১৪ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ৯:০২

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভিন্ন ব্যস্ততায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে অপরাধীরা

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যস্ততার সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে অপরাধীরা। সম্প্রতি বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ এবং ভিআইপিদের নিরাপত্তা দিতেই ব্যস্ত থাকতে হয় পুলিশকে। এ সুযোগে রাজধানীতে ডাকাত ও ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। গত বৃহস্পতিবার সকালে তুরাগের দিয়াবাড়ী এলাকায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের গাড়ি থেকে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তবে এর মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই উত্তরা এলাকা থেকে ছিনতাই হওয়া টাকার মধ্যে তিন কোটি ৮৯ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এরপর আরও দুই কোটি ৫৩ লাখ টাকা উদ্ধার এবং ৮ জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ ঘটনার পর র‌্যাব ও পুলিশ রাজধানীতে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ৩৪ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে।

ডিএমপির অপরাধ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা মহানগরীতে মামলা হয় ১৪৫টি, ২০২০ সালে ১৭৬টি, ২০১৯ সালে ১৫৫টি, ২০১৮ সালে ২১৬টি, ২০১৭ সালে ১০৩টি, ২০১৬ সালে ১৩২টি, ২০১৫ সালে ২০৫টি ও ২০১৪ সালে ২৬৫টি মামলা দায়ের হয়। র‌্যাবের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ১১৫০টি অভিযান পরিচালনা করে ২৪৩৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ২০২১ সালের ৫০২টি অভিযানে ১০৫৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৯৯৪৭ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজধানীর ৫০টি থানায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় যে মামলা হয় বাস্তব ঘটনা তার চেয়ে অনেক বেশি ঘটে থাকে।

সূত্রমতে রাজধানীতে বেশি ছিনতাই হচ্ছে এমন এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদপুর থানা এলাকা। নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকা হওয়ায় বেশি ছিনতাই হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন অস্ত্রের মুখে মোবাইল নিয়ে নদীর ওপারে চলে যায়। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত যে কয়টি মামলা হয়েছে তার প্রায় সব আসামীকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। কিন্তু তারা জামিনে বের হয়ে ফের একই অপরাধে জড়াচ্ছে। কাওরানবাজার এলাকায়ও ছিনতাই বেশি হয় বলে জানিয়েছে পুলিশের একাধিক সূত্র। এছাড়াও বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে এখন এ ধরনের ছিনতাইকারী গ্রুপ সক্রিয়। বিশেষ করে পান্থপথ, আড়ং ক্রসিং, আসাদ এভিনিউ, শ্যামলী, ধানমন্ডি-১৫, কলাবাগান, আগারগাঁও, ফার্মগেট, মিরপুর-১০, মিরপুর-২, কাজিপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া, পল্টন, মতিঝিল, মৌচাক, মগবাজার, কাকরাইল, যাত্রাবাড়ী, দয়াগঞ্জ, ওয়ারী, ফকিরাপুল, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা জসিমউদ্দীন রোড, আব্দুল্লাহপুর এলাকায় এরা বেশি সক্রিয়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ বলেছেন, অজ্ঞানপার্টির চক্রদের হাত থেকে যাত্রীদের রক্ষায় গণপরিবহনে চালক ও হেলপারদের উচিত হকারদের উঠতে না দেয়া। মো. হারুন অর রশীদ বলেন, যাত্রীর বেশে গাড়িতে উঠে অন্য যাত্রীদের অজ্ঞান করে মালামাল লুট করছেন তারা। গাড়িতে চালক ও হেলপারদের উচিত হবে হকার উঠতে না দেয়া। আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে, এরপর অভিযানে অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের গ্রেফতারও করা হয়েছে এবং তারা স্বীকারও করেছেন এ কাজ তারা করেন। তারা বলেছেন, বাসে, ট্রেনে ও লঞ্চে এ ধরনের কাজ বেশি করে থাকে। অনেকের নামও আমরা পেয়েছি। গণপরিবহনে হকারদের নিরুৎসাহিত করতে তাই বাসচালক ও হেলপারদের আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। পুলিশ বলছে, সাধারণত ঈদকে টার্গেট করে অজ্ঞান পার্টি সক্রিয় হলেও তাদের অনেকেই পেশাদার অপরাধী, যারা ১২ মাসই এসব অপকর্মে করে বেড়ান।

পুলিশ আরও জানায়, দুই থেকে তিন ধরনের ঘুমের ওষুধ গুঁড়া করে এরসঙ্গে চ্যাবনপ্রাশ মিশিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ টোটকা। যা খেলে মানুষের নেশা ও তীব্র ঘুম আসে। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন সেবনকারী। মিজান নামে এক ব্যক্তি একসময় তরকারি বিক্রি করতেন। বর্তমানে অজ্ঞান কিংবা মলম পার্টির একজন সক্রিয় হিসেবে এখন তিনি বিশেষ হালুয়া তৈরি করেন। এ বিদ্যা তিনি রপ্ত করেছেন কয়েক বছরের চেষ্টায়। তার তৈরি করা হালুয়া খেয়ে এখন পর্যন্ত অজ্ঞান হয়েছেন প্রায় ৭০০ মানুষ। একা নন, তার দলে আছে আরও চারজন। এ কাজে সবার দায়িত্ব আলাদা আলাদা বলে জানান মিজান। মিজান পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, পাঁচজনের দলটি অজ্ঞান করার ওষুধ নিয়ে বাসে ওঠেন। একজন হকার সেজে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। বলা হয়, পেটব্যথা, মাথাব্যথা, গ্যাস্ট্রিক ও যৌন সমস্যার সমাধান মিলবে তাদের তৈরি করা দাওয়াই খেলে। টার্গেট ব্যক্তিকে প্রলুব্ধ করতে নিজেরাই কেউ কেউ কিনে খান। এভাবেই তারা কাজটি করে আসছেন। বাসে, ট্রেনে বা লঞ্চে মানুষকে অজ্ঞান করে সবকিছু লুটে নেয়ার পাশাপাশি প্রায়ই বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে থাকে বলে জানায় পুলিশ।

এদিকে রাজধানীর উত্তরায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত আটজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুই কোটি ৫৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে ছিনতাই হওয়া সোয়া ১১ কোটি টাকার মধ্যে মোট উদ্ধার হলো ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা। গতকাল রোববার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিক সম্মেলনে এসব কথা জানান ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, রাজধানীর মিরপুর, বনানী, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে এ টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আটকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার সকালে তুরাগ থানাধীন দিয়াবাড়ী ১১ নম্বর সড়কে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের গাড়ি থেকে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই উত্তরা এলাকা থেকে ছিনতাই হওয়া সোয়া ১১ কোটি টাকার মধ্যে তিন কোটি ৮৯ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এর আগে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়কমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিংয়ের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) সাদেক হোসেন চৌধুরী আহত হয়। রাজধানীর বেইলি রোডের পার্বত্য মন্ত্রীর বাসভবন থেকে দাপ্তরিক কাজ শেষে ফার্মগেট নিজ বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তিনি। গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় এ ঘটনা ঘটে। গতকাল শুক্রবার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এপিএসকে বহনকারী গাড়িটি কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারা অতিক্রম করার সময় এক ছিনতাইকারী এপিএসের হাতে থাকা মোবাইল ফোন ধরে টান দেয়। এপিএস এ সময় ছিনতাইকারীকে বাধা দিলে ছিনতাইকারী তার হাতে ছুরির আঘাত করে পালিয়ে যায়। আহত সাদেক হোসেন বর্তমানে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত ২২ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে ‘ছিনতাইকারীর’ ছুরিকাঘাতে অজ্ঞাতনামা এক যুবক নিহত হয়েছেন। তার বয়স আনুমানিক ৩০ বছর। ভোর সাড়ে ৩টার দিকে ধলপুর বউবাজার এলাকায় এ হত্যাকা- ঘটে। ছুরিকাঘাতে মুমূর্ষু অবস্থায় পথচারীরা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই যুবককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া অটোরিকশাচালক মো. রুবেল হোসেন জানান, ভোর সাড়ে ৩টার দিকে ধলপুর বউবাজার এলাকার রাস্তায় তাকে পড়ে থাকতে দেখেন। তখন তিনি তাকে রিকশায় উঠাতে গিয়ে দেখেন, তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে। পরে তাকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর মারা যায়।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১টার দিকে কাজ শেষে উত্তর বাড্ডার বাসায় ফিরছিলেন গুলশানের ফাইভ স্টার নামে একটি রেস্টুরেন্টের

কর্মচারী সুমন্দ্র পাল (২৭)। উত্তর বাড্ডায় যাওয়ার পথে লাজ ফার্মার সামনে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন তিনি। এসময় ছিনতাইকারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় তার। এক পর্যায়ে ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল চিকিৎসাধীন অবস্থায় (১৫ ফেব্রুয়ারি) ওই যুবকের মৃত্যু হয়।

https://dailysangram.com/post/519212