১৭ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৫৪

নজীরবিহীন একতরফা ভোটগ্রহণ

বিএনপিপন্থী প্রার্থীসহ শতাধিক আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা

উত্তেজনা, হট্টগোল, ধাক্কাধাক্কি ও পাল্টাপাল্টি স্লোগানের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নজিরবিহীন একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপিপন্থী প্রার্থীরা ভোট বর্জন করে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিটি গঠনের জন্য আন্দোলন করেছে। যার ফলে বুধবার ও বৃহস্পতিবার একতরফা ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোট পড়েছে অর্ধেক। এদিকে বিএনপিপন্থী প্রার্থীরা প্রধান বিচারপতির কাছে বুধবারের সকল ঘটনা তুলে ধরে সুষ্ঠু নির্বাচনে তার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কিন্তু এটর্নী জেনারেল বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট বার বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রধানবিচারপতির কোন কিছু করার নেই। এদিকে সুপ্রিম কোর্ট বারে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা বিএনপির প্রার্থীসহ শতাধিক আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে শাহবাগ থানায়।
মূলত নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটি গঠনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থান নেন। গত সোমবার এই উপকমিটির আহ্বায়ক মনসুরুল হক চৌধুরী পদত্যাগ করলে কোন কমিটির অধীনে নির্বাচন হবে তা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। এর আগে দুই পক্ষ মিলেই মনসুরুল হক চৌধুরী আহ্বায়ক করার বিষয়ে একমত হয়েছিল।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা আগেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে পাল্টাপাল্টি স্লোগান দেন। গতকাল দুপুর ১২টার দিকেও দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। এবারের নির্বাচনে ৮ হাজার ৬০২ জন ভোটারের মধ্যে দুইদিন ৪ হাজার ১৩৭ ভোট পড়েছে। গণনার পর ফলাফল ঘোষণা করা হবে। দিনভরই ছিল উত্তেজনার। সমিতি ভবন ও প্রাঙ্গনসহ ভোটারদের প্রবেশের জন্য গড়া ভোটের প্যান্ডেলের সামনে ছিল বিপুলসংখ্যক পুলিশ।
বিগত বছরগুলোতে নির্বাচনের সময়ে ভোটের প্যান্ডলের সামনে দুপক্ষের প্রার্থীরা উপস্থিত থাকতেন। প্রার্থীরা ব্যালট নম্বর উল্লেখিত তাদের পরিচিতির কার্ড ভোটারদের হাতে তুলে দিতেন। তবে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেলের আইনজীবীদের পক্ষে ভোটারদের হাতে কার্ড তুলে দিতে দেখা গেলেও বিএনপি সমর্থিত প্যানেল থেকে মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে এ-সংক্রান্ত কার্ড তুলে দিতে দেখা যায়নি।

বেশ কয়েকজন আইনজীবীর ভাষ্যমতে, সমিতির এবাবের ভোটকে ঘিরে উৎসবের আমেজ ছিল না, ছিল এক ধরনের উত্তেজনা।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা জোরে জোরে স্লোগান দিতে থাকেন। একদল ‘ভোট চোর, ভোট চোর’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। অন্য পক্ষ আবার এর উত্তর দিতে থাকে। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এ সময় তুমুল উত্তেজনা শুরু হয়। পুলিশও মাঝে দাঁড়িয়ে সতর্ক অবস্থায় থাকে। তবে এ সময় ভোট গ্রহণ চলছিল।

আপিল বিভাগে বিএনপিপন্থীরা
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের আপিল বিভাগে ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা দুজন ১১ টার সময় খাস কামরায় আসেন। প্রয়োজন হলে অ্যাটর্নি জেনারেলকে ডেকে নেবো।’

সকাল নয়টার আগে থেকেই আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির এজলাসে (১ নম্বার বিচারকক্ষে) আসতে শুরু করেন বিএনপিপন্থী তিন আইনজীবী। সকাল ৯ টা ২৭ মিনিটে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতি ও অপর সাত বিচারপতি।
এরপর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আদালত প্রাঙ্গণে নজীরবিহীন ঘটনা গতকাল (বুধবার) ঘটেছে, যা চলমান। আজও রুমে তালা লাগানো আছে, অনেকের রুমের চারপাশে পুলিশ দেওয়া হয়েছে। বাইরে থেকে এ ঘটনার পেছনে কেউ আছে কিনা তা দেখতে হবে। এই অঙ্গনে এটা কি অনুমোদিত? তারা সমিতির জ্যেষ্ঠ সদস্যদেরও নির্যাতন করেছে। আমরা সুরক্ষা চাচ্ছি।

সমিতির নির্বাচনে বিএনপি প্যানেল থেকে সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘আপনারা দেশের বিচার বিভাগের অভিভাবক। তাই প্রত্যেকের ব্যাথা, কষ্ট অভিভাবক হিসেবে অবহিত করা উচিত। সমিতির নির্বাচন হয় সব সময় উৎসবমুখর। তবে এবার কি হলো? আজও আমি রুমে ঢুকতে পারিনি। রুমের বাইরে থেকে তালা লাগানো। কক্ষের সামনে পুলিশ রয়েছে। হাজার হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অনেক আইনজীবীরা আহত হয়েছে। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। গতকালের ঘটনা দেখেছেন, পুলিশ কীভাবে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দিয়েছে। আমরা কী অপরাধ করেছি? আমি প্রার্থী আমি কেন ভোট কেন্দ্রে থাকতে পারবো না? ‘

কয়েকটি পত্রিকা আদালতে উপস্থাপন করে রুহুল কুদ্দস বলেন, ‘আপনারা এ অঙ্গণের অভিভাবক। আপনারা দেখেন। বিচারপতি মনসুরুল হক চৌধুরীকে প্রধান করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করা হয়। ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় প্রার্থী পরিচিতি সভায় তিনি দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু হঠাৎ কি হলো? তিনি পদত্যাগ করলেন। ‘

নির্বাচনে প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে ঘায়েল করতে মামলা করা হয় উল্লেখ করে রুহুল কুদ্দুস বলেন, এরপর রাতে মো. মনিরুজ্জামান (নির্বাচন উপ কমিটির আহ্বায়ক) সাহেব বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। আমাকে ও সভাপতি প্রার্থীসহ অনেককে আসামী করা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় আরেকটি মামলা করেছে সমিতির প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দিয়ে। সেখানে সমিতির বর্তমান কমিটির ৬ জন সদস্যকে আসামী করা হয়েছে।

এ সময় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘মি. রুহুল কুদ্দুস আপনাদের সবাইকে সম্মান করি। আপনারা ২ জন ১১টার সময় (বিরতি) আসেন। কোনো করণীয় থাকলে করবো। প্রয়োজনে অ্যাটর্নি জেনারেলকেও ডেকে নেবো।
সমিতির সভাপতি পদপ্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘নজিরবিহীন ঘটনা। ভোটকেন্দ্রে তিন চারশ পুলিশ ঢুকে ধাক্কা দিতে থাকে। সবাই পড়ে যাচ্ছিল আর পুলিশ পা দিয়ে পাড়িয়েছে। আমার পায়ে ব্যাথা আমি ঠিকমতো দাড়াতে পারছি না। অনেক আইনজীবী এবং সাংবাদিকদের আহত করা হয়েছে।

এ সময় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘এ কথাগুলো ভেতরে বসে শুনি। ১১ টায় আসেন, আমরা আপনাদের কথা শুনবো। এখন কোর্টের কাজ করি। ‘

প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই: অ্যাটর্নি জেনারেল
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি বেসরকারি সংগঠন। এখানে প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই। প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির সঙ্গে দেখা করার পর গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া একটার দিকে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, প্রধান বিচারপতি ডেকেছিলেন, উনার কক্ষে গিয়েছিলাম। তখন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা বসে ছিলেন। উনারা আমাকে জানান, বিএনপি থেকে সমিতির বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক প্রার্থী কথা বলতে গিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, এটি সমিতির বিষয়, আমাদের করণীয় নেই। প্রধান বিচারপতির এখানে কিছু করার নেই। এটি আপনারা যাঁরা এ বিষয়ে বিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে সবাই মিলে পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার চেষ্টা করেন। যেহেতু এটি প্রাইভেট সংগঠন, সমিতির বিষয়। প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই।’

আমিন উদ্দিন বলেন, এবার যেহেতু আগের দিন রাতের বেলায় মাহবুব উদ্দিন খোকন ও অন্যরা ব্যালট পেপার নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়ার কারণে সমিতির বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক পুলিশের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ এসেছিল, তা বলেছি।

এদিকে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ব্যালট পেপার চুরি ও ছিঁড়ে ফেলা এবং নির্বাচনসংক্রান্ত আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বাইরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগে বুধবার সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মো. মনিরুজ্জামান। মামলায় বিএনপিপন্থী আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন, রুহুল কুদ্দুসসহ ১২ জন আইনজীবীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১০০ জনকে আসামী করা হয়েছে।

https://dailysangram.com/post/519497