১৮ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ৫:৪৪

সাংবাদিক কেন টার্গেট

-ড. মাহবুব হাসান

এই প্রশ্নটি এখন উঠে আসছে এ কারণে যে সাংবাদিকরা ঘটমান বর্তমানের চালচিত্র তুলে ধরেন দর্শক-শ্রোতা আর প্রিন্ট মিডিয়ার পাঠকের সামনে। তাতে দেশের অধিকাংশ মানুষ দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে রাজনীতিকরা কী করছেন, কী বলছেন। সেই সাথে আইনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ কেমন আচরণ করছে, কী অ্যাকশন নিচ্ছে এবং তাদের অঙ্গ-ভাষা (বডি ল্যাঙ্গুয়েজ) প্রত্যক্ষ ও পরখ করতে পারছে।

সুপ্রিম কোর্ট বার সমিটির নির্বাচন ঘিরে গত কয়েক দিন ধরেই রাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছিল হাইকোর্ট চত্বরে। সরকারি পক্ষের আইনজীবীরা সাদা আর বিরোধী দলের আইনজীবীরা নীল দল হিসেবে ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। লিখলাম অংশ নিয়েছেন, কিন্তু নির্বাচন তো হয়েছে একতরফাভাবে। বিএনপিপন্থী খ্যাত আইনজীবীদের ঠেলে-ধাক্কিয়ে এবং পুলিশের ব্যাপক লাঠিচার্জের মাধ্যমে বের করে দিয়ে বেলা ২টার পর ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু করতে পেরেছেন। আর আমরা জানি, এই নির্বাচনে সরকারদলীয় সাদা প্যানেল বিজয়ী হবে। কারণ নীল দলের প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটারদের বের করে দিয়ে একদলীয় বা একপক্ষীয় ভোট প্রয়োগ করে ওই বিজয় যে ভোট ছিনিয়ে দেবার ঘটনা, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কেন নীল দলীয় ভোটার আইনজীবীদের ভোট দিতে দেয়নি সরকারদলীয় পক্ষ? কারণ তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে পরাজিত হবেন, এই আশঙ্কা থেকেই বার সমিতির নির্বাচনে গায়ের জোর ও পুলিশি জোর খাটিয়ে ওই আইনি প্রতিষ্ঠানটিকে দূষিত করা হলো। টিভিতে যে নির্বাচনসংক্রান্ত দৃশ্য দেখেছি, তাতে মনে হলো সর্বোচ্চ আদালতে যারা আইনি সেবা দিয়ে যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবদান রাখছেন, তাদের নৈতিকতা কতটা ন্যায়ে ভরপুর। বার সমিতির নির্বাচনে কেন বিশৃঙ্খলা হবে? এটা কি একটি যৌক্তিক প্রশ্ন নয়? যারা উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার কায়েমে অবদান রাখেন, তাদের নিজেদের সমিতির নির্বাচনে কেন গণ্ডগোল হলো?

এই নির্বাচন নিয়ে সরকারদলীয় আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন যে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে তা ছিঁড়ে ফেলেছেন। এই একই অভিযোগ বিএনপি পক্ষের আইনজীবীদেরও। তারা বলছেন, সাদা দলের আইনজীবীরা নির্বাচনকে বানচাল করতে ভোট চুরির মাধ্যমে জেতার জন্য ওই অপকর্মটি করেছেন।

দোষ চাপানোর রাজনৈতিক সংস্কৃতিটি অনেক পুরনো। গান পাউডার দিয়ে বাসে আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যার কাজটি করেছেন আওয়ামী নেতার নির্দেশে তারই কর্মীরা। পরে তারা ভিডিও করে সেই সত্য জানিয়েছেনও। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ নেতারা শতকণ্ঠে বলছেন ওই কাজটি বিএনপি করেছে। তারা নাম দিয়েছে বিএনপির আগুন সন্ত্রাস। ওই আগুন সন্ত্রাসের দায় কার আইনি প্রক্রিয়ায় তা আজো প্রকাশ পায়নি। কেন পায়নি? যদি বিএনপি ওই মানুষ হত্যার নারকীয় কাজটি করে থাকে, তাহলে ভিডিওতে তাদের নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করা খুব কঠিন না। কিন্তু তারা সেই কাজটি করছেন না। কারণ কি এই যে ওই নারকীয় কাজটি আওয়ামী নেতার বিহঙ্গ পরিবহনের গাড়িটি তার অনুগত কর্মীরা করে বিএনপির ঘাড়ে তার দায় চাপিয়ে দিয়েছে?

আসেন, নিজেরা করি, আর অন্যের ঘাড়ে দায় চাপাই- এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদ্ভাবক তো আওয়ামী লীগ। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে খন্দকার মোশতাক হেরে গেলে কুমিল্লার সেই নির্বাচনী এলাকা থেকে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে এসে তাকে জেতানো হয়েছিল। হেরে গিয়েছিলেন ওই চৌর্যবৃত্তির ফলে অলি আহাদ। সেই মোশতাকই কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ও সহচর ছিলেন এবং তাকে হত্যার পর ক্ষমতায় বসেছিলেন এবং তার পারিষদবর্গ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুরই রাজনৈতিক সহচর ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ। আওয়ামী লীগ সেই সত্য মেনে না নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার মুখটি ঘুরিয়ে দেন জিয়ার দিকে। জিয়াকে খুনি হিসেবে প্রতিষ্ঠার কসরত করছেন তারা। আর সফিউল্লাহকে মন্ত্রী বানিয়ে নেচেছেন। এই আত্মপ্রতারণা আওয়ামী লীগেরই অবদান। কেননা আত্মপ্রতারণাই ওই দলটির রাজনৈতিক অভিযাত্রা। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর হাতে সৃষ্টি আওয়ামী লীগ, বর্তমান আওয়ামী নেতারা বলেন, ওই দলটি নাকি বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছেন। এই যে মিথ্যাচার ও প্রতারণা, এ থেকেই বোঝা যায় তাদের রাজনীতির মূল কোথায় নিহিত।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে ১০ টাকা দরে গরিব মানুষদের মোটা চাল খাওয়ানোর রাজনৈতিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেটা কি মনে আছে? মনে না থাকলেও চলবে। সংবাদপত্রগুলোতে তো আর মহামারি লাগেনি যে তা মুছে যাবে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ফুটেজ তো আছে। আর কৃষকদের মাগনা সার দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। এই প্রশ্ন তুললেই আওয়ামী উত্তর আমরা তো কৃষককে গুলি করে হত্যা করিনি সারের জন্য। সত্য বিএনপি সরকারের আমলে সারের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষককে গুলি করে মারা হয়েছিল। এই সত্য কি বিএনপি অস্বীকার করতে পারবে? না, পারবে না। কারণ তারা সেই অপরাধ করেছিল। রাজনৈতিক সরকারের এই রকম ভুল ও হিংস্র স্বভাব কেন? তারা কৃষক জনগণের ওপর ক্ষ্যাপা কেন? তারা খাদ্যশস্য উৎপাদক, এজন্য?

কেননা অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তো কৃষিই। কৃষি সেক্টর কোনো কৃষক মাগনা তো দূরে থাক, ন্যায্যমূল্যে সার কিনতে পারেননি আজো। না, আওয়ামী শাসনামলে, না বিএনপি শাসনামলে, না জাতীয় পার্টির আমলে। কারণ কোনো পার্টিই তাদের রাজনীতির লক্ষ্যটি কৃষি ও কৃষক নয়।

আর আজ ওয়াদা দেয়া দশ টাকা দরের চাল তারা খোলাবাজারে কেনেন ৫০-৫৫ টাকা দরে। ওপেন মার্কেট সেল-এ (ওএমএস) ১০ টাকায় চাল দিতে পারেননি সরকার। আর গরিবদের ওএমএসএর নিত্যপণ্য দিতে হয় কেন? এ-প্রশ্ন কি আমরা করতে পারি? খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্য কায়েম করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। প্রায়ই আওয়ামী নেতারা বলেন, কোটি পরিবারকে ওএমএস-এর মাধ্যমে খাদ্যশস্য দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখছেন। কথাটা মিথ্যা নয়, সত্য। কিন্তু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার পরও কেন দরিদ্র মানুষ খোলাবাজার থেকে ন্যায্যমূল্যে খাদ্যশস্য কিনতে পারবেন না? এই প্রশ্নের জবাব কী? আবার স্বয়ংসম্পূর্ণ খাদ্য সেক্টরটিকে সহায়তা দিতে হাজার হাজার কোটি বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে গম আমদানি করতে হয় কেন সরকারকে? ইউক্রেন থেকে গত বছর সরকার ৬.০৪ মেট্রিক টন গম আমদানি করেছেন। ইউক্রেনীয় গম আমদানিকারক হিসেবে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে আছে।
এসব প্রশ্ন উত্থাপন করলেই আওয়ামী লীগের পাতিনেতা বা মধ্যম শ্রেণীর নেতারা বলেন, বিএনপির সময় তো কিছুই করা হয়নি। তারা তো দেশটিকে লুটে নিয়ে গেছে। খাম্বা তারেক বলে তারেক জিয়াকে মার্ক করে বলেন, তিনি তো লুটপাট করেছেন। এ অভিযোগ সবারই জানা, যদি তিনি ৫০০ কোটি টাকা বিদ্যুতের খাম্বার টাকা লুটে নিয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তিনি দোষী। আদালতে তা প্রমাণ করতে হবে। আদালতে নিজেদের দলীয় রাজনীতিককে বিচারক বানিয়ে জেল-জুলুম দিয়ে অন্যায়কে কেউ ন্যায়বিচার বলে না। ধরে নিলাম তারেক জিয়া ৫০০ কোটি টাকা লুটেছেন। আর আপনারা গত ১৪ বছরে বিদ্যুৎ খাত থেকে কত টাকা লুটেছেন? কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের নামে ৫৬ হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন মাত্র কয়েকজন কুইক বিদ্যুৎ উৎপাদককে। ২৪ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদকের সক্ষমতাকে বসিয়ে রেখে উৎপাদন করছেন ১২-১৩ কিংবা সর্বোচ্চ ১৪ হাজার মেগাওয়াট, যা প্রতিদিনের প্রয়োজন। বাকি সক্ষমতা বসিয়ে রেখে ক্যাপসিটি চার্জ দিচ্ছেন তাদের, জনগণের টাকা। এক আদানি পাওয়াকেই দিয়েছেন ৯৯ হাজার কোটি টাকা। আবার ওই বিদ্যুতের ব্যবহার ক্ষেত্র, মানে শিল্প সেক্টরে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার অগ্রগতি এতটাই স্লো যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হতাশ। সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের সম্প্রসারণ ও উন্নীতকরণের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অসাঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা আর অদক্ষ দায়িত্বশীলদের কারণে সরকারের যে পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তার হিসাব কে দেবে?

ঋণ নিয়ে ঘি খাওয়ার যে রাজনৈতিক স্বভাব রাজনীতিকদের, এসব তথ্য-উপাত্ত সংবাদপত্রগুলোতে আজকাল প্রতিদিনই উঠে আসছে। সরকার সমর্থক সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও আজ সরব। পত্রিকায় সংবাদ বিশ্লেষণে উঠে আসছে সেসব তথ্য-উপাত্ত। খোলাবাজারে মূল্যবৃদ্ধি রোধ করার ধারাবাহিক প্রচারণা ও প্রয়াস সত্ত্বেও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসবই উঠে আসছে সংবাদপত্রগুলোতে, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে। ফলে সরকারসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিডিয়াকর্মীদের ওপর ভীষণ রকম নাখোশ। বিশেষ করে পুলিশি অ্যাকশনে তা বারবার প্রমাণ হচ্ছে। গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে পুলিশ সাংবাদিকদের বেধড়ক পিটিয়েছে। তারা সেখানে বিবদমান বা তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ বিএনপি ও আওয়ামীপন্থীদের সরিয়ে দেয়ার প্রয়াস নিতে গিয়ে তারা সাংবাদিকদের ওপর কেন লাঠিচার্জ করল, তার জবাব কি দেবেন কেউ?

সাংবাদিকরা তো তাদের পেশার দায়িত্ব পালন করছিলেন? তারা কেন পুলিশি লক্ষ্যের শিকার হলেন? সেটা কি এ জন্য যে সাংবাদিকরা আজ আর তাদের পেশার দায়িত্বটি এক পাশে তুলে রেখে কোনো দলকে বা সরকারকে সহযোগিতা দেবেন না, এই মনোভাব কর্মভাব দেখাচ্ছেন বলেই কি এই পুলিশি অ্যাকশন? ১৪ বছর তারা এই সরকারকে বহু সহায়তা দিয়েছেন। উন্নয়নের প্রশ্নে সরকার সেসব ছাড় পেয়েছেন। কিন্তু যে সরকারের কাজকর্মে গণতন্ত্রের লেমমাত্র নেই, মানুষের ভোটের অধিকার নেই, কথা বলার অধিকার নেই, নির্যাতন আর নিপীড়নের স্টিম যখন সাংবাদিকদের ওপরও নেমে আসছে, তখন সেই পুলিশি অন্যায়কে তারা ঢেকে রাখবেন কেন?

গণতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামোয় না থাকলে সরকার যে সব উন্নয়ন করেছে, তা রাজনৈতিক কালচারের সাথে খাপ খায় না। দেশের প্রতিটি সরকারের রাজনৈতিক উন্নয়ন কাজই মানবিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে গণতান্ত্রিক চেতনায় কোনো অভিঘাত সৃষ্টি করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই উন্নয়নের কেন্দ্র থেকে তার অভিঘাত তৃণমূল স্তরে না লাগে। কিন্তু গণতন্ত্রহীন এই উন্নয়ন জনগণের বৃহত্তর অংশের চেতনায় কোনো সুচেতনার জন্ম দেয়নি, দিতে পারেনি। সাংস্কৃতিকভাবে রাজনীতিকে সুসমন্বয় দিতে পারলেই কেবল অন্যায়গুলো করার সাহস পায় না কেউ, সে হোক সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাহিনী।
সাংবাদিকদের টার্গেট না করে নিজেদের রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা পরিত্যাগ করুন।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/734966