬ কোটি টাকা। ফলে বাধ্য হয়ে মাসে সাড়ে ৭০ কোটি টাকার মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। অবসর বোর্ড বর্তমানে ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলের আবেদনকারীদের অর্থ পরিশোধ করছে। অবসর সুবিধা হিসাবে একজন শিক্ষক গড়ে ১২ লাখ আর একজন কর্মচারী ৬ লাখ টাকা করে পেয়ে থাকেন। কলেজের অধ্যক্ষ সর্বোচ্চ ৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পান।

অন্যদিকে কল্যাণ ট্রাস্টে ২০২০ সালের মার্চ মাসে আবেদন অনিষ্পন্ন ছিল ১৯ হাজার ৪৬০টি। এই সংস্থায় অবশ্য শিক্ষকরা গড়ে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন। অর্থের পরিমাণ কম হওয়ায় এই সংস্থায় আবেদনের জট তুলনামূলক কম। এরপরও অর্থের অভাবে দাবি সব মিটছে না। ২০২১ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত কল্যাণ ট্রাস্টে বর্তমানে সাড়ে ২৪ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন আছে।

এসব আবেদন নিষ্পত্তির জন্য দরকার ২ হাজার কোটি টাকা। তবে এই সংস্থায় শিক্ষকদের দাবি মেটাতে প্রতিমাসে ৫২ কোটি টাকা দরকার। কিন্তু চাঁদা আর এফডিআর থেকে প্রাপ্ত আয় আসে মাসে ৪২ কোটি টাকা। ফলে প্রতিমাসে ১০ কোটি টাকা ঘাটতি থাকে। একজন শিক্ষক গড়ে ৭ থেকে ৮ লাখ আর কর্মচারীরা এর অর্ধেক অর্থ পান। তাই যাদের আবেদন নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না তারাই জটে পড়ে যাচ্ছেন।

২০০২ সালে বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা দেওয়া শুরু হয়। আইন অনুযায়ী শিক্ষকরা প্রতিমাসে এমপিও বা বেতন থেকে চাঁদা দেবেন। পাশাপাশি প্রতিবছর এই খাতে সরকারি অনুদানও আসার কথা ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই এই অবসর সুবিধা বোর্ড চরম অবহেলিত। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই বোর্ডের এফডিআর ছিল মাত্র ৮৯ কোটি টাকা। এটা থেকে নামমাত্র আয় ছিল।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সদস্য সচিব হিসাবে যারা দায়িত্ব পালন করে গেছেন তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছিল। এর মধ্যে বড় দুর্নীতি ছিল গোপন আঁতাতের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংক থেকে বেসরকারি ব্যাংকে স্থায়ী আমানতের টাকা সরিয়ে নেওয়া। ফলে চাঁদার টাকায় কেবল আবেদনকারীদের বিদায় করা হতো। আয়ের তুলনায় দাবি বেশি থাকায় সৃষ্টি হয় মহাসংকট। এই সংকটের কথা জানতে পেরে উভয় সংস্থায় ২০১৬ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ অনুদান দিচ্ছেন। এ কারণে জট কিছুটা কমেছে। এখন শিক্ষকদের দুঃখ দূর করতে নিয়মিত বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/664389