১৩ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ১২:০৪

টেকসই উন্নয়ন : ডিম আগে না মুরগি আগে

-ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

বিশে^র সবচেয়ে পুরনো বিতর্ক- ডিম আগে না মুরগি আগে। এ বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি, কেয়ামত পর্যন্ত এ বিতর্ক বহাল তবিয়তে থাকবে- এটা বোঝা যায়। যেমন বোঝা যায় বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণ, সেখানে অবস্থান এবং সেখান থেকে নামা কিংবা নামানোর ক্ষেত্রে যে বশংবদ বিতর্ক তাতে ডিম আগে না মুরগির মতো অবস্থা।
এ বিতর্কে যুক্তি সব সময় কাজ করে না- এটা যেন সেই নাছোড় বান্দা ছেলেটির মতো ‘কলাটা ছিলে (খোসা ছাড়িয়ে) দাও’, দাবি ও বায়নার মুখে কলাটার খোসা ছাড়ানো হলো, এখন সেটা তার পছন্দ হলো না, সে এখন জেদ ধরল ওটা বুজে (বন্ধ করে) দিতে হবে। খোসা খুলতেই বা কেন বলা হলো আবার এখন তা বন্ধের বায়না বা জেদ কেন।

পরের উপমা গল্পটা শেকসপিয়রের কালজয়ী নাটক ম্যাকবেথের। রাজা ডানকান তার অতি বিশ^স্ত সেনাপ্রধান ম্যাকবেথের বাসায় রাত যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। লেডি ম্যাকবেথ রাজাকে নিদ্রা যাওয়ার আগে জানতে চাইলেন তিনি এখানে কেমন (নিরাপদ) বোধ করছেন। রাজা বললেন, নিজের সেনাপতির বাসার চেয়ে আর কোথায় তিনি নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারেন। নিজেকে অতি নিরাপদ ভাবতে ভাবতে পরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে গেলেন তিনি। এদিকে সেনাপতি ম্যাকবেথকে একবার ডাইনিরা বলেছিল ‘ম্যাকবেথ রাজা হবে’। লেডি ম্যাকবেথের মনে পড়ে গেল সে ভবিষ্যদ্বাণীর কথা। তিনি তার স্বামী ম্যাকবেথকে প্ররোচিত করতে শুরু করলেন, এই তো মোক্ষম সুযোগ, রাজাকে হত্যা করার, তোমার রাজা হওয়ার পথ হবে পরিষ্কার। স্ত্রীর বারম্বার প্ররোচনায় ক্ষমতান্ধ ম্যাকবেথ রাজাকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করলেন, যাকে তিনি সর্বাধিক বিশ^স্ত ভেবেছিলেন তার হাতেই ‘নিরস্ত্র¿’ ও কোনো প্রকার প্রতিরোধ ছাড়া রাজা নিহত হলেন। হত্যার সময় রাজার রক্ত হাতে লেগেছিল তাদের। ম্যাকবেথ ও তার স্ত্রী আমৃত্যু হাত কচলিয়ে, সৌদি আরবের সুগন্ধি মেখেও সেই রক্তের দাগ মুছতে বা ভুলতে পারেননি।

‘ঘুমন্ত’ নিরীহ রাজাকে নির্মম নিষ্ঠুর হত্যার জন্য মানসিক রোগে, অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতে হতে ম্যাকবেথ পরিবার থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেল। প্রকৃতির অমোঘ প্রতিশোধের প্রতীক হিসেবে দার্শনিক নাট্যকার শেকসপিয়র রূঢ় মন্তব্য ছুড়তে পিছপা হননি- ম্যাকবেথ হ্যাজ কিল্ড দ্য স্লিপ সো হি উইল নট স্লিপ এনি মোর। ক্ষমতা পাওয়া, ধরে রাখা ও যাওয়ার জন্য যে সমাজ ও দেশে মানবিক মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, সুশাসন যখন ক্ষমতাসীন ক্ষমতালোভীদের হাতে নিহত হয়েছে, তারা তত আস্থা হারিয়েছে, তাদের প্রজন্মরাও সহজে সেটি পাবে না। ন্যায়নীতিনির্ভর গণতন্ত্রের প্রবক্তারা (প্লেটো, এরিস্টোটল, সক্রেটিস প্রমুখ) অমর্তলোকে বসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের ভগ্নদশা দেখে বিস্মিত বোধ করছেন। ডিম আগে না মুরগি আগের অমীমাংসিত অবয়ব অবকাঠামো পরিবেশের প্রতি উদ্বেগ সবার।

রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সৌভাগ্য তথা স্বাধীনতার সুফল সবার মধ্যে সুষম বণ্টন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সুনিশ্চিত সুশাসন ও জবাবদিহিতার সুযোগ ব্যতীত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা গড়ে ওঠে না। গণতান্ত্রিক মূলবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য অযুত ত্যাগ স্বীকারের প্রকৃত প্রতিফল অর্জন সম্ভব হয় না সুশাসন সুনিশ্চিত না হলে। সম্পদ অর্জনের নৈতিক ভিত্তি বা প্রক্রিয়া স্বচ্ছ না হলে বণ্টন ব্যবস্থাপনাও সুষ্ঠু হয় না। সমাজে বণ্টনবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে সুশাসন প্রেরণা ও প্রভাবক ভূমিকা পালন করে থাকে। এটি দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার জন্যও জরুরি। যেমন- আজকাল এক দেশ বা অর্থনীতির প্রচুর অর্থ বিদেশে কিংবা অন্য অর্থনীতিতে দেদার পাচার হয়ে থাকে। বিনা বিনিয়োগে বা বিনাপরিশ্রমে প্রকৃত পণ্য ও সেবা উৎপাদন ব্যতিরেকে অর্থ অর্জিত হলে অবৈধভাবে অর্জিত সেই অর্থ পাচার হবেই।

অর্থ বৈধ পন্থায় উপার্জিত না হলে সেই অর্থের মালিকানার প্রতি দায়-দায়িত্ববোধও গড়ে ওঠে না। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি শক্তিশালীকরণেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক পরিবেশের আবশ্যকতা রয়েছে। কেননা সমাজে একপক্ষ বা কতিপয় কেউ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে থাকলে, আর অধিকাংশ অন্যজন কারো কাছে কোনো জবাবদিহির মধ্যে না থাকলে অর্থাৎ একই যাত্রায় ভিন্ন আচরণে নিষ্ঠ হলে পারস্পরিক অভিযোগের নাট্যশালায় জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে না। সমতা বিধানের জন্য, সবার প্রতি সমান আচরণের (যা গণতন্ত্রের মর্মবাণী) জন্যও স্বচ্ছতা তথা আস্থার পরিবেশ প্রয়োজন।

আরেকটি বিষয়, সুশাসনের অবর্তমানে জবাবদিহিতাবিহীন পরিবেশে, আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতার অবয়বের (cause) অন্যতম প্রতিফল (effect) হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি শুধু ব্যক্তিবিশেষ অর্থাৎ যে দুর্নীতি করে তাকে ন্যায়নীতিহীনতার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে তা নয়, তার দ্বারা সমাজকে নেতৃত্বদান বা যে কোনো ক্ষেত্রে দৃঢ়চিত্ত অবস্থান গ্রহণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। সর্বত্র তাকে দুর্বল করে দেয়। দুর্নীতিবাজ নেতৃত্বের জন্য বা কারণে সমাজে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়। নেতৃত্বের এই অধোগতির প্রেক্ষাপটই প্রত্যক্ষভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবজনিত পরিবেশ নির্মাণ করে। নেতৃত্বের কার্যকলাপে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকলে সমাজে সংসারে সে নেতৃত্বের অধীনে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়। এটি পরস্পর প্রযুক্ত সমস্যা। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার অনুপস্থিতির অবসরে আত্মঘাতী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেমন- যেকোনো সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ। যেমন- স্বেচ্ছাচারিতায়, নানান অনিয়ম ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে শিক্ষায়তনে শিক্ষক, সুশীল সেবক, হাসপাতালে চিকিৎসক কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কর্মীবাহিনী নিয়োগ। অর্থ বিনিময় ও নানান অনিয়মের কারণে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে ভালো ও যোগ্য সুশীল সেবক, চিকিৎসক, শিক্ষক আইন রক্ষক নিয়োজিত হতে পারে না।

সুশীল সেবক, চিকিৎসক অমেধাবী ও অযোগ্য শিক্ষক ও আইন রক্ষকের কাছ থেকে গুণগতমানসম্পন্ন প্রশাসনিক সেবা, চিকিৎসা, শিক্ষা বা তালিম বা অনুসরণীয় আদর্শ লাভ সম্ভব হয় না। অবৈধ লেনদেনে নিয়োগপ্রাপ্ত অযোগ্য সেবক, চিকিৎসক কিংবা শিক্ষকের কাছে কার্যকর সেবা, চিকিৎসা ও শিক্ষা পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে সব নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ আদান প্রদানের মাধ্যমে নিয়োগবাণিজ্য চলে সেখানে মেধাবী ও উপযুক্ত প্রার্থীরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। তাদের বিপরীতে নিয়োগ পায় অদক্ষ-অযোগ্য লোক। এটা একটি দিক। আরেকটি দিক, কেউ বিশেষ গোষ্ঠীর সমর্থক হয়ে এবং অবৈধভাবে অর্থ দিয়ে নিয়োগ পেলে সে প্রথমে চাইবে গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে সেবা চিকিৎসা ও শিক্ষার পরিবেশকে বিপন্ন করে ওই অর্থ তুলতে। সে ক্ষেত্রে সে প্রয়োজন হলে যে কোনোভাবে (কর্তব্য দায়িত্বহীন হয়ে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করা থেকে শুরু করে নানা ফাঁকিজুঁকি ও পক্ষপাতিত্ব অবলম্বন করে) ইচ্ছা করে নীতি নৈতিকতা ভুলে অর্থ উঠিয়ে নেবে। তখন সে তার চাকরি বা দায়িত্বশীলতার দিকে নজর দেবে না। কোনো পদপ্রার্থী কর্তৃক কোনো সংস্থা ও সংগঠনে স্রেফ প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার সময় কিংবা কোনো সংস্থায় নিয়োগ পাওয়ার সময় যে অর্থ ব্যয় করে তা নিঃসন্দেহে একটি মারাত্মক মন্দ বিনিয়োগ। এতে সমাজ দুই দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমত, একজন ভালো যোগ্য প্রার্থীর স্থলে একজন দুর্নীতিবাজ অদক্ষের অবস্থান সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং দ্বিতীয়ত, সে চিকিৎসা কিংবা লেখাপড়ার পরিবেশ বা প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে এমনভাবে কলুষিত করতে পারে তাতে যুগ যুগ ধরে দুষ্ট ক্ষতেরই সৃষ্টি হয়।
আজকাল পাবলিক ও প্রাইভেটসহ সব ক্ষেত্রেই যেকোনো সেবা, নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি সব ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা ও দেদার চলে অর্থ লেনদেনের ছড়াছড়ি। অবস্থা এমন অর্থ খরচ ব্যতীত বিনামূল্যে প্রাপ্য কোনো সাধারণ সেবা পর্যন্ত মিলবে না। উপরির বিনিময়ে যেকোনো ন্যায্য সেবাও বিক্রি করা হয়, সম্পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে আত্মসাৎ অপচয়, অপব্যয় লাগামহীন করে তুলতে পারে। স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে গণপ্রতিনিধিরা নির্বাচনের সময় ভোটারদের বলছেন তাদের ‘সমাজসেবার সুযোগ’ দিতে। কিন্তু সেখানে যদি দেখা যায় সমাজসেবার সুযোগ পাওয়ার জন্য ভালো পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে তাহলে কথিত ‘সমাজসেবা’ তো বিনিয়োগ ব্যবসায় পরিণত হবে। কেননা নির্বাচিত হয়ে কোনো পদে গেলে আলোচ্য ব্যক্তি নিজের বিনিয়োজিত অর্থটা আগে উঠিয়ে নিতে চাইবেন। সুতরাং নির্বাচনপদ্ধতিতে অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে সমাজসেবার সুযোগ কিনতে হলে বিনিয়োগের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়ে অন্য দিকে চলে যায়। সে ক্ষেত্রে জনস্বার্থ বিঘিœত হয়। নির্বাচনী ইশতেহারে সম্পদ বিবরণী চাওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও তহবিল তছরূপ, আত্মসাৎ, সম্পদের ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা অনুপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।

স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায় হলো, যার যা কাজ তাকে সেভাবে করতে দেয়া বা ক্ষমতা দেয়া। যেমন- স্থানীয় সরকার কিংবা নগর সরকার। স্থানীয় সরকার পরিচালনা আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনার ভার স্থানীয় সরকারের হতে দেয়া হলে সে সরকার হবে প্রকৃত প্রস্তাবে তার নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে জবাবদিহিতামূলক স্থানীয় পর্যায়ের সরকার। স্থানীয় সরকারই সেখানকার ভোটারদের কাছে জবাবদিহি করবেন। স্থানীয় সরকার পরিচালনার জন্য সেখান থেকে তারা যে কর নেবেন তা থেকেই সেখানে সেবামূলক কাজ নিশ্চিত করবেন যে প্রতিশ্র“তি তারা দেবেন তা তারাই পূরণ করবেন। তাহলেই সেটা অর্থবহ ও কার্যকর হবে। স্থানীয় সরকার হওয়া উচিত দল নিরপেক্ষ। তাদেরও পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ থাকতে হবে। তবেই স্থানীয় সরকার শব্দটির যথার্থতা ফুটে উঠবে। জাপানে দেখেছি এক এক প্রিফেকচার বা প্রদেশ বা রাজ্য নিজ নিজ আয়-ব্যয় উন্নয়নের জন্য সার্বিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সেখানে এক স্থানীয় সরকার অপর স্থানীয় সরকারের চেয়ে সরকার পরিচালনায় কতটা পারদর্শী তার প্রতিযোগিতা চলছে।

স্বচ্ছতা আনয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে অধিষ্ঠিত কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগে প্রতিশ্র“ত (commitment) ও দৃঢ় চিত্ততা প্রয়োজন। নিজেদের অধিক্ষেত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে আদিষ্ট হয়ে যদি তাদের কর্মধারা পরিচালিত হয় সে ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে জবাবদিহিমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচার ও স্বচ্ছতার অভাবে আকীর্ণ হয়ে উঠতে পারে, স্বেচ্ছাচারিতার অজুহাত যৌক্তিকতা এমনকি স্বজনপ্রীতির পরিবেশ বা ক্ষেত্র তৈরি হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা। পাবলিক সার্ভিসে প্রতিটি কর্মকর্তার নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথ পরিপালনের মাধ্যমে একটা স্বচ্ছ ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ থাকার দরকার। যারা নীতি প্রণয়ন করে, নীতি উপস্থাপন করে তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব দৃঢ়চিত্ততা এবং নীতি-নিয়ম পদ্ধতির প্রতি দায়িত্বশীল থাকা আবশ্যক। এর পরিবর্তে তার যদি চাকরি যাওয়ার বা পদোন্নতি আটকে যাওয়ার ভয় থাকলে কোনো বিভাগই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠা পায় না স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা। সুশাসন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা প্রয়োজন সবার স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে। কারণ এটা পরস্পরের পরিপূরক। আরেকটি বিষয়, নীতিনির্ধারকরা বাস্তবায়নকারীদের দিয়ে, তাদের ভুল বা ব্যত্যয়ধর্মী নীতি বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করিয়ে নিতে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি কিংবা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির ক্ষেত্রে তাদের নানান সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিয়ে প্রলুব্ধ করতে পারেন কিংবা ক্ষেত্রে বিশেষে ষড়যন্ত্রের টোপে ফেলে বিব্রত করতে পারেন। ক্ষমতায় থাকার জন্য কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক উৎকোচ কিংবা নিপীড়নের প্রথা প্রাচীনকাল থেকে কম বেশি ছিল বা আছে তা মাত্রা অতিক্রমণের ফলে সেটি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক পরিস্থিতির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রতিভাত হয়ে থাকে।

মানবসম্পদ তৈরিতে যেকোনো জাতির জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে হয়ে থাকে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। কারণ শিক্ষাই ভবিষ্যৎ জনসম্পদ তৈরি করবে। মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করবে। দায়িত্বশীল মানুষ তৈরি করবে। দায়িত্বশীল নেতা তৈরি করবে। যে মানুষ থাকবে লাঙলের পেছনে সে মানুষ খাঁটি সৃজনশীল মানুষ হিসেবে দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। ঠিক তেমনিভাবে স্বাস্থ্য খাত থেকে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হলে, মানুষ সুস্থ হলেই না তার উৎপাদনশীলতা, সৃজনশীলতা সবই বাড়বে। স্বাস্থ্য খারাপ থাকলে, পুষ্টিহীন হলে কর্মী ভালো কাজ করতে সমর্থ হয় না। বরং তাকে সুস্থ ও কর্মক্ষম করে তোলার জন্য পরিবার ও রাষ্ট্রকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়।

স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এ জন্য দরকার যে, সবাইকে সুস্থ, নিরোগ ও স্বাস্থ্যবান নিরাপদ পেতে হবে। লোকবল সুস্থ হলেই সব কিছু বিকাশ লাভ করবে। এর বিপরীতে যদি দেখা যায় স্বাস্থ্য খাতে ধীরে ধীরে বাজেট কমছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে, হাসপাতালে ওষুধ দেয়া হচ্ছে কিন্তু তা রোগী পাচ্ছে না, রোগীকে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে।

চিকিৎসককে বেতন দেয়া হচ্ছে যাতে তারা হাসপাতালে বা সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে রোগীকে সুষ্ঠু চিকিৎসা দেন। অথচ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা না দিয়ে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে কিংবা বেসরকারি ক্লিনিকে যেতে। জনগণের দেয়া করের টাকায় চিকিৎসককে, শিক্ষককে, পাবলিক সার্ভেন্টকে বেতন দেয়া হচ্ছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-প্রশাসনিক নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা তথা স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য। কিন্তু সেভাবে সেবা প্রাপ্তি ঘটছে না।

শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে যথাযথভাবে না পড়িয়ে তাদেরকে কোচিং বা প্রাইভেট পড়তে বলা হচ্ছে। শিক্ষার্থীকে দ্বিগুণ খরচ করতে হচ্ছে। উপযুক্ত ও গুণগত শিক্ষাদানের প্রয়াস প্রচেষ্টায় বাণিজ্যিক মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তার মানে সেখানে শিক্ষক বা চিকিৎসকের দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার পরিবেশ পরিব্যাপ্ত হচ্ছে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহোদয় যখন দেখছেন অভিভাবকরাও সন্ধ্যায় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা তদারকিতে মনোনিবেশ করতে পারছেন, বিদেশী চ্যানেলে সিরিয়াল দেখায় ব্যতিব্যস্ততার জন্য তখন স্কুল কলেজের শিক্ষকদের উপরের শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থীদের দিয়ে এমনকি সুশিক্ষিত অভিভাবক ও কর্মকর্তাদের দিয়ে স্কুলেই সান্ধ্য ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং তার স্কুল কলেজে পড়াশোনার একটি স্বেচ্ছা ও স্বতঃপ্রণোদিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় ফলাফল ভালো আসছে। এটা দায়িত্বশীল পরিবেশ বিনির্মাণে তার স্থানীয় উদ্যোগ।
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/733760