২৩ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৪৩

সাতক্ষীরাসহ উপকূলে সুপেয় পানির তীব্রসংকট

জনজীবনে চরম দুর্ভোগ

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : তীব্র গরম পড়ার আগেই সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্মের তাপদাহ বাড়ার সাথে সাথে এই সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট তীব্র হয়েছে। তা ছাড়া গাছপালা ও ফসলি জমি বিলীন এবং কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়সহ জীববৈচিত্র্যে নানা প্রভাব পড়েছে। ইউনিসেফের এক গবেষণা জরিপে বলা হয়, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক দশক ধরে পানি-প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। ভূ-উপরিস্থিত পানির আধার নষ্ট হয়েছে। পানির বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় না নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিচ্ছিন্ন উদ্যোগগুলো কোনো কাজে আসেনি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের জেলা পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ, খুলনার ২২ শতাংশ এবং বাগেরহাটের ১৫ শতাংশ এবং মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছে ভূগর্ভের নোনা পানির অনুপ্রবেশ বাড়ছে। দেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত চলে এসেছে নোনা পানি। ভূগর্ভে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। অনেক জায়গায় গভীর নলকূপেও পানি উঠছে না। সুপেয় পানির অভাবে কলেরা, ডায়রিয়া, টাইফয়েড ইত্যাদির মতো জীবনবিনাশী পানিবাহিত রোগেরও দ্রুত বিস্তার ঘটছে। আবার ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে এসব এলাকার সুপেয় পানির উৎসস্থল পুকুরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ‘উপকূলের জল বেদনা’ নামক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপকূলের মানুষের মুখে সুপেয় পানি তুলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা নোনা পানির এই জনপদে বছর বছর চালু করে নিত্যনতুন প্রকল্প। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন দাতা সংস্থার টাকায় এনজিওগুলো উপকূলবাসীকে সুপেয় পানি বিতরণের নানা প্রকল্প হাতে নেয়। সরকারি অনুমোদনের পর তারা প্রকল্পের প্রযুক্তি বসিয়ে দেয় কারো বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কাজ শেষে এর কয়েকটি বুঝিয়ে দেয় স্থানীয় সরকার বা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাছে; আর বেশির ভাগই গছিয়ে দেয় সুফলভোগীদের ঘাড়ে। নামমাত্র কমিটি করে প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়ে আসে কয়েকজন ব্যক্তির ওপর। এসব আয়োজনের কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনা থাকে না। পানি বিক্রির টাকা আর এর-ওর কাছ থেকে চাঁদা তুলে জোড়াতালি দিয়ে চলতে থাকে প্রকল্প। গতি হারালে প্রকল্পের সুফলভোগীরা জলকষ্টে পড়ে।

২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) জরিপের ফলাফল বলছে, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় বসবাসকারী ৭৩ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করছেন। প্রতি লিটারে এক হাজার মিলিগ্রামের বেশি লবণাক্ততা থাকলে তা পানযোগ্য নয় হিসেবে বিবেচিত হয়। অথচ ওই উপজেলাগুলোর পানিতে প্রতি লিটারে ১ হাজার ৪২৭ মিলিগ্রাম থেকে ২ হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা আছে। এসব এলাকার ৫২ শতাংশ পুকুর ও ৭৭ শতাংশ নলকূপের পানিতে বেশি মাত্রায় লবণাক্ততা পাওয়া গেছে।

গত বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এবারে শীতের পর থেকেই খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও এর আশেপাশের অঞ্চলের গভীর নলকূপ থেকে আর পানি উঠছে না। সুপেয় পানির অন্য উৎসগুলোয় লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে। আবার লবণ পানি পরিশোধন করতে যে ফিল্টারগুলো বসানো হয়েছিল সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ।

বিশ্ব পানি দিবস ২০২৩ উপলক্ষে বুধবার ২২ মার্চ, ২০২৩ সাতক্ষীরায় পানি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। পানি অধিকার প্রচারাভিযান ওয়াটারম্যভ ক্যাম্পেইনের আওতায় স্বদেশ-সাতক্ষীরা, পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক-প্রান এবং একশনএইড বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই শুনানিতে সুপেয় পানি সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী, নাগরিক আন্দোলনের কর্মী, গণমাধ্যম কর্মী, এনজিও প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি, উপকূলে জলবায়ু ও পানি বিশেজ্ঞরা অংশ নেয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) প্রকৌশলী মো: হরুন অর রশিদ, জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। পানি শুনানিতে পানি সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পক্ষে টেস্টিমনি উপস্থাপন করেন কমিউনিটির নারী ও পুরুষ। সুপেয় পানি সংকট কীভাবে তাদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে এ বিষয়ে তারা তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। জেলার আশাশুনি, তালা ও শ্যামনগর সুপেয় খাবার পানির প্রচন্ড সংকট, মিষ্টি আধার পুকুরগুলো এখন লবণাক্ত হয়ে গেছে।

বেঁচে থাকার জন্য দৈনিক প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহে তাদের সংগ্রামের কথা জানিয়ে তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে উপকূলে/সাতক্ষীরায় পানীয় জলের সংকট সময়ের সাথে সাথে তীব্রআকার ধারণ করেছে, জনজীবনে যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে পানি সংগ্রহ করতে দূর-দুরান্তে গিয়ে অতিরিক্ত সময় ব্যয়, কলস, ড্রামের মত পানি সংরক্ষণের ভারী আধার বহন করার ফলে শারীরিক নানা অসুস্থতা, বাধ্য হয়ে লবণাক্ত ও দূষিত পানি পানের ফলে উচ্চরক্তচাপ, পেটের পীড়া, হৃদরোগের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকি, শিশুমৃত্যু, গর্ভবতী নারীদের খিঁচুনি, অকালগর্ভপাত ও উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি সংকট। আবার লবণাক্ততাজনিত অসুস্থতার চিকিৎসায় এবং প্রয়োজনীয় পানীয় জল কিনতে গিয়ে পরিবারগুলোর উপর রয়েছে অতিরিক্ত খরচের বোঝা।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক, কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও সুপেয় পানির সংকট তৈরি হয়েছে। পানি সংকটকে কেন্দ্র করে এলাকায় প্রতিদিন নানাধরণের পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। সংকট ঘিরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অভিযোজন চর্চাও বৈচিত্র্যময়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং উপকূল মানুষের জীবনসংগ্রামের সাথে সাথে এলাকায় যেসব ধান, মাছ, গাছ, পাখি ও বন্য জীবজন্তু ছিল, সেসব এখন হারিয়ে গেছে। বদলে গেছে এলাকার দুর্যোগ পঞ্জিকাও।

https://dailysangram.com/post/520094