১৫ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ১২:৩৪

কেউ শুনছে না বুড়িগঙ্গার কান্না

ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা এখন মৃত। দূষিত-দুর্গন্ধময় পানি বুকে ধারণ করে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে এ নদী। অথচ বুড়িগঙ্গার এ কান্না কেউ শুনছে না। নদীর তীরে গড়ে উঠা শত শত অবৈধ শিল্পকারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত দূষিত পানি সরাসরি মিশছে বুড়িগঙ্গায়। এ ছাড়া রাজধানীর পয়োঃবর্জ্য অর্থাৎ ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইনের দূষিত বর্জ্যও সরাসরি যাচ্ছে নদীতে। কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গার তীরে অন্তত তিন থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শতাধিক ডকইয়ার্ডগুলো বা জহাজনির্মাণ কারখানা গড়ে উঠেছে। তীর দখল করে বছরের পর বছর চলছে এসব জাহাজনির্মাণ কারখানা। বেশিরভাগ ইয়ার্ডেরই পরিবেশগত ছাড়পত্র তো নেই, এমনকি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডবিøউটিএ) অনুমোদনও নেই। পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি এসব ডকইয়ার্ডের কারণে দেশের অন্যতম নদীবন্দর সদরঘাটের নৌপথ সংকুচিত হচ্ছে।

এক যুগেরও বেশি সময় আগে নদীকে জীবন্তসত্তা হিসেবে অভিহিত করে হাইকোর্ট যে কোনো মূল্যে নদী বাঁচানোর আদেশ দিলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এ আদেশ কেউই আমলে নিচ্ছে না। পরিবেশ অধিদফতর, ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। বিরামহীনভাবে নদী দখল ও দূষণ চলছে। প্রতিনিয়ত স্যুয়ারেজের বর্জ্য এবং কলকারখানার দূষিত তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় মিশছে।

মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) করা এক রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১১ সালে এক রায়ে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর থেকে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়। এ ছাড়া নদীর পানি যাতে দূষিত না হয় সে জন্য সব ধরনের বর্জ্য ফেলা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। এই রায়ের ভিত্তিতে পরবর্তী কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা একেবারেই সামান্য। আদালতের নির্দেশ কার্যকর না হওয়ার বিষয়টি পুনরায় নজরে আনার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বুড়িগঙ্গা নদীতে সংযোগ হওয়া ওয়াসার সব স্যুয়ারেজ লাইন ও পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়া বুড়িগঙ্গার দুই তীরে গড়ে ওঠা শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় পড়ছে সেসব প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদে সময় বেধে দেয় হাইকোর্ট। এজন্য ঢাকা ওয়াসাকে ছয় মাস ও পরিবেশ অধিদফতরকে এক মাস সময় দেওয়া হয়। এর আগে অসত্য তথ্য দেওয়ার দায়ে ওয়াসার এমডি আদালতে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে। তখন ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ঢাকা ওয়াসার কোনো স্যুয়ারেজ লাইন পতিত হয়নি। আদালতের সেই সময় বেধে দেওয়ার আদেশের পরও প্রায় ৫ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে তরল বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে, যা নদীর পানিকে দূষিত করছে। স্যুয়ারেজ লাইনের বর্জ্যও সরাসরি বুড়িগঙ্গায় যাচ্ছে। বলা হতো হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি চলে গেলে বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত হবে। ট্যানারিগুলোকে সাভারে ধলেশ্বরীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপরও বুড়িগঙ্গার পানি আগের মতোই কালো-দুর্গন্ধময় রয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় এখন ২ কোটিরও অধিক মানুষের বসবাস। প্রায় সবার পয়োঃবর্জ্যই পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। এসব ড্রেনেজ ব্যবস্থার দায়িত্বে রয়েছে ওয়াসা এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু পয়োঃবর্জ্য পরিশোধন না করে সরসারি নদী ও খালে ফেলা হচ্ছে। যা গিয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়।

বুড়িগঙ্গার তীরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠেছে শত শত শিল্পকারখানা। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া গড়ে ওঠা এসব শিল্পকারখানা থেকে প্রতিনিয়ত দূষিত তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় মিশছে। তাতে নদীটির মৃত্যু হচ্ছে। অবৈধভাবে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ২৩১ শিল্পকারখানা অবিলম্বে বন্ধে পদক্ষেপ নিতে ২০২০ সালে উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। অভিযোগ রয়েছে যে পরিবেশ অধিদফতরের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এসব অবৈধ কলকারখানা চলছে।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট এডভোকেট মনজিল মোরসেদ ইনকিলাবকে বলেন, নদী রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে কতৃপক্ষ একেবারেই উদাসীন। তারা মনে করে নদী মরে গেলে তাদের কি। এতে তাদের কোনো সমস্য হয় না, বা হবে না। আদালতের বিচারকদেরতো রায় মাঠে গিয়ে অবৈধ কলকারখানা বন্ধ করার ক্ষমতা নেই। এটাতো করবে প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ। তারা সেটা করছে না। এটা খুবই দুঃখজনক। নদী মরে গেলে দেশ মরে যাবে এই উপলব্দিটা তাদের মধ্যে নেই। আমরা এ বিষয়টি আবারও আদালতের নজরে আনব এবং আদালত যাতে আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তার আবেদন জানাব।

বুড়িগঙ্গা নিয়ে কেবল আশার কথাই শোনা যায়। বাস্তবে নদীটির তীরে গেলে হতাশাই বাড়ে। চরম দূষণ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। গত কয়েক বছরে বুড়িগঙ্গা রক্ষায় কার্যকর কোনও প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়নি। সরেজমিনে বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী চর কালিগঞ্জ ও চর মীরেরবাগে ঘুরে দেখা গেছে, নদীর সীমানা পিলারের অনেক ভিতরে ডকইয়ার্ডগুলোতে চলছে নতুন জাহাজ ও লঞ্চ তৈরির কাজ। পাশাপাশি নদীতে নোঙর করে চলছে পুরোনো জাহাজ মেরামতের কাজও। বালি ফেলে নদী ভরাটের দৃশ্যও দেখা গেছে। বিভিন্ন ইয়ার্ড থেকে জাহাজ তৈরি ও ভাঙার বিভিন্ন অংশও নদীতেই ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া মেরামতের সময় পুরোনো জাহাজে থাকা ডিজেল, লুব্রিক্যান্টসহ তলদেশে থাকা বিভিন্ন বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশে যাচ্ছে।

নদী বাঁচানোর চেষ্টায় নিয়োজিত সংস্থা ওয়াটার কিপারস বাংলাদেশের সমন্বয়কারী শরীফ জামিল ইনকিলাবকে বলেন, বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর নামে যা করা হচ্ছে তাতে ফল হচ্ছে উল্টো। নদী রক্ষার নামে নদীকে আরও হত্যা করা হচ্ছে। ওয়াকওয়ে, সীমানা পিলার, গ্রিনেজ, ইকোপার্ক প্রকল্প ইত্যাদি নদীকে বাঁচাতে নয়, উল্টো ধ্বংসের কাজ করছে। নদীকে খালে পরিণত করা হচ্ছে। নদীর সঙ্গে যুক্ত ছোট ছোট খালগুলো ভরাট করা হচ্ছে। যারা এই ধ্বংস রোধ করতে পারতেন তারাই হাতে ধরে ধ্বংস করছেন। তিনি বলেন, নদীকে বাঁচাতে আদালত যে আদেশ দিয়েছিলেন সেগুলো ভুলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আদালতের আদেশ অনুযায়ী, নদী বাঁচাতে কাজ করবে নদী কমিশন। কমিশনকে শক্তিশালী করা এবং আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু নদী বাঁচাতে কাজ করছে অন্য সংস্থা। আদালতের আদেশ মানলেও বুড়িগঙ্গা বাঁচার কিছুটা সম্ভাবনা থাকে।

https://www.dailyinqilab.com/national/article/562169