২ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:২৬

ছিনতাইকারীরা অপ্রতিরোধ্য

পবিত্র রমজান মাস। সাধারণ মানুষ সারাদিন রোজা রেখে ইফতার এবং রাতে সাহরির পর হাঁটাহাঁটি করেন, নামাজ পড়তে মসজিদে যাতায়াত করেন। পাড়া-মহল্লায় রাত-বিরাত এবাড়ি-সেবাড়ি যাতায়াত করেন। কিন্তু নির্বিঘেœ চলাচলের উপায় নেই। ছিনতাইকারীর ভয়ে আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। কারণ রাজধানীর ঢাকার খিলগাঁও, মালিবাগ রেলগেট, দৈনিক বাংলা মোড়, পীরজঙ্গি মাজার ক্রসিং, কমলাপুর বটতলা, মতিঝিল কালভার্ট রোড, নাসিরের টেক হাতিরঝিল, শাহবাগ, গুলশান, মিরপুর, গুলবাগ, রাজউক ক্রসিং, ইউবিএল ক্রসিং পল্টন মোড়, গোলাপ শাহর মাজার ক্রসিং, হাইকোর্ট ক্রসিং, আবদুল গণি রোড, উত্তরা, বিমানবন্দর, মানিকনগর স্টেডিয়ামের সামনে, নন্দীপাড়া ব্রিজ, বাসাবো ক্রসিং এলাকাসহ প্রায় অর্ধশতাধিক স্পটে ছিনতাইয়ের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব এলাকায় সন্ধ্যা নামতেই ছিনতাই তথা অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়াও যানহাবনে অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ও টানা পার্টির ভয়তো রয়েছেই। সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে মোবাইল ফোন নিয়ে ভোঁ দৌড়, যাত্রীদের চোখে-মুখে মলম, মরিচের গুঁড়া স্প্রে করেও সবকিছু হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছেই। রমজান উপলক্ষে ঢাকা মহানগরের ছিনতাই ঠেকানো এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ছিনতাইকারীদের দৌড়াত্ম্য কমছে না।

জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হাফিজ আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, অনেক সময় আমরা চুরি, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের তথ্য জানতে পারি না। ছিনতাইকারী বা ডাকাতি যাই বলেন না কেনো, তারা গ্রেফতার হয়ে জেলে যায় আবার বের হয়ে কাজ করে। এসব অভিযোগ থানায় জানাতে অনুরোধ করছি।

তবে সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, যখন মানুষের অর্থনৈতিক অনটন চরম পর্যায়ে পৌঁছায় তখন মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। মানুষ তখন যেকোনোভাবে যেকোনো মূল্যে তার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো মেটাবে। আর যেকোনো মূল্যের একটা উদাহরণ হচ্ছে ছিনতাই। ছিনতাইকারীরা ধরাও পড়ছে আবার জেলেও যাচ্ছে। কিন্তু কারাগারে তাদের প্রোপারলি রিহেবিলিটেশন করানো হচ্ছে না। তাই এরা বের হয়ে আবারো ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে। এদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মধ্যে রাখার কোনা সিস্টেম নেই।

গত বুধবার রাত ৮টায় মতিঝিল থেকে রিকশায় শাহজাহানপুরের বাসায় ফিরে ছিলেন বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা হামিদুল ইসলাম। নটরডেম কলেজের সামনে যাওয়ার পর ফোন আসায় পকেট থেকে দামি মোবাইল সেটটি বের করে কথা বলছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে ছিনতাইকারী দলের এক সদস্য মোবাইল ফোনটি নিয়ে দ্রুত দৌড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় হামিদুল ইসলাম রিকশা থেকে নেমে দৌড়ে ওই ছিনতাইকারীকে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তিনি দ্রুত ফিরে আসেন নটরডেম কলেজেন সামনে। সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের কাছে অভিযোগ জানালে তারা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন এবং হেসে উড়িয়ে দেন। এক পর্যায়ে দামি মোবাইল ফোন হারানোর ব্যাথা নিয়েই বাসায় ফেরেন তিনি।

গত ১৯ মার্চ রাত ১০টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-ডেমরা সড়ক। ফ্লাইওভার পার হতেই কয়েকজন তরুণ একটি মোটরসাইকেল থামান। এরপর গলায় ছুরি ধরে নগদ ২০ হাজার টাকা ও দু’টি মোবাইল নিয়ে চলে যায়। এ ঘটনায় আজহার উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি যাত্রাবাড়ী থানায় একটি জিডি করেন।

আজহার উদ্দিন ও হামিদুল ইসলামের মতো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। কখনও হাঁটা পথে, কখনোবা বাসের জানালা দিয়ে কেড়ে নেয়া হচ্ছে তাদের জিনিসপত্র। এছাড়া সাধারণ মানুষ রিকশায় যাতায়াতের সময় মোটরসাইকেল থেকে ছোঁ মেরে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ও জিনিসপত্রসহ ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে ছিনতাইকারীরা। কিন্তু পুলিশের খাতায় এসব ঘটনা নথিভুক্ত হচ্ছে সাধারণ ডায়েরি হিসেবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত ছিনতাই বা দস্যুতার মামলা পুলিশ নিতে চায় না। ছিনতাই বা দস্যুতা মামলার সংখ্যা বেশি হলে এলাকার আইনশৃঙ্খলার অবনতি ধরা হয় বলে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তারা ভুক্তভোগীদের জিডি করতে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে সর্বশেষ ডিএমপি মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় থানার ওসিদের সব ধরনের মামলা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। একইসঙ্গে ছিনতাই ঠেকাতে রাতে টহল বৃদ্ধি করতে বলেছেন তিনি। রাতের টহলে কেউ গাফিলতি করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন।

গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা কামরুল হাসানের। তিনি বলেন, শুধু ছিনতাইকারী নয় অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ও টানা পার্টির সদস্যরা সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যাত্রীদের চোখে, মুখে মলম, মরিচের গুঁড়া স্প্রে করেও সবকিছু হাতিয়ে নিচ্ছে। ব্যস্ততম এই শহরে প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রী-পথচারী, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ও ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। সরকারের একজন মন্ত্রীসহ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিও রাজপথে ছিনতাইকারী, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ও টানা পার্টির সদস্যদের হাতে মোবাইল ফোনসহ নানা মুল্যবান জিনিস খোয়াচ্ছেন। কিন্তু এর পরেও এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষ করে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা বেশিভাগ সময় ঝামেলা এড়াতে থানা-পুলিশে অভিযোগ দিতে চান না। আর যেসব ঘটনা বেশি আলোচিত হয়, শুধু সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে দেখা যায় তারাও কিছুদিন পরে জামিনে বের হয়ে আবার একই কাজে জড়ায়। ছিনতাইকারীদের প্রতিরোধ করতে হলে তাদের সঠিকভাবে পুনর্বাসন ও এলাকায় এলাকায় কমিউনিটি পুলিশিং শক্ত করা দরকার।

র‌্যাবের তথ্য মতে, রাজধানীর খিলগাঁও, মালিবাগ রেলগেট, দৈনিক বাংলা মোড়, পীরজঙ্গি মাজার ক্রসিং, কমলাপুর বটতলা, মতিঝিল কালভার্ট রোড, নাসিরের টেক হাতিরঝিল, শাহবাগ, গুলশান, মিরপুর, গুলবাগ, রাজউক ক্রসিং, ইউবিএল ক্রসিং পল্টন মোড়, গোলাপ শাহর মাজার ক্রসিং, হাইকোর্ট ক্রসিং, আবদুল গণি রোড, উত্তরা, বিমানবন্দ, মানিকনগর স্টেডিয়ামের সামনে, নন্দীপাড়া ব্রিজ, বাসাবো ক্রসিং এলাকায় ছিনতাইকারীরা বেশি তৎপর থাকে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় একাধিক মোটরসাইকেল পার্টি ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে। তাদের কাছে মাঝে মধ্যে মোটরসাইকেল পার্টির ছিনতাইয়ের অভিযোগ আসছে। কিন্তু মোটরসাইকেল পার্টির সদস্যরা কোনো ধরনের অস্ত্র বহন করে না বা সাধারণ যাত্রীদের মতো চলাফেরা করার কারণে আগে থেকেই তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তবে তারা বেশ কয়েকটি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছেন, তাদের ধরতে নজরদারি চালানো হচ্ছে।

তারা আরো বলেন, রাজধানীতে মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে ছিনতাই বেড়েছে। এছাড়া ছিনতাইকারীদের ধরে কারাগারে পাঠানো হলেও কয়েকদিনের মধ্যে জামিনে বেরিয়ে আবারও আগের পেশায় ফিরে যাচ্ছে। এসব কারণে ছিনতাই বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবুও ছিনতাইকারীদের ঠেকাতে গোয়েন্দারা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন।

গত বৃহস্পতিবার ১৭ মার্চ গাজীপুর-শনির আখড়া রুটে চলাচলকারী অনাবিল পরিবহনের একটি বাসে অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়েন এক যাত্রী। সম্ভবত ওই যাত্রী ঢাকায় মালামাল কিনতে আসছিলেন। পরে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখনও তার পরিচয় মেলেনি। এ বিষয়ে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। গত ১৯ মার্চ মরিয়ম রহমান নামে এক নারী মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আগারগাঁও শিশু হাসপাতালের সামনে ওষুধ কিনে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল মিরপুর-২-এর দিকে যাচ্ছিলেন। পথে তিনজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি (বয়স-২৫-৩০ বছর) গল্পের ছলে চেতনানাশক দ্রব্য দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে গলায় ও কানে থাকা দেড় ভরি ওজনের স্বর্ণের একটি চেন, দুইটি কানের দুল, ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা নগদ ৬ হাজার টাকা, একটি অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন ও একটি বাটন মোবাইল ফোন নিয়ে চলে যায়।

গত ১৯ মার্চ দিবাগত রাত ৮টা। রাজধানীর দয়াগঞ্জ মোড় থেকে জুরাইনের দিকে যেতে রেলগেট। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ তিনজন লোক এসে একটি রিকশাকে ঘিরে ধরে। এরপর তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা নিয়ে দৌড় দেয় তারা। পরে রিকশায় থাকা লোকটি চিৎকার শুরু করলে আশেপাশের লোকজন গিয়ে জানতে পারে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন তিনি। গত ২০ মার্চ ভোরে রাজধানীর উত্তরা তুরাগ এলাকায় একটি মালবাহী পিকআপ ভ্যানকে থামিয়ে কয়েকজন যুবক ছুরি ধরে নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়েছেন। মালবাহী ওই পিকআপ ভ্যানের চালক রহিম উদ্দিন এ তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান, নাটোর থেকে সবজি নিয়ে রাজধানীর আব্দুল্লাহপুরে পাইকারি বাজারে আসছিলেন তিনি। গন্তব্যস্থলে পৌঁছার আগেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন।

https://dailyinqilab.com/national/article/566215