২৫ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১১:০৮

ডজনখানেক তদারক সংস্থা, সুফল মেলে না

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় আইন রয়েছে। বাজার তদারকির দায়িত্বেও আছে এক ডজনের বেশি সংস্থা বা অধিদপ্তর। তবে আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই। আবার দুই-তিনটি ছাড়া বাকি সংস্থাগুলোর কোনো তদারকিও চোখে পড়ে না। আর এ সুযোগটি লুফে নিচ্ছে উৎপাদক ও আমদানিকারক থেকে শুরু করে খুচরা দোকানি পর্যন্ত সর্বস্তরের ব্যবসায়ী। যে যার মতো সুযোগ বুঝে অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। দাম বাড়ানোর জন্য একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েই পার পেয়ে যাচ্ছে তারা। আর দামের ভারে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। এই বিষাক্ত চক্রের কবলে পড়ে অনেক পণ্য এখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।

অবশ্য পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার স্থিতিশীল রাখার কাজে নিযুক্ত সংস্থাগুলোর দাবি, তারা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছে। কারও কারও মন্তব্য– মজুত, কালোবাজারি, অযৌক্তিকভাবে পণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে তাঁদের হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার পেছনে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অনেক কারণ থাকে। স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। শুধু তদারকি সংস্থা আর আইন থাকলেই হবে না। সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ থাকতে হবে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে অযথা খুচরা বাজারে গিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করলে সুফল আসবে না। এ জন্য বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে এসব সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। তবেই সাধারণ মানুষ সুফল পাবে।

নিত্যপণ্যের বাজার তদারকির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি মনিটরিং টিম রয়েছে। এ ছাড়াও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ঢাকা সিটি করপোরেশন, র‍্যাব এবং জেলা প্রশাসনের একাধিক টিম বাজার মনিটরিংয়ে কাজ করে। সরকারের হাতে আছে বিশেষ ক্ষমতা আইন। রমজান উপলক্ষে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে রয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর মনিটরিং টিম। বাজার নিয়ন্ত্রণে অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজের সুবিধার জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আইন। যেমন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৫৬, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯, কৃষি বিপণন আইন-২০১৮।

সংস্থাগুলোর নিজ নিজ আইন অনুযায়ী, সারাবছর মাঠে থাকার কথা। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাাশি অনিয়ম ও ভেজালের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার নির্দেশনাও আছে। কিন্তু এসব টিমের তদারকি তেমন চোখে পড়ে না।

সংস্থাগুলো হাত গুটিয়ে বসে থাকা, আইনের শিথিল প্রয়োগের কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এ পর্যন্ত অসাধু কোনো ব্যবসায়ীকে তার অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার নজির নেই। শুধু প্রতি বছর রমজানকে কেন্দ্র করে মাঠে তাদের কিছু হাঁকডাক দেখা যায়, যা শেষ পর্যন্ত কোনো সুফল দেয় না।

এর মধ্যে ভোক্তা অধিদপ্তরে তদারকি কিছুটা বেশি দেখা যায়। মাঝেমধ্যে অভিযানে যায় বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। অভিযানে কিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হলেও উল্লেখযোগ্য কোনো শাস্তির আওতায় আনা হয় না। ফলে এসব অভিযানকে আমলে নেয় না ব্যবসায়ীরা।

প্রতিবছরের মতো এবারও রমজানকে সামনে রেখে লাগামহীনভাবে বেড়েছে পণ্যের দাম। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, ছোলা, বেগুন, সবজি, দুধসহ এমন কোনো পণ্য নেই, যেটির দাম বাড়েনি। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ।

এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, তদারকি প্রতিষ্ঠান আছে, আইনও আছে। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ ও সংস্থাগুলোর সক্ষমতার বাস্তবায়ন নেই। এগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা না গেলে বাজারে বিশৃঙ্খলা থেকে যাবে।

তিনি বলেন, পণ্যমূল্যে শৃঙ্খলা ফেরাতে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যেমন– চাহিদামতো পণ্যের জোগান আছে কিনা, তদারকি করা। জোগানে ঘাটতির সম্ভাবনা থাকলে সময়মতো আমদানির ব্যবস্থা করা। উৎপাদন থেকে শুরু করে খুচরা বাজারে আসা পর্যন্ত বিভিন্নভাবে চাঁদাবাজি ও কারসাজি হয়, সেগুলো বন্ধ করা। তদারকির দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করা। সরকার এসব উদ্যোগ নিলে বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ ছাড়া খুচরা দোকানে গিয়ে ছড়ি ঘুরালে কোনো সমাধান হবে না।

পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ শুধু আইন আর অভিযান দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তাঁর মতে, আইন হচ্ছে নির্দিষ্ট একটা পরিধি। কিন্তু এর ভেতরে কী গেম (খেলা) হবে, সেই গেম কীভাবে পরিচালনা করা হবে, সেটি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বৈশ্বিক কারণে দাম বাড়লে কারও কিছু করার থাকে না। কিন্তু দেশে বেশিরভাগ সময় অভ্যন্তরীণ কারণে দাম বেড়ে যায়। যেমন সরকারের আয়-ব্যয়ের নেতিভাচক প্রভাব, মুদ্রানীতি, সুশাসনের ঘাটতি, আর্থিক খাতে অস্থিরতা এসব উপাদান পণ্যমূল্য বাড়াতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি পরামর্শ দিয়ে গোলাম রহমান বলেন, পণ্যের চাহিদা, সরবরাহে যাতে বিঘ্ন না ঘটে তা তদারক করতে হবে। ব্যবসায়ীদেরও মুনাফা করতে হবে। তবে তাঁদের অতি মুনাফা প্রতিরোধে বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। খুচরা বাজারে কয়েকটি অভিযান চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বাজারকে নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

জানতে চাইলে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সমকালকে বলেন, বাজার মনিটরিংয়ের কাজ সারা বছরই চলে। তবে রমজানে এ মনিটর ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ালে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়ে পণ্যসামগ্রী বিক্রিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা হবে।
তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে শুধু ভোক্তা অধিদপ্তর নয়, সরকারের আরও সংস্থা ও অধিদপ্তর রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা সমন্বিতভাবে এই কাজটি করলে সারা বছর বাজার সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ইমরুল মহসিন জানান, সারাদেশেই তাঁদের মনিটরিং ব্যবস্থা রয়েছে। তবে মজুত, কালোবাজারি, অযৌক্তিকভাবে পণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে তাঁদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই। অনেক সময় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে বাজার মনিটরিংয়ের কাজ করতে হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ারের জন্য সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠনো হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আইনগত এই ক্ষমতা দেওয়া হলে অনিয়ম, কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সুবিধা হবে। প্রয়োজনে অপরাধীদের জরিমানা ও গ্রেপ্তার করা যাবে।

খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, রমজান উপলক্ষে ওএমএসের চাল বিক্রি জোরদার করা হয়েছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি হিসেবে বাড়তি চাল সরবরাহের কাজ শুরু হয়েছে। মার্চ ও এপ্রিলে সরবরাহ করা হবে দেড় লাখ করে তিন লাখ টন খাদ্য। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এলাকায় বিক্রি করা হবে এসব চাল। রমজান উপলক্ষে ট্রাকে ও ডিলারদের মাধ্যমে দোকানে দোকানে ওএমএসের চাল ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। কেউ যাতে বেশি দামে বিক্রি করতে না পারে, চাল সরিয়ে ফেলতে না পারে– তার জন্য প্রতিটি ট্রাক ও ডিলারের দোকানের সামনে অধিদপ্তরের লোক নিযুক্ত করা হবে। কেউ বেআইনিভাবে দাম বাড়ালে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2303164081