১৯ মার্চ ২০২৩, রবিবার, ১২:২৫

নানা চাপে প্রান্তিক খামারিদের দুর্দিন

প্রাণিজ আমিষের সহজলভ্য উৎস ডিম-মুরগি। গত তিন দশকে গ্রামগঞ্জে ক্ষুদ্র খামারিরা জোগান দিয়েছেন আমিষের চাহিদা। গরিবের খাবারের পাতে সস্তায় যাঁরা ডিম-মুরগি নিয়ে গেছেন, তাঁদেরই আজ দুর্দিন। সংকটে তাঁদের পাশে কেউ নেই। উল্টো একের পর এক বাড়ছে পোলট্রি উপকরণের দাম। উৎপাদন তিন গুণ বাড়িয়েও ব্যবসা এখন আর তাঁদের হাতে নেই।

নানা সংকটে লোকসান গুনতে গুনতে গ্রামের সেই প্রান্তিক খামার একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাজারে দাম বেশি হলেও ঠকছেন ক্রেতা। খামারির কষ্টের লাভ লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। আর স্বল্প আয়ের মানুষ তাঁদের দৈনিক আমিষ গ্রহণে কাটছাঁট করছেন। ফলে জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ পটভূমিতে আজ রোববার নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে বিশ্ব পোলট্রি দিবস।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রাণিজ খাদ্য ও ওষুধের দাম এবং জ্বালানি তেলের খরচ বেড়ে যাওয়া, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, মধ্যস্বত্বভোগীর দাপট এবং করপোরেট কোম্পানির বড় বিনিয়োগে চাপের মধ্যে আছেন তাঁরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রান্তিক খামারিরা ন্যায্যমূল্য না পেলে উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। বেকার হয়ে যাবেন লাখ লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। তাই তাঁদের সুরক্ষায় সরকারকে নিতে হবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

ভালো নেই খামারি: রংপুরের তারাগঞ্জের প্রামাণিকপাড়া গ্রামের রিফাত ইসলাম সৌদি আরবে পাঁচ বছর চাকরি শেষে দেশে ফিরে গড়ে তোলেন মুরগির খামার।

বিনিয়োগ করেন আট লাখ টাকা। স্বপ্ন ছিল, কষ্টের টাকায় ঘোরাবেন ভাগ্যের চাকা। তবে প্রথম বছরেই করোনার ছোবলে গুনতে হয় দুই লাখ টাকা লোকসান। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় পরের বছরও মুরগি পালন করেন তিনি। তবে কিছুতেই দেখতে পারছেন না আলোর মুখ। খুচরা বাজারে দাম থাকলেও পশুখাদ্যের দর বেড়ে যাওয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে একের পর এক লোকসান গুনতে হচ্ছে তাঁকে। এবারও মুরগি বিক্রি করে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে তাঁর।

বছর চারেক আগে খামারির খাতায় নাম লেখান কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের এনামুল হক পান্না। মাস দেড়েক আগে ব্রয়লার মুরগির খামার বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। কেন এই সিদ্ধান্ত– জানতে চাইলে বলেন, মুরগি তোলার পর থেকেই খাবারের দাম বাড়ছে। আগে এক বস্তা খাদ্য কিনতাম ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়, মুরগির প্রতিটি বাচ্চা কিনতাম ১১ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে। এখন এক বস্তা খাবার কিনতে হচ্ছে ৩ হাজার ৭০০ টাকায়। আর বাচ্চা কিনতে হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়।

এদিকে, আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় নতুন করে সংকটে ফেলেছে পোলট্রি খামারিদের। ক্ষুদ্র খামারিরা বলছেন, এক হাজার মুরগি পালনের একটি ছাউনিতে শীতকালে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ খরচ হয় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। গরমে সেই খরচ আরও ৫০ শতাংশের মতো বেড়ে যায়। তখন প্রতি এক হাজার মুরগির ছাউনিতে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে প্রতি ইউনিটে খরচ বেড়েছে গড়ে ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ পোলট্রি ফার্মার রক্ষা জাতীয় পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মহসিন বলেন, এলসি খোলা যাচ্ছে না, ব্যাংকে টাকা নেই, আছে ডলার সংকট। এসব কারণে খাদ্য আমদানিও করা যাচ্ছে না।

বন্ধ হচ্ছে খামার, কমছে উৎপাদন: বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, সারাদেশে ১ লাখ ৫৮ হাজার ১৭৯ খামারের মধ্যে এখন চালু আছে ৯৫ হাজার ৫২৩টি। বর্তমানে উৎপাদন (মুরগির মাংস) হচ্ছে ৪ হাজার ২১৯ টন, যা উৎপাদন সক্ষমতা থেকে ২৫ দশমিক ৭১ শতাংশ কম। এ ছাড়া ডিম উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক যেখানে ৬ কোটি ৬৪ লাখ ৮২ হাজার ১৮৩টি, সেখানে দৈনিক মিলেছে ৪ কোটি ৩২ লাখ ১৩ হাজার ৪১৮টি ডিম; যা উৎপাদন সক্ষমতা থেকে ২৫ শতাংশ কম।
একে অন্যকে দোষারোপ: ডিম-মুরগির দাম বাড়ার পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, চার হাত বদলে এই পণ্য আসছে ভোক্তার কাছে। খামারি থেকে ডিম কেনে একশ্রেণির সরবরাহকারী বা এজেন্ট, তাদের কাছ থেকে কেনেন আড়তদাররা, সেই ডিম যায় পাইকারি দোকানে, এর পর আসে খুচরা পর্যায়ে।

মুরগির খামারিদের কাছ থেকে আসা ডিম হাত বদলে প্রতিটিতে দাম এক টাকার বেশি বাড়ে। তবে সেই লাভ পান না বলে দাবি খামারিদের। আড়তদাররা বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগী সরবরাহকারীরাই লাভ কুড়িয়ে নিচ্ছেন। সরবরাহকারীরা আবার দুষছেন বড় কোম্পানিগুলোকে। তারা আবার সেই অভিযোগ অস্বীকার করছে।

টিকতে পারছেন না ছোট খামারিরা: জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও বলছে, উৎপাদন খরচের বড় পার্থক্য থাকায় বাজারে বড় কোম্পানির সঙ্গে বাজারে টিকতে পারছেন না প্রান্তিক খামারিরা।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা হচ্ছে। তবে খামারিরা এই মুরগি বাজারজাত করতে পারছেন না। যেহেতু জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বেশি, প্রযুক্তিও আছে– সে কারণে এই বাজারটা অনেকটাই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। ফলে প্রান্তিক চাষিরা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, বড় বড় কোম্পানি উৎপাদন, প্যাকেজিং আর ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি সুবিধা একসঙ্গে পেয়ে যায়। ফলে ব্যবসায় তারা অনেকটা এগিয়ে থাকে। ছোট খামারির পক্ষে তা সম্ভব হয় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বায়নের যুগে কখনও বড় কোম্পানিকে দমিয়ে রাখা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ছোট খামারির পক্ষে প্রতিযোগিতা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে, তাদের সক্ষমতা বাড়ানো। এ ব্যাপারে সরকারকেই মনোযোগ দিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিযোগিতা যত বেশি হবে, যারা দুর্বল বা অদক্ষ, তাদের বাজার থেকে একসময় বেরিয়ে যেতে হবে। যারা টিকে থাকবে, তাদের প্রযুক্তি সক্ষমতা বাড়াতে হবে; এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতা করে তারা বাজারে টিকে থাকবে।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, সরকার সব সময় ক্ষুদ্র খামারিদের পাশে আছে। করোনাকালেও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন যুগের সূচনা করেছে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি)। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আগামীতে সমবায় বিপ্লব ঘটবে। একটা আদর্শ খামার করতে যা যা করা দরকার, এলডিডিপি তা করছে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটির মাধ্যমে জেলা পর্যায়ে পাঁচ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র খামারিকে নিয়ে দল গঠন করা হয়েছে। তাদের উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত সব রকম সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসাসেবা, প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতিও দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র খামারিরা সক্ষমতা অর্জন ও প্রতিযোগিতার বাজারে টেক্কা দিতে পারবে।

পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগ হবে ৮০ হাজার কোটি টাকা: বর্তমানে পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগ ৪০ হাজার কোটি টাকা। ২০৪১ সালে তা হবে ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা। কর্মসংস্থান ৬০ লাখ থেকে বেড়ে হবে ১ কোটি ৩০ লাখ। গতকাল শনিবার রাজধানীতে ১২তম আন্তর্জাতিক পোলট্রি শোর সমাপনী অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।

অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সচিব ড. নাহিদ রশীদ বলেন, পোলট্রির সংকট যেন দীর্ঘ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে একত্রে কাজ করতে হবে।

ওয়ার্ল্ড’স পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) সভাপতি মসিউর রহমান পোলট্রি বোর্ড গঠনের দাবি জানান।

https://samakal.com/bangladesh/article/2303163003