৪ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:৫৬

মেধার আকাল

-ইকতেদার আহমেদ

আশির দশকের গোড়ার দিকে একটি জেলা শহরের স্বনামধন্য স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্ররা তৃতীয় ঘণ্টায় নির্ধারিত ইংরেজি শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে তাদের শ্রেণিকক্ষে হইচই করতে থাকে। পার্শ্ববর্তী কক্ষে নবম শ্রেণীতে পাঠদানরত শিক্ষকের পাঠদানে বিঘœ ঘটায় তিনি বিষয়টি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অবহিত করেন। প্রধান শিক্ষক বিষয়টি শুনার পর তাৎক্ষণিক স্কুলের বিশ্রাম কক্ষে অপেক্ষমাণ ভূগোল বিষয়ের শিক্ষককে অষ্টম শ্রেণীর কক্ষে পাঠদানের জন্য পাঠান। ভূগোল শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হয়ে ওই ঘণ্টা কোন বিষয়ের জন্য নির্ধারিত এটি জিজ্ঞাসা করলে শ্রেণীর ক্যাপ্টেন ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের কথা বলে। তখন ভূগোল শিক্ষক ছাত্রদের আধা-ঘণ্টা সময় দিয়ে ‘আওয়ার স্কুল’-এর ওপর এক পৃষ্ঠার মধ্যে একটি রচনা লিখতে বলেন।

জনৈক ছাত্র অর্ধ-পৃষ্ঠা লেখার পর ভূগোল শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার কাছে ‘কমিটি’ ও ‘কমন’ শব্দ দু’টির ইংরেজি বানান জানতে চাইলে তাৎক্ষণিক উভয় বানান সম্পর্কে শিক্ষক কিছুটা সন্দিহানে থাকায় ছাত্রকে বলেন, কমিটি লিখতে টি (T) একটি দিলেও হয় তবে দু’টি দিলেও অশুদ্ধ হবে না। অনুরূপ কমন লিখতে এম (M) একটি দিলেও হয় তবে দু’টি দিলেও অশুদ্ধ হবে না। এবার সেই ছাত্র একই শব্দে ভিন্নতর বানান কেমন করে হয় এ প্রশ্ন তুললে শিক্ষক বলেন, সৌদিরা প্রথমোক্ত বানানের ক্ষেত্রে একটি টি (T) এবং দ্বিতীয় বানানের ক্ষেত্রে একটি এম (M) ব্যবহার করে; অপরদিকে ভারতীয়রা প্রথমোক্ত বানানের ক্ষেত্রে দু’টি টি (T) এবং দ্বিতীয় বানানের ক্ষেত্রে দু’টি এম (M) ব্যবহার করে। সৌদি আরব যেহেতু আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম রাষ্ট্র এবং ভারত যেহেতু আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র- উভয় বানানের ব্যবহারে কোনোরূপ দোষ নেই।

শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। নির্ধারিত বিষয়ের শিক্ষক না হলেও যখন কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে বানান বিষয়ে একজন ছাত্র এ ধরনের অদ্ভুত ধারণা লাভ করে তখন শিক্ষকের ওপর তার শ্রদ্ধা কতটুকু অটুট থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের দেশে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলে যেকোনো নির্ধারিত পদে নিয়োগ পেতে হলে দীর্ঘদিন থেকে অনুসৃত একই ধরনের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হতো। কালের বিবর্তনে পরীক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে এবং এখন একই পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করতে দেখা যায়।

সরকারের বিভিন্ন ক্যাডারে শূন্য পদগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সরকারি কর্ম কমিশন একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা ও নির্ধারিত পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে পূরণের ব্যবস্থা করে থাকলেও মাঝে মধ্যে এর ব্যত্যয় হতে দেখা যায়। সত্তরের দশকের শেষের দিকে দেখা গেল ক্যাডার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যারা ৬০ শতাংশের উপরে নম্বর পেয়েছেন তাদের মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ডাকা হচ্ছে। এর পর আশির দশকের প্রথমার্ধে দেখা গেল, যারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ৪৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন তাদের মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ডাকা হচ্ছে।

ক্যাডার পদে লিখিত পরীক্ষা এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ নম্বরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও হঠাৎ দেখা গেল ৩০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা আয়োজনের মাধ্যমে ৬৫০ জন কর্মকর্তাকে একটি ক্যাডার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগের সব পরীক্ষায় আবেদনকারীদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ নির্ধারিত থাকলেও এ বিশেষ পরীক্ষার ক্ষেত্রে দেখা গেল- বয়সসীমা ৫০ পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে।

জেলা শহরের ভূগোল শিক্ষক সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে বয়স শিথিলের বিধান পড়ে দেখলেন- তার বয়স ৩০ অতিক্রম করে আরো কয়েক মাস গড়িয়ে গেলেও তিনি এ ক্ষেত্রে আবেদন করার যোগ্য। ইতঃপূর্বে নিজ স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় বিশেষ পরিদর্শক হিসেবে আগত ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতার দাপট দেখে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা কার্যক্রম এক মাসব্যাপী ব্যাপৃত হওয়ায় এবং ইতঃপূর্বে তার বয়স ৩০ অতিক্রম করায় ওই চাকরির প্রতি আগ্রহ থাকলেও সময় ও সুযোগের অভাবে তার ওই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যায়।

অতঃপর ভূগোল শিক্ষক আবেদনপত্র দাখিল করে যথারীতি পরীক্ষা দিয়ে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ শুরু করেন। চাকরিজীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে ভূগোল শিক্ষক এখন একটি মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ পদের অব্যবহিত নি¤েœর পদে আসীন। দীর্ঘদিন প্রথম শ্রেণীর পদে চাকরি করে এবং চাকরির সংশ্লেষে বেশ কয়েকবার দেশে ও বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ পাওয়ার পরও তার ইংরেজি জ্ঞানের খুব একটা উন্নতি হয়েছে বলে পরিলক্ষিত হয়নি।

ভূগোল শিক্ষককে যে ছাত্রটি ‘কমিটি’ ও ‘কমন’ শব্দ দু’টির বানান জিজ্ঞাসা করেছিল সে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও চাকরির মাঝপথে উচ্চতর চাকরি কাঠামোর উপসচিব পদে যোগদান করেন। নিকট অতীতে তার শিক্ষকের সাথে তিনি একই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। তখন শিক্ষকের সাথে তার ইউরোপের একটি দেশে এক পক্ষকালব্যাপী প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়। প্রশিক্ষণ গ্রহণের সময় আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের একজন প্রশিক্ষণার্থীর সাথে ভূগোল শিক্ষক ও তার ছাত্রের সখ্য গড়ে ওঠে। পার্শ্ববর্তী দেশের প্রশিক্ষণার্থী ওই দেশের সচিবালয়ের প্রবেশপদে কর্মরত কর্মকর্তা এবং তুলনামূলকভাবে বয়সের দিক থেকে আমাদের ভূগোল শিক্ষক ও তার ছাত্রের চেয়ে নবীন ও তরুণ। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসহ অপর যে ২৫টি দেশের প্রশিক্ষণার্থী ওই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের বেশির ভাগই পদমর্যাদায় ও বয়সের দিক থেকে পার্শ্ববর্তী দেশের কর্মকর্তার অনুরূপ ছিল। অপেক্ষাকৃত নি¤œস্তরের কর্মকর্তাদের জন্য আয়োজিত প্রশিক্ষণে কেন আমাদের দেশের উচ্চস্তরের কর্মকর্তা যোগদান করলেন- এ বিষয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের নবীন কর্মকর্তা জানতে চাইলে আমাদের প্রবীণ কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের প্রশিক্ষণে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নবীন বা প্রবীণ কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিবেচ্য হচ্ছে- তিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীর কতটুকুু আস্থাভাজন।

পার্শ্ববর্তী দেশের নবীন কর্মকর্তা আমাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত মনোনয়ন বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসৃত না হওয়ার কথা শুনে অনেকটা আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলে উঠেন, তার দেশে নীতিমালায় সমর্থিত না হলে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রীর কিছুই করার থাকে না। প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠান চলাকালীন বিভিন্ন আলাপচারিতায় আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের নবীন কর্মকর্তা আমাদের প্রবীণ কর্মকর্তার বিদ্যা ও জ্ঞানের দৌড় কতটুকু গভীর তা অতি সহজেই অনুমান করতে পারলেন। অনুষ্ঠানের শেষ দিন পার্শ্ববর্তী দেশের নবীন কর্মকর্তা আমাদের প্রবীণ কর্মকর্তার ভিজিটিং কার্ড চাইলে তিনি কোট ও প্যান্টের এ পকেট ও পকেট হাতিয়ে দেখলেন তার কাছে কোনো কার্ড অবশিষ্ট নেই। অগত্যা পার্শ্ববর্তী দেশের নবীন কর্মকর্তার অনুরোধে আমাদের প্রবীণ কর্মকর্তা একটি ছোট কাগজে তার নাম ও কর্মস্থলের ঠিকানা লিখে দেন। কর্মস্থলের ঠিকানায় Secretariat বানানটি Secratariate রূপে লেখা হলে পার্শ্ববর্তী দেশের নবীন কর্মকর্তা জানতে চাইলেন আপনারা কি এভাবে Secratariate বানান করে Secretariat শব্দটি লিখেন।

প্রবীণ কর্মকর্তা বললেন, আমাদের দেশে এভাবেই Secratariate বানান লেখা হয়। আমাদের দেশের অপর প্রশিক্ষণার্থী প্রবীণ ভূগোল শিক্ষক কর্মকর্তার ছাত্র ঝবপৎবঃধৎরধঃ বানানটি যে ভুলভাবে লেখা হয়েছে তা তাৎক্ষণিক উপলব্ধি করতে পারলেও তার শিক্ষক ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা লজ্জা পাবেন এবং উপরের স্তরের কর্মকর্তার ভুল ধরার জন্য চাকরির ক্ষতি হতে পারে- এ দু’টি কারণে এ ব্যাপারে তখন নিশ্চুপ ছিলেন। এমনকি প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার পরও ভুল বানান শুধরে দিলে উপরস্থ কর্মকর্তার চেয়ে নিন্মস্থ কর্মকর্তা অধিক জ্ঞানী এ কারণে বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে তিনি কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। কিছু দিন আগে প্রাক্তন ভূগোল শিক্ষকের মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হওয়ার পর ছাত্রটি গল্পছলে তার অন্য সহকর্মীদের বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করে এবং দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ হওয়ার কথা বলে। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছাত্রটির বন্ধুরা সামগ্রিক বিষয়ে অবগত হওয়ার পর বলল, তোমার এ ঘটনাটির চেয়ে আরো বিব্রতকর ও অবমাননাকর হাজারো ঘটনা আছে। এ সব ঘটনা আলোচনা করলে দেখা যাবে আমাদের দেশে সরকারি শীর্ষ পদে আসীন কর্মকর্তারা মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, জ্ঞানের গভীরতা এবং ইংরেজি বলা ও লেখায় আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর আরো দু’-তিন ধাপ নিম্নের কর্মকর্তার নিম্নে অবস্থান করছেন।

আমাদের সরকারে শীর্ষ কার্যালয়ে এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের পুরো প্রশাসন ব্যবস্থা যে ভেঙে পড়বে এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। প্রশাসন যেকোনো দেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চাবিকাঠি হওয়ায় সৎ, দক্ষ, মেধাবী, কর্মঠ ও যোগ্য কর্মকর্তার মূল্যায়নে এর পুনর্গঠন অত্যাবশ্যক, অন্যথায় সামনের পথ অত্যন্ত বন্ধুর।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

 

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/738982