১৮ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ৬:০৭

জোর যার জমি তার

শুধু বিঘে-দুই, আছে মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে/বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে’। রবি ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাতেই স্পষ্ট যে, প্রভাবশালীর গ্রাসে পরিণত হয়েছে নিরীহ, দরিদ্রের জমি। জোর যার জমি তার। ভূমি বিষয়ক এমন সংস্কৃতি এই ভূখ-ে চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। মানুষ বাড়ছে। জমির কদর বাড়ছে। বাড়ছে জমির প্রতি মানুষের লোভ। জাল-জালিয়াতি, জমি জবরদখল, মামলা, হামলা হচ্ছে জমির ভোগ-দখলকে কেন্দ্র করে। আদালতগুলোতে দেওয়ানি তথা ভূমি সংক্রান্ত মামলার স্তুপ আরও উঁচু হচ্ছে। অথচ আইনি রাস্তায় সহসাই মেলে না ভূমি অপরাধের সুবিচার। দুর্বল মানুষ তাই বঞ্চনার বেদনা নিয়ে বিদায় নিচ্ছেন পৃথিবী থেকে। একজনের জমি ভোগ করছে অন্যজন। অথচ এ অপরাধের নালিশ জানানোর কোনো জায়গা নেই। তাৎক্ষণিক কোনো প্রতীকার নেই কোনো কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কতদিন চলবে প্রাগৈতিহাসিক এ প্রথা?

রাজধানীর মেরাদিয়া মৌজায় ২টি দাগে ৪২ শতাংশ ভূমির মালিক শেখ রমিজউদ্দিন (৭২)। চাচা নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। এ কারণে নিজ পিতা এবং চাচার সম্পত্তিরও ষোলো আনা মালিক তিনি। আর কোনো ভাইবোন নেই। বাবা-মা মৃত্যুর পর সম্পত্তি গ্রাসের জন্য রমিজউদ্দিনকে তাড়িয়ে দেয় স্বজনরা। পুরান ঢাকায় পালিয়ে বাঁচেন শিশু রমিজ। এখন তিনি মাংসের দোকানের কর্মচারী। কষ্টেশিষ্টে দিন কাটে তার। মূল্যবান পৈত্রিক সম্পত্তি মালিকানার প্রামাণ্য কাগজপত্র বগলদাবা করে ঘুরছেন এর-ওর কাছে। মেরাদিয়ার পৈত্রিক ভিটায় ভবন তুলেছে জবর দখলকারীরা। প্রাণভয়ে জমির কাছেও যেতে পারছেন না। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলায় লড়বেন, এমন সাহস ও সাধ্য কোনোটাই নেই। অপেক্ষায় আছেন, দখল ছাড়া যদি কাগজপত্রগুলোই বিক্রি করে দিতে পারতেন!

রমিজউদ্দিন একটি সত্য ঘটনার দৃষ্টান্ত মাত্র। এ ধরণের ঘটনা সারাদেশে লাখ লাখ। কাগজ আছে-দখল নেই। দখল আছে তো কাগজ নেই। এ নিয়ে রয়েছে বিরোধ। হচ্ছে খুনোখুনি। যুগ যুগ ধরে চলছে মামলাও। শত শত বছর আগে প্রণীত আইনের আওতায় চলছে এসব মামলা।
আইনমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের আদালতগুলোতে ৪০ লাখ মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে জমি বা ভূমি সংক্রান্ত মামলা সাড়ে ১৪ লাখের বেশি। ফৗজদারি মামলা ২০ লাখ ২৫ হাজারের মতো। অধিকাংশ ফৌজদারি মামলার উৎপত্তির কারণ দেওয়ানি বিষয়-আশয়। এ সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। মামলার ক্রমবর্ধিষ্ণু এই সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ আইনজ্ঞ, আইনজীবী, সরকার এবং বিচার বিশেষজ্ঞদের। দুশ্চিন্তা রয়েছে সমাজ বিশ্লেষক, চিন্তাশীল নাগরিকদেরও।

রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার বয়স ৫২ বছর। কিন্তু মানুষের ব্যক্তিজীবনকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখছে ভূমি দস্যুতা, ভূমি অপরাধ। বৈধ উপায়ে মানুষ ভূ-সম্পত্তি অর্জন করলেও সেটি সংরক্ষণ এবং ভোগদখলে তৈরি হচ্ছে নানামুখী সংকট। একজনের জমি, গায়ের জোরে অন্যজন দখল করে নিচ্ছে। অথচ এই দখল-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিকার লাভের সহজ কোনো রাস্তা নেই।

স্পষ্ট সংজ্ঞা নেই মালিকানার : বিশ্লেষকরা বলছেন, ভূমি-প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা ভূমি দস্যুদের সুবিধার্থে ‘ভূমি-মালিকানা’র একটি সংজ্ঞা দাঁড় করিয়ে নিয়েছেন। তথাকথিত এই সংজ্ঞা অনুযায়ী ভূমিমালিকানার পক্ষে তিনটি বিষয় আবশ্যক। (১) দলিল (২) দাখিলা এবং (৩) দখলস্বত্ত্ব। এ অনুযায়ী দলিল এবং দাখিলা সত্ত্বেও কেবলমাত্র দখল না থাকলে জমির মালিক জমির মালিকানা হারাবে। অর্থাৎ অপরের অধিকার হরণকারী, লোভী, চতুর,ক্ষমতাধর ভূমিদস্যুই পাবেন মালিকানা। কারণ পেশীশক্তি বলে অন্যের জমি দখল করতে সক্ষম। সে ক্ষেত্রে ভূমি-প্রশাসনের চূড়ান্ত সেবাটি নিবেদিত কেবল ভূমিদস্যুর কল্যাণে। অবিচারের শিকার দখলচ্যুত ভূমি মালিক ভূমি-প্রশাসনের চূড়ান্ত পরিষেবা পাবেন না।

অথচ বিশ্বের শীর্ষ ব্যবস্থাপনার মূল সেøাগান হচ্ছে ‘বেটার কাস্টমার সার্ভিস ডেলিভারি’। উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিবদের বাংলাদেশ লোক প্রশাসন কেন্দ্রে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখানকার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে উত্তম গ্রাহক সেবা নিশ্চিতকরণ। এক্ষেত্রে মানদ-টি হচ্ছে, যে সার্ভিস যত বেশি টিসিভি (টাইম, কস্ট, ভিজিট) কমাতে পারবে, সেই সার্ভিস ততো আদর্শ সার্ভিস। শুদ্ধাচার নিয়ে দেশে অনেক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ, টকশো হচ্ছে। সরকারি কর্মক্ষেত্রে এর পরিপালন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গণশুনানি হচ্ছে। কিন্তু অস্বচ্ছল, সাধারণ প্রকৃত জমির মালিকের অধিকার নিশ্চিতে কাস্টমার সার্ভিসের কোনো অর্জন নেই। নিরীহ, দরিদ্র ব্যক্তির জমি প্রভাবশালী, অর্থশালী ব্যক্তি হাতিয়ে নিলেও ভূমি-প্রশাসন তার পক্ষে দাঁড়ায় না।
জায়গা নেই প্রতিকারের

১৮৬০ সালের ফৌজদারি দ-বিধিতে চুরির শাস্তি রয়েছে ৩ থেকে ১০ বছর কারাদ-, অর্থদ-। ডাকাতির শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদ-, অর্থদ-। অথচ জমি জবর দখলের সরাসরি কোনো শাস্তি দ-বিধিতে নেই। ন্যায়বিচারের স্বার্থে ভূমির প্রকৃত মালিকের প্রাথমিক নালিশ করার কোনো প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠেনি। ভূমি সংক্রান্ত বিচার সালিশ এখনও স্থানীয় মোড়ল, মাতব্বর, মেম্বার, চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি, জটিল-কুটিল প্রকৃতির ফড়িয়া-দালাল ও গ্রাম্য টাউট শ্রেণির হাতে বন্দী।

বিদ্যমান ব্যবস্থানুযায়ী, দরিদ্র, নিরীহ ব্যক্তির জমি জবরদখল হলে হয়তো ছুটে যান থানায়। কিন্তু অর্থ না ঢাললে থানা-পুলিশের ব্যবস্থাও পক্ষে আসে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে থানা বিষয়টি পাঠিয়ে দেয় আদালতে। কখনওবা পাঠিয়ে দেয় ডেপুটি কালেক্টর (ডিসি) অফিস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা এসিল্যান্ডও কাছে। এসিল্যান্ডও শেষ পর্যন্ত ঠেলে দেন আদালতের কাঁধে। দেওয়ানি মামলা নিয়ে আদালতে গেলে আইনজীবীর ফি, মামলা পরিচালনা ব্যয়, শারীরিক সুস্থতা, সক্ষমতা এবং ধৈর্য্যরে বিষয়। দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা দেশের বিচার ব্যবস্থার বড় বাস্তবতা। জাল-জালিয়াতি, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রভাবশালী দখলদারপক্ষ জটিলতা সৃষ্টি করে মামলাকে ২৫/৩০ বছরের ফাঁদে ফেলে দিতে পারেন অনায়াসেই। বিপরীতে দুর্বল, দরিদ্র ভূমি মালিক ক্লান্ত হয়ে পড়েন দেওয়ানি মামলার শুরুতেই।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় ‘গ্রাম আদালত’ রয়েছে। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার মাধ্যমে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ (এডিআর) কার্যক্রম রয়েছে। তবে এসব জায়গায় কেবল বিবদমানপক্ষ উভয়েই যদি শান্তিপ্রিয় হয়। দুইপক্ষই যদি সমাধান চায় সেটিই কেবল নিরসন সম্ভব। যদিও এখানে ইউপিও চেয়ারম্যান কিংবা পৌর মেয়রকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থমূল্যের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যেমন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ১ লাখ টাকা থেকে ২ লক্ষ টাকার সম্পত্তির সালিশ করতে পারবেন। পৌরমেয়র ২ থেকে ৩ লাখ টাকা মূল্যমানের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেন। কিন্তু যে ভূমিদস্যু পরিকল্পিতভাবে জাল কাগজ তৈরি, ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে জমি জবরদখল করছেন তিনি গ্রাম আদালতের সালিশ তিনি মানছেন না। সোজা চলে যান দেওয়ানি আদালতে। তিনি জবরদখল দারিত্বের পক্ষে স্থিতি আদেশ এনে দখলস্বত্ব বজায় রাখেন। তার পক্ষে আনা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল, সেই আপিলের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট, হাইকোর্টের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টের আদেশের পর রিভিউ-এসব করে মোটামুটি জীবন পার করে দেয়া সম্ভব। পক্ষান্তরে ভূমির দখল হারানো ব্যক্তি নিঃস্ব হয়ে যান। গেরস্থ থেকে বাড়ি-ঘর বিক্রি করে ভিক্ষুক হোন। ন্যায়বিচারের সুফল তিনি হয়তো আর দেখেও যেতে পারেন না।

এদিকে থানা, এসিল্যান্ড অফিস অথবা ডিসি অফিসে গিয়েও কোনো ধরণের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয় । থানা বলে এটা পুলিশের কাজ নয়। এসিল্যান্ড অফিস অথবা ডিসি অফিসে বলে এটা আদালতের কাজ।

কি করছে ভূমি-প্রশাসন? : সংজ্ঞায়িত ‘ভূমি-মালিকানা’ দাবির পূর্বশর্ত দলিল। দলিল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সরকার একটি ফি নেয়। এর মধ্যে স্ট্যাম্প শুল্ক-৩ শতাংশ, স্থানীয় সরকার কর-৩ শতাংশ, উৎসে কর (অঞ্চল ভেদে) ৪ শতাংশ, মূল্য সংযোজন কর-২.৫ থেকে ৩শতাংশ হারে গ্রহিতাকে সরকারের অনুকূলে পরিশোধ করতে হয়। এর বাইরেও অনেক ধরনের শুল্ক রয়েছে। রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের ভিত্তিতে নামজারি করতে যেতে হয় সহকারি (ভূমি) অফিসে। এক্ষেত্রে বর্তমানে জমির মালিকের কাছ থেকে সরকার নিচ্ছে ১১শ’ ৫০ টাকা। দাখিলা (খাজনা/ভূমি উন্নয়ন কর)র ক্ষেত্রেও সরকার জমি মালিকের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে অর্থ আদায় করছে। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে নানা নামে জমি মালিকের কাছ থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। কিন্তু বিনিময়ে জমি কিংবা ভূমির প্রকৃত মালিক কি পাচ্ছে? দুর্বল, অসহায় ভূমি মালিক যদি সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যু দ্বারা দখলচ্যুত হন সরকার কি তার স্বার্থরক্ষায় কোনো ভূমিকা নিচ্ছে? সেই ব্যবস্থাপনা কি বর্তমান ভূমি-প্রশাসনে রয়েছে?

ভূমি কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির সীমানা প্রাচীর মাপ-জোক করে সঠিকতা নিরূপণে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এসিল্যান্ড অফিস বা ডিসি অফিসেরও এমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি নেই। সরকার জমিজমা নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঘটনাস্থলে সার্ভেয়ার পাঠিয়ে সীমানা নির্ধারণ করে দেয়ার দাফতরিক কোনো এখতিয়ার এসিল্যান্ড অফিসের সার্ভেয়ারদের নেই। যেটুকুন ব্যবস্থা আছে তা শুধু সরকারি স্বার্থ সংরক্ষণে। ভূমি বিরোধের ক্ষেত্রে অনেক সময় নিরীহ ভূমি মালিক পুলিশের দ্বারস্থ হন। অনুরোধ ও তদবিরের প্রেক্ষিতে হয়তো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা উভয়পক্ষকে ডেকে বিরোধ মীমাংসার উদ্যোগ নেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও উচ্চ আদালত দ্বারা বারিত রয়েছে। কারণ, বিচারিক ক্ষমতা পুলিশের নেই।

সমাধান কোথায়? : লাঠি কিংবা পেশীর জোরে জমি জবরদখলে রাখার প্রাগৈতিহাসিক চিত্রের অবসান সহসাই ঘটবে কি? এর জবাবে গত ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে আশার বাণী শুনিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘দলিল যার জমি তার’ শীর্ষক আইনের খসড়া প্রণীত হয়েছে। আইনমন্ত্রণালয়ের মতামত পেলে এটি সংসদের আগামি অধিবেশনে বিল আকারে উত্থাপন করা হবে। মন্ত্রী বলেন, এক সময় ভূমি কর দিতে গিয়ে মানুষ হয়রানির শিকার হতেন। এটা এখন অনলাইনে নিয়ে এসেছি। যদিও পাশাপাশি ম্যানুয়ালি রেখেছি। তবে এই পহেলা বৈশাখ থেকে সেটা বাদ দিয়ে দিয়েছি। আর ভূমিকর ম্যানুয়ালি নেবো না। সম্পূর্ণ অনলাইন হতে হবে।

তবে আইনমন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত আইনের খসড়া মতামতের জন্য আইনমনস্ত্রণালয়ে আসেনি। এ কারণে ভুক্তভোগী মানুষের প্রশ্ন, কবে হবে এই আইন? আইনটি কার্যকরই বা হবে কবে? কবে হবে ভূমিকেন্দ্রিক বর্বরতার অবসান?

https://dailyinqilab.com/national/article/562926