২০ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৮

এই নৈরাজ্যের শেষ কোথায়?

গণপরিবহন, গণস্বাস্থ্য, গণতন্ত্র, গণগ্রন্থাগার, গণরায়, গণনীতি এই ‘গণ’ শব্দগুলোর ট্র্যাজেডি হচ্ছে সর্বত্রই ‘গণ’ (গণমানুষ) থাকেন উপেক্ষিত। গণমানুষের স্বার্থের দোহাই দিয়ে শব্দগুলো ব্যবহৃত হলেও মানুষের সুবিধা-উপকার হয় এমন চিন্তা-চেতনা ধর্তব্যেই নেন না কর্তাব্যক্তিরা। রাজধানী ঢাকার বাসে গণদুর্ভোগ কমাতে ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধ করে ‘নোকাল সার্ভিস’ চালুর ঘোষণা এলো। যাতায়াতে নিত্য দুর্ভোগে পড়া মানুষ নড়েচড়ে বসল। ওই ‘থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়’! পরিবহন মালিকদের চাপে আবার সে সিদ্ধান্ত ১৫ দিন স্থগিত করতে বাধ্য হলো। যাতায়াতে জনদুর্ভোগ কমলো না বরং বাড়ল। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যাত্রী হয়রানি এবং বাড়তি ভাড়া আদায়ে বাসের মালিক-শ্রমিকদের যেন ষোলকলা পূর্ণ হলো। গোঁদের উপর বিষফোঁড়া যাত্রীদের কপালে এখন জুটছে ড্রাইভার-হেলপার-কন্ট্রান্টরদের অশোভন আচরণ, খিস্তিখেউর, নারী যাত্রীদের হেনস্তা। কাজের কাজ কিছুই হলো না; বরং বাড়ল ভোগান্তি-যন্ত্রণা। আগে সিটিং সার্ভিসে যেটুকু সেবা ও স্বস্তি ছিল, সেটাও উধাও হয়ে গেল। গণপরিবহনে যে নৈরাজ্য ছিল সেটা গেল বহুগুণে বেড়ে।
ঢাকা শহরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহর পৃথিবীতে কমই আছে। প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ২০ হাজার জনের উপরে মানুষ বসবাস করে। আবার প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার লোক ঢাকায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের চলাচলের জন্য ঢাকা শহরে বাসের ২৬৮টি রুট আছে। বাসের সিলিং আছে ৭৩৬২টি। চলাচল করে ইস্যুকৃত ৫৪০৭টি বাস। শহরের রাস্তার ধারণ ক্ষমতা যাই হোক মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় এ বাস খুবই কম। দুর্ভোগ কমাতে সরকারের উচিত ছিল বাসের সংখ্যা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া। মিনিবাসের বদলে বড় বড় বাস রাজধানীতে নামানো। সে পথে না গিয়ে বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি ও শ্রমিকদের সিন্ডিকেটের হাতে সরকার যেন বন্দি হয়ে গেছে। জনগণের সুবিধা-অসুবিধার দোহাই দেয়া হলেও সিন্ডিকেটের ইচ্ছার ষোলকলা পূর্ণ করতেই যেন সরকার সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিয়ে যাত্রীদের সেবা নামে নাটকের জন্ম দিয়েছে। আর বাস মালিকদের হাত এতই লম্বা যে, দেশের আইন-আদালত এমনকি সরকারের চেয়েও তারা বেশি ক্ষমতাবান! কয়েক মাস আগেও আদালত একজন দু’জন বাস ড্রাইভারের দÐাদেশ দেয়ার প্রতিবাদে হঠাৎ পরিবহন ধর্মঘট করে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দেয়া হয়। একাধিক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের লোকজন এই আন্দোলনের পেছনে ইন্দন দেয়ায় সরকারকে পরিবহন শ্রমিকদের দাবির প্রতি নতি স্বীকার করতে হয়।
১৫ এপ্রিল থেকে রাজধানী ঢাকায় ‘সিটিং বাস সার্ভিস’ বন্ধের কার্যক্রম শুরু হয়। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করতে এই সিদ্ধান্ত নেয় বিআরটিএ। ‘সিটিং সার্ভিস’ ও ‘গেটলক’ বাসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে বিআরটিএ। এতে উল্টো ভোগান্তিতে পড়ে বাস যাত্রীরা। একদিকে সিটিং বাসের ভাড়া দিয়ে লোকাল বাসে চলাচল; অন্যদিকে অর্ধেক বাস রাস্তায় না নামায় পরিবহন সংকটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আবার সিটিং সার্ভিস বন্ধের অভিযান চলায় কখনো ‘লোকাল’ কখনো ‘সিটিং সার্ভিস’ চালানো হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত কয়েকটি পয়েন্টের আইন ভঙ্গকারী বাসের বিচার করে জরিমানা করছে আবার বাসও ইচ্ছামত চলছে। এ যেন ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’।
রাজধানীর অধিকাংশ কর্মজীবী মানুষ কর্মস্থলে বাসে যাতায়াত করেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশের বাহন পাবলিক বাস। প্রতি বছর সরকার বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য বাড়লেও ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন রুটের বাস মালিকরা সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করে। পরিবহন সেক্টরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়। সেই চাঁদা আদায় হয় যাত্রীদের কাছ থেকেই। আবার সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন রুটে নতুন বাস নামলেই ‘সিটিং সার্ভিস’ নাম দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে কার্যত যাত্রীদের সঙ্গে চিটিং করা হয়। ১৫ এপ্রিল থেকে রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা হয়। হঠাৎ করে সিটিং সার্ভিস বন্ধে নতুন বিপদে পড়ে যাত্রীরা। এখন একদিকে বাস মালিক সমিতির কিছু নেতা খন্দকার এনায়েতের নেতৃত্বে সিটিং সার্ভিস বন্ধের তৎপরতা চালিয়ে ক্যামেরায় পোজ দিয়ে ‘হিরো’ হন; অন্যদিকে বিআরটিএ পথে পথে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে আইন অমান্যকারী বাসের অর্থদÐ ও শ্রমিকদের মৃদু শাস্তি দেন। দুর্ভাগ্যজনক হলো এতে গণমানুষ তথা যাত্রীদের ভোগান্তি আরো বেড়েছে। রাজধানীতে এমনিতেই অপ্রতুল বাস; তার ওপর সিটিং সার্ভিস বন্ধ করায় বাসের মালিকরা বাস রাস্তায় নামানো থেকে বিরত থাকেন। যারা সিটিং সার্ভিসকে লোকাল হিসেবে চালান তারাও যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া সিটিং সার্ভিসেরই নেন। সরকার হুমকি দিচ্ছে বাস রাস্তায় না নামালে রুট পারমিট বাতিল করা হবে। সে হুমকি তোয়াক্কা করছে না বাসের মালিকরা। কারণ, বাসের মালিকদের মধ্যে সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছাড়াও এমপি, দলীয় লোকজন বেশি। যারা সাধারণ বাস মালিক তারা জানেন কীভাবে রুট পারমিট পেতে হয়। বাস্তবতা হচ্ছে সিটিং সার্ভিস তো বন্ধ হয়নি বরং অতিরিক্ত ভাড়ায় ডাইরেক্ট বাস সার্ভিস নামে গাদাগাদি করে যাত্রীদের যাতায়াত করতে হয়। চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় সকালে অফিসগামী যাত্রী, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও নারী যাত্রীদের। সরকারের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঢাকায় কৃত্রিম বাস সঙ্কটের সংবাদও আসে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাস্তবতার কারণে পরিবহন সংকট দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। অভিযানের কারণে যেসব গাড়ি রাস্তায় নামছে না তাদের জোর করে নামানো সম্ভব নয়। গাড়ির মালিকরা সামান্য কেউ নন তারা প্রভাবশালী। প্রশ্ন জাগে, সরকারের নীতি -নির্ধারকদের চেয়ে কি বাস মালিকদের ক্ষমতা বেশি। তারা কি সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ঊর্ধ্বে? গণপরিবহনের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ?
সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণার প্রথম দিনেই ভাড়া নিয়ে টালবাহানা শুরু করে সিটিং সার্ভিসের লেবাসে চলা লোকাল পরিবহনগুলো। সিটিং সার্ভিস বন্ধ করে লোকাল চলাচল শুরুর পর থেকেই বাসগুলোতে যাত্রী গাদাগাদি করে নেয়া শুরু করে। যাত্রী টইটুম্বর না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি ছাড়া হয় না। বৈশাখের এই প্রচÐ ভ্যাপসা গরমে যাত্রী হিসেবে মানুষ নয়, যেন পণ্যভর্তি বস্তা উঠানো হয়। আবার ভাড়াও নেয়া হচ্ছে বেশি। সরকার নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী, রাজধানীতে চলাচল করা মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা। আর বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা। সর্বনিম্ন ভাড়ার পাশাপাশি সরকার প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া এক টাকা ৪২ পয়সা করে নির্ধারণ করে দিয়েছে। কার্যত বাস মালিকদের কেউই তা মানছে না। যাত্রী কল্যাণ সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, শহরে সিটিং সার্ভিস বন্ধে সরকারি অভিযানের মধ্যে মিরপুর রুটে অধিকাংশ বাসে মাস্তান রেখে যাত্রীদের শায়েস্তা করা হচ্ছে। বাড়তি ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন তুললেই যাত্রীদের অপদস্থ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় সরকারের সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নগরীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী যানবাহনের প্রায় ৪০ শতাংশ রাস্তায় নামানো হয়নি। বাসে চলতে গিয়ে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ নাগরিকেরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন। বাসে সরকারি ভাড়ার তালিকা দেখতে চাওয়ায় বা তালিকা অনুযায়ী ভাড়া দিতে চাওয়ায় অনেক যাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার এমনকি হাত তোলার মতো ঘটনা ঘটছে। সবশেষে যে খবর নগরবাসী পেলেন তা হলো ১৫ দিনের জন্য সিটিং সার্ভিস বন্ধের অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো যাদের চাপে সিটিং সার্ভিস বন্ধের কার্যক্রম ১৫ দিনের জন্য স্থগিত করা হলো তাদের হাত কী সরকারের হাতের চেয়ে লম্বা? পরিবহন সেক্টরের এই নৈরাজ্যের শেষ কোথায়? কার হাত বেশি লম্বা? সরকারের না পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের? নগরবাসীর প্রশ্ন, পরিবহন সেক্টরের এই রামরাজত্বের অবসান হবে হবে?

 

https://www.dailyinqilab.com/article/75723/