১ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ১০:৪৯

ডলারের বাড়তি দাম ভোগাচ্ছে ক্রেতাদের

ডলার সংকটের কারণে এবার দেশীয় পোশাকেও বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়তি দামে পোশাক কিনতে হচ্ছে ক্রেতােেদর। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে বাচ্চাদের পোশাকে। তবে দেশের বাজারে ভারতীয়সহ বিদেশী ব্র্যান্ডের দাপট অনেকটা কমেছে। বর্তমানে বাজারের বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর কাপড় ও ডিজাইন দেশী-বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে। ঈদকে সামনে রেখে এবারও আকর্ষণীয় ও নজরকাড়া পোশাক নিয়ে প্রস্তুত দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো। এদিকে গত বছরগুলোর তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় ঈদের কেনাকাটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অনেক ক্রেতা। তারা বলছেন, গত এক বছরে যেভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, সেভাবে আয় বাড়েনি। মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তদের জন্য এবারের ঈদ মোটেও স্বস্তির হবে না। এছাড়াও ডলারের বাড়তি দাম ভোগাচ্ছে ক্রেতাদের।

ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে রাজধানীর পুরান ঢাকার ইসলামপুরে দেশের বৃহত্তর কাপড়ের পাইকারি বাজারে বইছে বেচাকেনার ধুম। সালোয়ার কামিজ, থ্রি পিস, পাঞ্জাবি, শাড়ি, লুঙ্গি ও বোরকার নানান ডিজাইনের কাপড় পাওয়া যায় এখানে। রয়েছে দেশী-বিদেশী খ্যাত-অখ্যাত ব্র্যান্ডের কাপড়ও। তাই ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ইসলামপুর এখন জমজমাট। এখানকার দোকানগুলোতে রয়েছে ছাপা শাড়ি, কম্পিউটারে ডিজাইন করা শাড়ি, হাতে রঙ করা শাড়ি, বোরকা, লুঙ্গি ও পাঞ্জাবিসহ নানান ডিজাইনের থ্রি পিস। ইসলামপুরে পোশাকের দোকানগুলোতে মান ও কাজ ভেদে ৬৫০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকায় মিলছে দেশী থ্রি পিস। সেলাই ছাড়া থ্রি পিস মিলছে ৬০০ থেকে ১৮০০ টাকায়। নানা কারুকাজ ও বাহারি রঙের পাঞ্জাবি নেওয়া হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৪৫০০ টাকা পর্যন্ত। ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছে নিবন্ধন করা প্রায় সাড়ে চার হাজার দোকানসহ অনিবন্ধিত আরও তিন হাজার দোকানে প্রতিদিন প্রায় ৫০ কোটি টাকার বাণিজ্য চলে এখানে। কিন্তু ঈদকে ঘিরে তা শত কোটি টাকায় রূপ নেয় বলে জানান এখানকার ব্যবসায়ীরা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) টং মার্কেট, হাজি শরফুদ্দিন ম্যানশন, হাজি ইউসুফ ম্যানশন, আমানউল্লাহ কমপ্লেক্স, হাজি কে হাবিবুল্লাহ কমপ্লেক্স মার্কেট, লতিফ টাওয়ার, আহসান মঞ্জিল (মিউ.) সুপার মার্কেট, এ মাবুদ রাইন টাওয়ার, লায়ন টাওয়ার, মদিনা ভবন, হাজি শামসুদ্দিন ম্যানশন, ২৪ নম্বর মসজিদ মার্কেট নুরজাহান ম্যানশন, হালিম প্লাজা ও সোনার বাংলা মার্কেটসহ আশপাশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি দোকান বাহারি পোশাকে সুসজ্জিত। দোকানগুলোতে দারুণ বেচাকেনা চলছে। মোড়ে মোড়ে চলছে মালপত্র ওঠানো-নামানোর কাজ।

তবে বিক্রি নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ বললেন, এবার বিক্রি ভালো, তবে মোটা দাগে নয়। আবার কেউ বললেন, সন্তোষজনক নয়। দেশী-বিদেশী কাপড়ের দামের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা বলেন, এবার দেশী-বিদেশী উভয় কাপড়ের বাজার দর গত বছরের তুলনায় ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেশি। কাপড়ের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ও এলসি খুলতে না পারার কারণেই এবারের কাপড়ের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। টেক্সটাইল ওয়্যান্স উইমেন্সের ম্যানেজার রবিন জানান, এ বছর ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে ভারত ও চীনের কাপড়ের দাম অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ, কাপড়ের রঙের দাম বাড়ার কারণে দেশী কাপড়ের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। তাই প্রতিটি কাপড়ের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। কাপড়ের দাম বৃদ্ধি পেলেও এ বছর বিক্রি মোটামুটি ভালো। আশা করি আগামী ২০ রমযান পর্যন্ত আমাদের বেচাকেনা ভালো চলবে।

পোশাক তৈরির সঙ্গে যুক্তরা জানান, বাচ্চাদের পোশাক তৈরির অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এবার ডলার সংকট ও বাড়তি দামের কারণে খরচ বেড়েছে। এটা মেনেই ক্রেতারা যেন শপিং করতে আসেন এমন পরামর্শ তাদের। এদিকে, এবার ঈদের পোশাকে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আবহ। পাশাপাশি সময়, প্রকৃতি ও আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আড়ং, অঞ্জন’স, ইনফিনিটি কিংবা সেইলর-এর মতো দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো ঈদের বাজারে দেশীর সংস্কৃতি, আবহকে প্রাধান্য দিয়েছে। এসব ব্র্যান্ডের পণ্য কিনতে যেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্রেতারা, তেমনি বিস্তর অভিযোগ রয়েছে দাম ও মান নিয়েও।
ক্রেতাদের অভিযোগ, দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো সাধারণ মানের কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাকের দাম অনেক বেশি চাচ্ছে। শুধু শুধু পণ্যের গায়ে বেশি দাম লিখে রাখছে। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে এক শ্রেণির ক্রেতাদের নাগালে বাইরে থেকে যাচ্ছে দেশীয় ফ্যাশন হাউজের পণ্য

বসুন্ধরা শপিং মলে লালবাগ থেকে ঈদের পোশাক কিনতে আসা সুমাইয়া বেগম জানান, বিদেশী ব্র্যান্ডের পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই বলে দেশীয় বুটিক হাউজে এসেছি। এখানে এসেও দেখি দাম বাড়তি। গত বছর বাচ্চার যে পোশাক ৭৫০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম, সেটি এবার ৯০০ টাকার বেশি চাওয়া হচ্ছে। শুধু বাচ্চা নয়, পাঞ্জাবি, শার্ট ও শাড়ির দামও বাড়তি। ক্রেতাদের অভিযোগ, দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো সাধারণ মানের কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাকের দাম অনেক বেশি চাচ্ছে। শুধু শুধু পণ্যের গায়ে বেশি দাম লিখে রাখছে। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে এক শ্রেণির ক্রেতাদের নাগালে বাইরে থেকে যাচ্ছে দেশীয় ফ্যাশন হাউজের পণ্য।

আড়ং-এর সেলসম্যান আশরাফুল আলম জানান, ঈদ বা যেকোনো উৎসবে আড়ং দাম বাড়ায় না। বরং নানা ধরনের ছাড় দেওয়া হয়। আমাদের দাম নির্ধারণ সিস্টেম খুবই পরিচ্ছন্ন। কোন পোশাকে কী কাপড় এবং কোন ধরনের নকশা করা হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে দাম নির্ধারণ করা হয়। যেমন- কাপড়ের কাজে এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট কিংবা কী ধরনের হাতের কাজ যোগ হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে পোশাক বা পণ্যের চূড়ান্ত দাম নির্ধারণ হচ্ছে। এরপর ফিক্সড মার্কার সিস্টেম অনুসরণ করা হয়। ফলে দেশের যেকোনো আউটলেটে একই দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। পরিপূর্ণ অটোমেটেড সিস্টেম অনুসরণ করতে হয় আমাদের। আমরা চাইলেও দাম কমাতে কিংবা বাড়াতে পারি না। ফলে অতিরিক্ত দাম নেওয়ার সুযোগ নেই।

ফ্যাশন এন্টারপ্রেনিউর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও অঞ্জন’স-এর স্বত্বাধিকারী মো. শাহীন আহমেদ জানান, এবার ঈদে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর দাম তেমন বাড়েনি। তবে, এসব পোশাক তৈরিতে বোতামসহ কিছু কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। ডলার সংকটের কারণে এসব জিনিসের দাম বেড়েছে। তারপরও ক্রেতাদের বিষয় মাথায় রেখে সেভাবে দাম বাড়ানো হয়নি।

বাংলাদেশের আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে আরামদায়ক কাপড় যেমন- সুতি, সিল্ক, লিনেন,কাতান, জ্যাকার্ড কাপড়ের চাহিদা বেশি থাকে। ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এবারের ঈদে এসব কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করা হয়েছে। দেশীয় বুটিক হাউসগুলো বিশ্বরঙ, আর্টিসেল, লা রিভ, কে-ক্র্যাফট, নিত্য উপহার, বাংলার মেলা, সাদাকালো, বিবিয়ানা, লোকজ, মেঘ, বাঙ্গাল, মেঠোপথ, ক্যানভাস, ফেরিওয়ালা, আইডিয়াস, গাঁওগেরাম, ফোর ডাইমেনশনসহ বেশকিছু বুটিক হাউস ঈদের পোশাক বাজারে এনেছে।

সাদাকালো ফ্যাশন হাউজে শিশু, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সের পোশাক পাওয়া যাচ্ছে। ছোটদের পাঞ্জাবি ৪০০ থেকে ৯০০ টাকায়, ফতুয়া ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকায়, কুর্তা ৬২০ থেকে ২৬২০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। পাঞ্জাবির দাম রাখা হচ্ছে ৫৮০ থেকে নয় হাজার টাকার মধ্যে। মেয়েদের থ্রি পিস মিলছে ১২০০ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায়। সাদাকালোর শাড়ির দাম রাখা হচ্ছে এক হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে।

অঞ্জন’স ফ্যাশন হাউজে ছোটদের পাঞ্জাবির দাম ৭০০ থেকে ১৭০০ টাকা, বিয়ের শেরওয়ানি নয় হাজার টাকায়, সাধারণ পাঞ্জাবি ৯৫০ থেকে পাঁচ হাজার ৬৯০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কটনের থ্রি পিসের দাম দেড় হাজার থেকে আট হাজার ৯০০ টাকা এবং শাড়ি ৭৫০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ক্রেতাদের অভিযোগ, দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো সাধারণ মানের কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাকের দাম অনেক বেশি চাচ্ছে। শুধু শুধু পণ্যের গায়ে বেশি দাম লিখে রাখছে। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে এক শ্রেণির ক্রেতাদের নাগালে বাইরে থেকে যাচ্ছে দেশীয় ফ্যাশন হাউজের পণ্য।

ফ্যাশন হাউজের ম্যানেজাররা বলছেন, ফ্যাশন হাউজগুলেতে শেরওয়ানি, কটি, স্মার্ট ক্যাজুয়াল শার্ট, এথনিক শার্ট, ফতুয়া ও পোলো শার্ট; মেয়ে শিশুদের জন্য উৎসবভিত্তিক সালোয়ার, কামিজ, ফ্রক, কুর্তি, টপস, পাফি পার্টি ড্রেস, লেহেঙ্গা সেট এবং ছেলে শিশুদের জন্য পাঞ্জাবি, শার্ট, কটি, শেরওয়ানিসহ থাকছে বাহারি পোশাক। এসব পোশাকে প্যাটার্ন, ফেব্রিক ও রঙের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, ঈদ উপলক্ষে এখনও বেচাকেনা জমে ওঠেনি। তবে মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের উপস্থিতি একটু একটু করে বাড়ছে। তাই নতুন পোশাকের পসরা সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় আছেন তারা। ব্যবসায়ীদের দাবি, ১৫ থেকে ২০ রোজার পরই ক্রেতাদের উপস্থিতি বাড়বে। সেজন্য প্রতিদিনই নতুন নতুন পোশাক দোকানে সাজানো হচ্ছে। মিরপুর-১ নম্বরের নিউ মার্কেট, মিরপুর শপিং সেন্টার, মুক্তিযোদ্ধা শপিং কমপ্লেক্স, সনি সিনেমা হল শপিং মল, মিরপুর-১ নম্বরের কান্ট্রি বয় ও ইয়েলো, মিরপুর-১০ নম্বরের শাহ আলী মার্কেট, মিরপুর-১১ নম্বরের বিভিন্ন মার্কেট এবং মিরপুর-১২ নম্বরের প্রিন্স বাজারসহ ভাসমান মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, ঈদ উপলক্ষ্যে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর তুলনায় ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার মার্কেটগুলোতে লোকজনের কিছুটা সমাগম হচ্ছে। তবে বেচাকেনা জমেনি। শপিং মলগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড় সেভাবে বাড়েনি।

মিরপুর-১১ নম্বরের একটি মার্কেটের ব্যবসায়ী আবদুল খালেক জানানন, আমাদের খোলা মার্কেটের ব্যবসা একটু একটু করে জমে উঠেছে। নারী-পুরুষসহ ছোটদের পোশাক বিক্রি হচ্ছে। ২০ রোজার পর থেকে ক্রেতার ভিড় আরো বাড়বে। ছোটদের ও বড়দের পাঞ্জাবি, নারীদের থ্রি পিচ এবং শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। মৌচাক মার্কেটে আসলাম নামের এক ক্রেতা জানান, ঈদে মার্কেটে চাপ বাড়তে পারে। এজন্য পরিবারের সদস্যদের জন্য আগেভাগে কেনাকাটা করে ফেলছি। বড় বড় শপিং সেন্টার থেকে এবার কেনা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, গত বছরের তুলনায় পরিবারের দৈনন্দিন খরচ অনেক বেড়েছে। কিন্তু বেতন এক টাকাও বাড়েনি। এজন্য এখান থেকে কেনাকাটা করছি।

 

https://dailysangram.com/post/520905