২৯ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৩:৩৭

বাংলাদেশে অকালমৃত্যুর ২০ শতাংশ বায়ুদূষণে

বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বায়ু দূষণ যে ১০টি শহরে তার ৯টি দক্ষিণ এশিয়ায়। ঢাকা তার মধ্যে একটি। বাংলাদেশে অকাল মৃত্যুর প্রায় ২০ শতাংশের জন্য দায়ী বায়ুদূষণ বলে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায়, এটি প্রতি বছর আনুমানিক ২০ লাখ লোকের অকাল মৃত্যু ঘটায় এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক খরচের জন্য এই বায়ুদূষণ দায়ী। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই অঞ্চলে পরিষ্কার বায়ু অর্জনের জন্য অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাব্য, ব্যয়-কার্যকর সমাধান রয়েছে। তবে এর জন্য দেশগুলোকে নীতি এবং বিনিয়োগের সমন্বয় করতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এশীয় অঞ্চল সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং দরিদ্র অঞ্চলে কিছু সূক্ষ্ম কণা যেমন কাচ এবং ছোট ধূলিকণার ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান থেকে ২০ গুণ বেশি। এই ধরনের চরম বায়ুদূষণের সংস্পর্শে শিশুদের মধ্যে স্টান্টিং এবং হ্রাসকৃত জ্ঞানীয় বিকাশ থেকে শুরু করে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, দীর্ঘস্থায়ী রোগ হচ্ছে। এটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়কে চালিত করে। পাশাপাশি একটি দেশের উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং কাজের দিন নষ্ট করে।

রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকাশ করা এই গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গীকার দরকার বলে মন্তব্য করা হয়।

বাংলাদেশ ও ভুটানের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে শেক বলেন, বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর এর বড় প্রভাব রয়েছে। অঙ্গীকার, সঠিক পদক্ষেপ এবং নীতির মাধ্যমে বায়ুদূষণ মোকাবেলা করা সম্ভব। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার অনুমোদনসহ বায়ুর মান ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। শক্তিশালী জাতীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি, বায়ুদূষণ রোধে আন্তঃসীমান্ত সমাধান গুরুত্বপূর্ণ হবে। বিশ্লেষণমূলক কাজ এবং নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে বায়ুদূষণ কমাতে সাহায্য করছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, বায়ুদূষণ জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে দীর্ঘ দূরত্ব ভ্রমণ করে। জলবায়ুবিদ্যা এবং ভূগোল দ্বারা আকৃতির বড় ‘এয়ারশেডে’ আটকা পড়ে। প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি প্রধান এয়ারশেড চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে বাতাসের গুণমানে স্থানিক আন্তঃনির্ভরতা বেশি। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তান, ইন্দো গাঙ্গেয় সমভূমিতে বিস্তৃত একটি সাধারণ এয়ারশেড শেয়ার করে। প্রতিটি এয়ারশেডের কণা বিভিন্ন উৎস এবং অবস্থান থেকে আসে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা, কাঠমান্ডু এবং কলম্বোর মতো অনেক শহরে, শুধু এক-তৃতীয়াংশ বায়ুদূষণ শহরের মধ্যে উৎপন্ন হয়। বায়ুদূষণের আন্তঃসীমান্ত প্রকৃতিকে স্বীকৃতি দিয়ে, চারটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ-বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তান- প্রথমবারের মতো ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি এবং হিমালয়ের পাদদেশে বায়ুর গুণমান উন্নত করার জন্য কাঠমান্ডু রোডম্যাপ তৈরি করতে সম্মত হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের পরিচালক সিসিলি ফ্রুম্যান বলেন, বায়ুদূষণ একটি শহর, রাজ্য বা জাতীয় সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি প্রকৃতির আন্তঃসীমান্ত। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো একই এয়ারশেড-সাধারণ ভৌগোলিক এলাকা যেগুলো একই বায়ুর গুণমান ভাগ করে- তারা যদি সমন্বিত পন্থা অবলম্বন করে তবেই বায়ুদূষণের উদ্বেগজনক মাত্রা কমাতে পারে। এক সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে দেশগুলো আরো ভালো, দ্রুত এবং সস্তা ফলাফল পেতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের ওপর দিয়ে একই মেঘমালা উড়ে যাচ্ছে। ওই মেঘের মধ্যে দূষিত বায়ু গিয়েও আশ্রয় নিচ্ছে, যা এই দেশগুলোতে দূষিত বায়ু ছড়িয়ে দিচ্ছে। নিজ দেশের ভেতরের দূষিত বায়ুর পাশাপাশি অন্য দেশগুলো থেকে আসা বায়ুর কারণে মানুষ নানা রোগবালাই ও কষ্টে ভুগছে।

যেমন ঢাকা শহরের দূষিত বায়ুর ৩০ শতাংশ আসে পাশের দেশ ভারত থেকে। ফলে বায়ুদূষণ রোধে দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বাড়াতে হবে। নিজ দেশের ভেতরের বায়ুদূষণের উৎস বন্ধেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গীকার দরকার।
‘নির্মল বায়ুর জন্য চেষ্টা : দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে এখানকার শহরগুলোর বায়ু ৬ থেকে ২৫ গুণ মান খারাপ। ঢাকা ওই দূষিত শহরের মধ্যে অন্যতম শীর্ষে। আর ঢাকার দূষিত বায়ুর ৩০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তবে ঢাকার বাইরের শহরগুলো থেকেও ৪০ শতাংশ দূষিত বায়ু প্রবাহিত হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে।

স্থপতি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হচ্ছে এখন নির্মাণকাজ। সরকার আইন করে পোড়ানো ইট পর্যায়ক্রমে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। ব্লক ইট ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই এখন পর্যন্ত তা ব্যবহার করছে না; বরং সরকারি প্রকল্পগুলো বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে। ফলে সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ইয়েন জু ই-এর সঞ্চালনায় সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা বায়ুদূষণ বিষয়ে বক্তব্য দেন।

পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক আবদুল হামিদ বলেন, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করে পরিবেশ অধিদফতর বায়ুদূষণ রোধে কাজ করছে। দেশের ভেতরের বায়ুদূষণের উৎসগুলো বন্ধে এরই মধ্যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে। অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা এবং কালো ধোঁয়া নির্গত হয়, এমন যানবাহনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

অনুষ্ঠানে তৈরী পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘ঢাকা শহরের বায়ু মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। আমি নিজে গুলশানের একটি পার্কে হাঁটতে যাই। কিন্তু বায়ুদূষণের কারণে নিয়মিতভাবে ঠাণ্ডা-কাশিতে ভুগছি। ঢাকার ভেতরের বায়ুদূষণ বন্ধ করার পরও বায়ু নির্মল হবে না। কারণ, ভারত থেকে দূষিত বায়ু ভেসে আসা ঠেকানো তো ঢাকা সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বাড়াতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/737696