২৯ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৩:৩৫

ঝুঁকিতে কয়েক কোটি মানুষ

উপকূলে বেড়িবাঁধের নাজুক অবস্থা ॥ জরুরি মেরামত নেই

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: শীত মৌসুমে প্রয়োজনীয় বেড়িবাঁধ মেরামত না করায় সাতক্ষীরাসহ উপকুলীয় ১৩ জেলার কয়েক কোটি মানুষ মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। যে কোন সময় বড় ধরনের দুর্যোগে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঝুঁকিতে থাকা ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখার প্রায় ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা এখনো অরক্ষিত। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় দুর্যোগের পর প্রতিবারই টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি ওঠে এবং প্রতিশ্রুতিও মেলে। কিন্তু উপকূল রক্ষায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ বাস্তব রূপ পায় না। ফলে উপকূলবাসীর ভোগান্তিও শেষ হয় না। প্রতি বছরই বেড়িবাঁধ ভেঙে বাড়িঘর ও ফসলি জমি নোনাপানিতে তলিয়ে যায়। ডুবে যায় এলাকার অসংখ্য মাছের ঘের। তাতে বছরে কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। দেশের ১৩ জেলায় ষাটের দশকে ৫ হাজার ৮১০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় ১৩৯টি পোল্ডার বা বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার ৫২ বছরে নতুন আর কোনো পোল্ডার তৈরি হয়নি। পাকিস্তান আমলের ওসব বাঁধ সংস্কার আর পুনর্নির্মাণেই অর্ধশত বছর কেটে গেছে। ওসব বাঁধের নকশাও মান্ধাতা আমলের। উচ্চতা মাত্র ১০ ফুট। অথচ সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস ১২-১৫ ফুট ওপর দিয়ে বয়ে এসেছে। ফলে এখনো অরক্ষিত ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখার প্রায় ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা।

সূত্রমতে পৃথিবীর বৃহৎ বদ্বীপ বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত বাংলাদেশর উপকূলীয় অঞ্চলর ২১টি জেলা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়িবাঁধ ভেঙে সাগরের নোনা পানিতে উপকূলভাগের হাজার হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। মাছের ঘের তলিয়ে গেছে জলোচ্ছ্বাসে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামতে শভঙ্করের ফাঁকি থাকায় লাখ লাখ মানুষ জলোচ্ছ্বাসে ঘর ও জীবিকা হারিয়েছেন। দেশের সাগর তীরবর্তী অর্থাৎ উপকূলীয় ২১টি জেলায় লাখ লাখ মানুষের বসবাস। কিন্তু এই বিস্তীর্ণ উপকূলের যথাযথ সুরক্ষা না থাকায় উপকূলের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধ ক্ষতবিক্ষত হয়ে আজ উপকূল বাসির জন্য অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে।

উপর্যুপরি দুর্যোগ, জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, চিংড়ি চাষ, নদীর ভাঙন, ভারতীয় ফারাক্কা বাঁধসহ নানা কারণে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলী জেলা সমূহে জনসংখ্যা কমে অন্যত্র অভিগমন করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে উপকূলীয় এলাকায় ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা আরও ১৩ লাখ কমে যেতে পারে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার প্রতিটি কারণই ভবিষ্যতে তীব্রতর হবে। প্রতি বছর বর্ষা এলেই ওসব নদীরক্ষা বাঁধে ফটল দেখা দেয়। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ এলে দুর্বল বাঁধ ভেঙে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাণপ্রকৃতি।

অভিযোগ রয়েছে, বাঁধগুলোর এমন পরিণতির কারণ মূলত সংস্কারের নামে লুটপাট। পাউবো এবং উপকূলীয় এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সূত্র জানায়, উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রায় প্রতি বছরই পাউবো কোনো না কোনো প্রকল্প হাতে নেয়। সরকারি সংস্থাটি জরুরি সংস্কারের নামে দরপত্র ছাড়াই পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়। তারা আবার অর্ধেক মূল্যে স্থানীয় সাব-ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করে। লাভ রেখে স্থানীয় ঠিকাদারও ওই কাজ পরবর্তী সময়ে শ্রমিক সর্দারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এভাবে কয়েক হাত ঘুরে বাঁধ মেরামতে প্রকল্পের মূল টাকার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ ব্যয় হয়। এমনকি লাভের আশায় অপ্রয়োজনীয় স্থানেও সংস্কার প্রকল্প নেয়া হয়। চলতি অর্থবছরেও বিভিন্ন স্থানে একইভাবে বাঁধ মেরামতের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। নামমাত্র কাজ করে পাউবোর অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ওই টাকা পকেটে ভরছে।

সাতক্ষীরার বেতনা, কাকশিয়ালি, মরিচাপ, কালিগঞ্চের যমুনা, খুলনার কয়রা উপজেলা কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা- তিনটি নদ-নদীর ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ঘেরা। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনে প্রতি বছরই ওই এলাকার হাজার হাজার বসতি প্লাবিত হয়। জরুরি কাজের নামে বিগত ১০ বছরে কয়রার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ বাবদ ১৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৮ হাজার টাকারও বেশি খরচ দেখানো হয়েছে। জোড়াতালিতেও বাঁধ সংস্কারের নামে যেটুকু কাজ হয়, সেখানেও রয়েছে অর্থ লুটপাটের অসাধু চক্র।
সরেজমিনে শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা ঘুরে দেখা গেছে ষাটের দশকে নির্মিত উপকূল রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন স্থানের ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অধিকাংশ স্থান এতটা নিচু হয়ে গেছে যে বড় ধরনের জোয়ার হলেই বাঁধ ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। আবার অবিরাম ভাঙনের কারণে কোন কোন স্থানে বাঁেধর উপরিভাগ মাত্র তিন-চার ফুট অবশিষ্ট রয়েছে।

সোরা গ্রামের হোসনেআরা বেগম বলেন, এমন এলাকায় মানুষ বাস করতি পারে না। যাওয়ার কোন জায়গা নি, তাই জীবনের সাথে যুদ্ধ কুরে আমরা টিকে রইছি। বাঁধ না হলি গাবুরায় বসবাস হবে না- উল্লেখ করে তারই প্রতিবেশী ময়না বেগম ও জেলেখালী গ্রামের মোস্তাসিম বিল্লাহসহ অন্যরা জানান, বার বার ভাঙনে এলাকার চিংড়িঘের, ফসলের জমি আর খাবার পানির পুকুর তলিয়ে যায়। পরিবার পরিজন নিয়ে দীর্ঘদিন খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করতে হয় জানিয়ে তারা বলেন, গোটা এলাকা বৃক্ষ শুন্য হয়ে পড়ার পাশাপাশি অবিরাম ভাঙনে রাস্তাঘাট পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে গাবুরাকে ঘিরে থাকা বাঁধ নুতনভাবে নির্মাণ না করা হলে গোটা জনপদকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে বলেও দাবি স্থানীয়দের।

ভাঙন কবলিত বাঁধ নিয়ে আতঙ্ক আর হতাশার পাশাপাশি অনেকে আবার অপর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নিয়ে আক্ষেপ করেন। তহুরা বিবি ও আনোয়ারা বেগমসহ অনেকে জানান, বাতাস হলেই তারা বাড়িঘর ছেড়ে সাইক্লোন শেল্টারে যান। কিন্তু সেখানে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় চরম দুভোগের মধ্যে পড়তে হয় সবাইকে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে বাড়ি থেকে সাইক্লোন শেল্টার ৪-৫ কি. মি. দূরে হওয়াতে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কাঁচা রাস্তা মাড়িয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের যাওয়ান সময়েও তারা দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার দাবি করেন। যুগোপযোগী টেকসই বাঁধসহ গাবুরাতে আরও বেশি সংখ্যক সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণেরও দাবি জানান তারা।

https://dailysangram.com/post/520637