২ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:১১

তীব্র গ্যাস সংকট ॥ চরম ভোগান্তিতে রোজাদার

রমযান মাসের প্রথম দিন থেকেই রাজধানীর অনেক এলাকায় গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সেহরি বা ইফতারী তৈরির সময় থাকছে না গ্যাস। শুধু রাজধানী নয় আবাসিক গ্যাস সংযোগ রয়েছে এমন জেলাগুলোতে বেড়েছে সংকট। ফলে ইফতার তৈরিসহ রান্নার কাজে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রাজধানীর কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের। গতবছরে এই সময়েও একই চিত্র ছিল। প্রতিবছর রমযানে গ্যাস সঙ্কটের কারণে অনেক এলাকায় জ্বলে না চুলা। ফলে বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে ইফতার বা সেহরি সামগ্রী কিনে খেতে হয় তাদের। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সারাদিন সিয়াম-সাধনা শেষে ইফতারের অপেক্ষা করেন রোজাদারেরা। কিন্তু গ্যাসের অভাবে রাস্তার পাশের ফুটপাতের দোকান থেকে অস্বাস্থ্যকর ইফতার কিনতে হচ্ছে ঢাকাবাসীর। এছাড়াও গ্যাস সংকটে বাধ্য হয়ে অনেকে হোটেলের খাবার খেয়ে রোজা রাখছেন। তিতাস যে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, তা তারা রাখতে পারে নাই।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ পবিত্র রমযান মাসেও গ্যাসের দেখা নেই। মাঝে মাঝে গ্যাস আসলেও কম চাপের কারণে রান্না করা সম্ভব হয় না। সরকার রমযান মাসে রান্নার সময়ে যদি ঠিকমতো গ্যাস সরবরাহ করতো, তাহলে মানুষ ইফতার-সেহরি বাসায় তৈরি করে খেতে পারতেন। রাজধানীর টিকাটুলি, মালিবাগ, মগবাজার, আজিমপুর, লালবাগ, ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, মতিঝিল, সেগুনবাগিচা, মানিকনগর, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, শনিরআখড়া, ওয়ারিসহ পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রমযানের প্রথম দিন থেকেই তারা গ্যাস সংকটে পড়েছেন। যার কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের।

উত্তর যাত্রাবাড়ী এলাকার জেসমিন আক্তার বলেন, বছর ধরেই গ্যাসের সঙ্কট থাকে। চুলায় গ্যাস একসময় থাকলে, অন্য সময় থাকে না। ১ম রোজা থেকে ৮ম রোজার মধ্যে দিনের বেলায় বেশিরভাগই চুলায় গ্যাস ছিলো না। এরপর রাতে আসে কিন্তু গ্যাসের কোনো চাপ ছিলো না। এরপর থেকেই গ্যাসের সমস্যা দিচ্ছে। গ্যাসের সমস্যায় রান্না করতে পারছি না। একই কথা বলেন ধলপুর এলাকার শেফালি বেগম। তিনি বলেন, ১ম রোজা থেকেই চুলায় গ্যাস থাকছে না। রমযান মাসে বাসাবাড়িতে বিকাল বেলা আর ভোর বেলায় গ্যাসের দরকার হয়। কিন্তু এই সময়েই গ্যাস পাচ্ছি না। আবার থাকলেও গ্যাসের চাপ থাকে না। উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে ইফতারি কিনে আনতে হচ্ছে। এখন কলেরার প্রকোপ বেড়েছে, এ অবস্থায় বাইরে থেকে খাবার কিনে খাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ।

বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ধানমন্ডি জিগাতলাসহ বেশ কিছু এলাকায় গ্যাসের সংকট চলছে। এবিষয়ে তারা আমাদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানের জন্যে তিতাস কর্তৃপক্ষ যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আর কী করার আছে! এখানে গ্যাসের সিস্টেম লসের নামে তিতাস যদি চুরিটা বন্ধ করতে পারতো, তাহলেও এই সংকট এতো তীব্র হতো না।

তিতাস মেট্রো দক্ষিণের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) প্রকৌশলী সামসুদ্দিন আল আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের মধ্যে গ্যাপ (পার্থক্য) থাকার কারণে আগের থেকে সিস্টেমে একটু সমস্যা ছিলো। তারপর কিছু গ্যাস অবৈধভাবে ব্যবহার হওয়ার কারণে আগের থেকে প্রেশারও কম ছিল। এছাড়াও রমযান মাসে ইফতারিসহ অন্যান্য কাজে বেশি গ্যাস ব্যবহার হওয়ার কারণে গ্যাসের চাপ কমতে পারে। তবে আশার কথা হলো, সামনে গ্যাস আমদানি হবে এবং তখন গ্রাহকরা বেশি মাত্রায় গ্যাস পাবে। তবে রমযান মাসে গ্যাস সংকট সমাধানের জন্য কী পদক্ষেপ রয়েছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ সমস্যা সমাধানে এই মহূর্তে গ্যাসের ব্যবহার সীমিত করে চালাতে হবে। রমযানের কারণে আপাতত অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযানও বন্ধ রাখা হয়েছে।

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ'র (ক্যাব) সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন বলেন, এ বিষয়ে তিতাস কর্তৃপক্ষের বক্তব্য খুবই দুঃখজনক। কারণ গ্রাহকের যতটুকু (গ্যাস) প্রয়োজন, তারা ততটুকুই ব্যবহার করে। আর বিগত বছরগুলোতেও দেখা গেছে, রমযান মাসে রান্নার সময় গ্যাস থাকে না। কিন্তু অন্য সময়েতো সব সময়ই রান্না চলে। তার চেয়ে রমযান মাসে কম রান্না হয়। এখানে বিতরণ সংস্থাটির ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থাকার কারণে এই সংকট বলে মনে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, তিতাস আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলো, রমযানে গ্যাসের কোন ক্রাইসিস হবে না। কিন্তু রমযানের ১ম দিন থেকেই যেহেতু গ্যাসের সংকট চলছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে- তারা যে আশ্বাস দিয়েছিলো তা কথার কথা। তাই আমরা মনে করি, তারা দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান করবে।

এদিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) বেঁধে দেয়া দরে বিক্রি হচ্ছে না বোতলের গ্যাস (এলপিজি)। চলতি মাসের জন্য ১২ কেজির এলপি গ্যাসের দাম ১ হাজার ২৩২ টাকা নির্ধারণ করে সরকারের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাটি, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ১ হাজার ২৯৭ টাকা। কিন্তু সরকারের বেঁধে দেয়া এ দামে গ্যাস পাচ্ছে না গ্রাহকরা। প্রকৃত দামের চেয়ে বোতল প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে তাদের। যার ফলে, এলপিজি ব্যবহারকারীদেরও ভোগান্তির শেষ নেই ।

এদিকে চলতি মাসে দৈনিক ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। তারপরও আবাসিকে গ্যাস সংকট কাটছে না। ফলে রমজানে রান্নার কাজে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে ইফতারের সময় চরম বিরক্তিকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ গৃহিনীদের।

এসব এলাকার বাসিন্দা বলছেন- রমযানে সেহরি ও ইফতারে রান্নার কাজে প্রয়োজনীয় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে ইফতারের সময় সামান্য আঁচে রান্না করতে হয়। ফলে ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলেও রান্না শেষ হয় না। যার কারণে ইফতারে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য বাইরে থেকেই কিনে আনতে হচ্ছে। বায়েরবাগের বাসিন্দা কনিকা বলেন- ‘আমার এখানে গ্যাসের অনেক সমস্যা হচ্ছে। দুপুরের পর গ্যাস চলে যায়, আসে ইফতারের পর। ইফতার বানাতে পারিনি গত কয়েকদিন। কিনে এনে ইফতার করতেছি।’

সায়েদাবাদের ছালেহা আক্তার বলেন, ‘বিকালে গ্যাস থাকে নামে। ইনডাকশন চুলায় রান্না করছি দুই রোজা। মাগরিবের পরপরই আবার গ্যাস চলে আসে।’

লালমাটিয়ার বাসিন্দা কবির আহমেদ রবি জানান, ‘প্রায় এক মাস ধরেই দুপুরের পরে প্রায়ই গ্যাস থাকে না। তাই রোজার আগে আগে সিলিন্ডার কিনেছি। এখন দুপুরে গ্যাস যায় আসে ইফতারের পরে। সিলিন্ডারের চুলায় ইফতারের ব্যবস্থা করছি।’
গত সোমবার গ্রিডে সরবরাহ ছিল ২ হাজার ৮৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট। লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রায় ২৫২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি প্রয়োজন। তবে গত সপ্তাহে সরবরাহ আরও ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট বেশি ছিল। কিন্তু এরপরও রান্নাঘরে স্বল্প আঁচের অভিযোগ তুলেছেন গৃহিনীরা। কিন্তু তিতাসের কোনও কর্মকর্তাই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে নারাজ।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার সাংবাদিকদের বলেন, গ্রীষ্ম মোকাবিলায় এলএনজির সরবরাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে পেট্রোবাংলা। আগামী জুন অবধি প্রতি দিন গ্রিডে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হবে।

https://dailysangram.com/post/521000