১১ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১০:৪৪

সভ্যতা ও সাম্প্রতিক বিশ্ব

-ইবনে নূরুল হুদা

সভ্যতার বিবর্তন এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু এর কল্যাণ ও অকল্যাণ নিয়ে বিতর্ক মোটেই কমেনি বরং তা আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। কালের বিবর্তনে মানবজাতি অধিকতর সভ্য হয়ে উঠেছে বলে দাবি করা হলেও তা সর্বাংশে সত্য নয় বরং শ্রেণি বিশেষের অসভ্যতা পুরো সভ্যতার ললাটেই কলঙ্কতিলক লেপন করেছে। যা অপ্রত্যাশিত ও অনাকাক্সিক্ষত।

বস্তুত, সভ্যতা (Civilization) হল কোন জটিল সমাজব্যবস্থা যা নগরায়ন, সামাজিক স্তরবিন্যাস, প্রতীকী যোগাযোগ প্রণালী, উপলব্ধ স্বতন্ত্র পরিচয় এবং প্রাকৃতি পরিবেশের উপর নিয়ন্ত্রণের মত গুণাবলি দ্বারা বৈশিষ্ট্যম-িত। সভ্যতাকে প্রায়শই আরও কিছু সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়; যেগুলোর উপর সভ্যতা নির্ভরশীল। সেগুলো হল কেন্দ্রীকরণ, মানুষ এবং অন্যান্য জীবের আবাসন, শ্রমের বিশেষায়িতকরণ, সাংস্কৃতিকভাবে সৃষ্ট উন্নয়ন আদর্শ, আধিপত্য স্থাপন, ভাস্কর্যের অনুরূপ স্থাপত্য, কর বা খাজনা আরোপ, কৃষির উপর সামাজিক নির্ভরশীলতা এবং সম্প্রসারণের প্রবণতা। বস্তুত সাংগঠনিক বসবাসের ক্রমোন্নত স্তর হল সভ্যতা। যা একটি চলমান প্রক্রিয়া ও মানবজাতির জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ।

আর কালের বিবর্তনে সভ্যতার যেমন ক্রমবিবর্তন ঘটেছে, তেমনিভাবে সংঘাতও হয়ে উঠেছে অনিবার্য। এই সংঘাতই অনেক ক্ষেত্রেই মানবসভ্যতাকে বিচ্যুত, বিবর্ণ, কুৎসিত ও রক্তাক্ত করে তুলেছে। সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনায় সে কথারই বাস্তব প্রমাণ মেলে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, রোমান সাম্রাজ্য ছিল বিশে^র বৃহত সভ্যতার একটি উদাহরণ। এই সাম্রাজ্য এককালে স্কটল্যান্ডের সীমান্ত থেকে উত্তর আফ্রিকা ও উত্তর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রোমান সভ্যতা মোট ১ হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। কিন্তু প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা টিকে ছিল তার থেকে বেশি দিন। রোমান এবং মিশরীয়গণ অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এই যুদ্ধে রোমানরা জয়ী হওয়ায় মিশর রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এভাবেই সভ্যতার উত্থান-পতন বিশ^ ইতিহাসের উপজীব্য হয়ে উঠেছে।

সাধারণভাবে কোন জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ও জ্ঞানই হচ্ছে সংস্কৃতি। ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার-আচরণ, সঙ্গীত, চিত্রকলা ও শিল্পকলাও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ অন ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন’ সংস্কৃতির একটি অতিচমকপ্রদ ও প্রাণবন্ত সংজ্ঞা দিয়েছে। সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘সামাজিক আচরণ, মিথষ্ক্রিয়ার ধরন, জ্ঞানীয় গঠন এবং সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে যে উপলব্ধি অর্জিত হয় তা-ই সংস্কৃতি’।

সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে একটা অলিখিত সখ্যতা রয়েছে। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের মতে, ‘আমরা যা করি তাই আমাদের সংস্কৃতি, আর আমাদের যা আছে তাই আমাদের সভ্যতা। মূলত, সংস্কৃতি হলো মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রণালী এবং সভ্যতা হলো সে জীবন প্রণালীর বাহ্যিক রূপ। আর সভ্যতা বিকাশের পূর্বশর্ত হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির জন্ম ও টিকে থাকার মাধ্যমে একটি সভ্যতা পূর্ণতা লাভ করে এবং বিকশিত হয়। কিন্তু বর্তমান বিশ^ ব্যবস্থায় এ ক্ষেত্রে রয়েছে বড় ধরনের বিচ্যুতি। যা মানবসভ্যতার সকল অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে।

বস্তুত, মানব জীবনের ক্রমবিবর্তন যখন ইতিবাচক ধারায় সূচিত হয় তখনই তা সভ্যতা হয়ে ওঠে। আর এর বিপরীত দিকটাই হচ্ছে সভ্যতার সঙ্কট। যার বাস্তব প্রমাণ সাম্প্রতিক বিশ্ব। কারণ, ইদানিং যাদেরকে সভ্যতার প্রতিভূ বলে মনে করা হয় তারাই এখন এর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রের নামে স্বেচ্ছতন্ত্র স্থায়ী রূপ পেতে চলেছে। ফলে মানব সভ্যতা স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট হারাতে বসেছে। বিশে^র শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও পৃথিবীর সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রগতিশীলতা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপান জি-সেভেন নামে যা করছে তা মানব সভ্যতার গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। বিষয়টি ক্রমেই বিশ^বাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু শক্তিধরদের শক্তিমত্তার কারণে কেউ আহাজারী আর্তনাদও করতে পারছে না। ন্যাটো বাহিনী ব্যবহৃত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের গণহত্যা ও আগ্রাসী যুদ্ধের কাজে। বিশ্বের ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রগুলোও উন্নত বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে ইতিবাচক। সমাজপতি, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, বৈজ্ঞানিক ও চিন্তাবিদরা এক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। ফলে মানবসভ্যতা এখন খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে।

আর এই অনাকাক্সিক্ষত প্রবণতা থেকে আমরাও মুক্ত নই। আমাদের রাষ্ট্রাচারের ক্রমবিবর্তন ইতিবাচক হিসাবে প্রচার পেলেও সার্বিক পরিস্থিতি মোটেই ইতিবাচক নয় বরং একটি ক্ষয়িষ্ণু বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি সর্বপরি জাতীয় জীবনে। ফলে আমাদের ‘সংস্কৃতি’ এখন ‘অপসংস্কৃতি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধ ও সমস্যার রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে সমাধান করা হচ্ছে না। বরং শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত সংস্কৃতি এবং নানা অপবিশেষণের ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মোকাবেলা করার অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বাড়ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অস্থিরতা। ফলে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে স্বেচ্ছাচারিতা ও কর্তৃত্ববাদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। মূলত, মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অনুপস্থিতির কারণেই আমাদের দেশে ধর্ষণের সংস্কৃতি, হত্যা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের সংস্কৃতি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংস্কৃতি, সিন্ডিকেট সংস্কৃতি, জুলুম-জবরদস্তির সংস্কৃতি, মিথ্যাচারের সংস্কৃতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ঘুষ-দুর্নীতির সংস্কৃতি, গণতন্ত্রহীনতার সংস্কৃতি, জনগণের ভোটাধিকার হরণের সংস্কৃতি, স্বেচ্ছাচারিতার সংস্কৃতি, আইনের অপপ্রয়োগের সংস্কৃতি ও নারী নির্যাতনের সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।

মূলত, সভ্যতার ক্রমবিকাশ এমন সব কাজের মধ্য দিয়ে হয়, যেগুলো ইতর প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। যেমন আগুন ও পানির ব্যবহার। মানুষ জলবায়ু ও প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে সফলতা দেখিয়েছে। মানুষ পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও রাষ্ট্র গঠন করে। তারা বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্রের আছে প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা। মানুষের আছে প্রগতিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য; সর্বপরি রাজনীতি ও অর্থনীতি। এসবেরই মধ্যে আছে নৈতিক চেতনা, ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত ও ন্যায়-অন্যায়ের উপলব্ধি। মানুষের বিবেক আছে। বিবেক আর সত্য, ন্যায় ও সুন্দর হলো সভ্যতার মর্মগত অবলম্বন। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের বিচ্যুতি রীতিমত উদ্বেগজনক পর্যায়েই পৌঁছেছে। ফলে আমরা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারছি না।

সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সূচনা মানুষের হাত ধরে হলেও তা কলঙ্কিত হচ্ছে আবার মানুষের কর্মের মাধ্যমেই। সে ধারাবাহিকতায় বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সারা বিশ্বেই অনাকাক্সিক্ষতভাবেই যুদ্ধবিগ্রহ বেড়ে গেছে। সে সম্প্রতি পরাশক্তি রাশিয়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইউনেক্রেনের ওপর যুদ্ধ চালিয়ে দিয়েছে। ফলে গোটা বিশে^ই এখন অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। চলছে বৈশি^ক অর্থনৈতিক সঙ্কট। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্বব্যবস্থার কল্যাণকামীতারও ঘটেছে বড় ধরনের বিচ্যুতি। আগুন-পানি ও প্রকৃতির ব্যবহার, বৃহৎ শক্তিগুলো এমনভাবে করে চলছে যে প্রকৃতি মানুষের প্রতিকূল হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন ক্রমবর্ধমান। সমুদ্রে পানির উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর স্থলভাগের এক-তৃতীংয়াশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। কিন্তু এসব বিষয়ে এবং পৃথিবীর ধারাবাহিকতা ও বসবাস যোগ্যতা রক্ষায় কারো কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না বরং বিশ^শক্তিগুলো এমন কিছু নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে যার সাথে মানুষের স্বার্থের কোন সম্পর্ক নেই।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও অবক্ষয় সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। ফলে পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিচ্যুতি ঘটছে প্রতিনিয়ত। কায়েমি স্বার্থে প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের অপব্যবহার বর্বরতা ও ধ্বংসের পালেই হাওয়া দিচ্ছে। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি ব্যবহৃত হচ্ছে শ্রেণি, গোষ্ঠী ও ব্যক্তি স্বার্থে। সাধারণ মানুষ সব রকম অন্যায়-অবিচার, জুলুম-জবরদস্তি ও মিথ্যাচারকে মেনে নিয়েছে বা নিতে বাধ্য হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই সমাজ-রাষ্ট্রে যারা কর্তৃত্ব করছে তারা অন্ধকারের শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির অন্ধকার যুগের অবস্থায় ভিন্নতা রয়েছে। প্রত্যেক জাতির ইতিহাস এক ও অভিন্নও নয়। তবে কিছু বিষয়ে সব জাতির মধ্যে মিলও রয়েছে। তাই সভ্যতার সঙ্কট মোকাবেলায় বহুজাতিক ঐক্যের আবশ্যকতার বিষয়টিও অনস্বীকার্য। তবে সেক্ষেত্রে কোনো জাতিরই নিজস্ব সঙ্কটকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই বা আন্তর্জাতিক কোনো শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকাও উচিত নয়। তাই নিজ নিজ সমস্যা নিজ উদ্যোগেই সমাধান করে নেয়া উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান বিশ^ ব্যবস্থায় যে অবস্থা চলছে তাতে বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী শক্তিগুলোকে দেখা যাচ্ছে বৈশ্বিক সরকারের ভূমিকা পালন করছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকাও প্রশ্নাতীত থাকেনি। চীন ও রাশিয়া কখনো কখনো ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইতিবাচক কিছু করার চেষ্টা করছে। তবে তা পর্যাপ্ত মনে করার সুযোগ নেই।

সভ্যতার সঙ্কট ও বৈশ্বিক রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে আমরাও মুক্ত নই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে শুরু হয়েছে বিরাজনীতিকরণ ও বিরাষ্ট্রকরণের কার্যক্রম। রাজনৈতিক শক্তিগুলো রাজনীতিকে করে ফেলেছে বৃহত শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস অভিমুখী, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্ক অভিমুখী। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গণমুখী করে গড়ে তোলা হয়নি বরং ছাত্র রাজনীতির নামে যা চলছে তা গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজের মোটেই কাক্সিক্ষত ও কাম্য নয়। এমতাবস্থায় বিচারব্যবস্থার বিচ্যুতিও জনদুর্ভোগের কারণ হওয়ার অভিযোগও বেশ জোরালো। জনপ্রশাসন ঘুষ-দুর্নীতি ও লাগামহীন স্বেচ্ছাচারে নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়েছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এসব কথা সংবিধানে লেখা আছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলনটা খুবই গৌণ। অবস্থাটা ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ ঠিক এমনই। যা এক ধরনের আত্মপ্রতারণা। আর কোন আত্মপ্রবঞ্চিত জাতি কোনভাবেই সামনের দিকে এগুতে পারে না। যার বাস্তব প্রমাণ আমরা নিজেরাই।

‘৮০-র দশকের শুরু থেকে ক্রমাগত বলা হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা। এর মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় সরকার গেছে, গেছে জরুরি অবস্থাও। কিন্তু সার্বিক অবস্থার ক্রমোবনতিই হয়েছে বলতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সব প্রতিষ্ঠানগুলো স্বকীয়তা হারিয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এখন গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন কমিশন হয়ে ওঠেছে প্রহসন কমিশনে। দেশ ও জাতি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার উপযোগী রাজনৈতিক শক্তির শূণ্যতা বোধ করছে। রাষ্ট্রাচারের বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের জয়জয়কারের কারণেই পরিবারব্যবস্থা দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। লাগামহীন বিবাহবিচ্ছেদ, পরকীয়া, স্বামী-স্ত্রীতে কলহ-সন্দেহ ও অবিশ্বাস, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা এখন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা মূল্যবোধহীন কথিত সভ্যতার বিষবৃক্ষের ফল হিসেবেই স্বীকৃত।
মূলত, মূল্যবোধহীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতিই মানব সভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিশ্বে যতগুলো ফলপ্রসূ সভ্যতা ও বিপ্লব এসেছে তার সবই আদর্শ ও মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরেই। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, অষ্টাদশ শতকে ফরাসিদের মধ্যে যে দু’টি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যেত, তা হলোÑমূল্যবোধ ও ন্যায্যতা। ফলে তারা একটি সফল ও সার্থক বিপ্লব সাধনে সমর্থ হয়েছিল। সমসাময়িককালে ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা ফরাসিদের সাথে তুলনীয় না হলেও সে সময় ভারতবর্ষে যে মূল্যবোধের চর্চা ছিল না, তা বলা যাবে না। তবে এক রূঢ় বাস্তবতায় মূল্যবোধ ও নায্যতার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থা একেবারে প্রান্তিকতায় এসে ঠেকেছে। যা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজের চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যকেই দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বস্তুত, মূল্যবোধ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাগ্রত হয় না বরং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে এ জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যকতা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রই নাগরিকের সবকিছুই দেখভাল করে, তাই মূল্যবোধের লালন ও চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্বও রাষ্ট্রের। তাই নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রের প্রথম কর্তব্য হবে নৈতিকশিক্ষা, মূলবোধের চর্চা ও সুস্থ্যধারার সংস্কৃতি উৎসাহিত করা এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। তাহলেই সভ্যতার উৎকর্ষতাকে ইতিবাচক ধারায় ফিরে আনা সম্ভব।

এ ক্ষেত্রে সুশিক্ষাই কাক্সিক্ষত ও প্রত্যাশিত। কেউ যখন সুশিক্ষিত হয়ে ওঠেন তখন তার মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়; ব্যক্তি হয়ে ওঠে সংস্কৃতিবান। তিনি অবক্ষয় মুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। আর তা ফুলে-ফলে সুশোভিত করার জন্য প্রয়োজন হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনুকূল পরিবেশ বা পৃষ্ঠপোষকতা। সুশিক্ষিত তিনিই যিনি তার শিক্ষাকে সৎ আর ন্যায়ের পথে নিয়োজিত করেন। যৌক্তিক বিষয়াদিকে যৌক্তিক বোঝার পর নিজ স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে, অযৌক্তিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত গ্রহণ করেন। যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোকিত ও মহিমান্বিত করে।
মূলত, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের চর্চার সাথে রাজনীতির নিবিরতম সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, রাজনীতির পরিসর খুবই বৃহত। রাজনীতি দেশ ও জনগণের আমূল কল্যাণের জন্য আবর্তিত হয়। এতে মূল্যবোধ আর ন্যায্যতার ভিত্তি মজবুত না থাকলে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই হয় বেশি। রাজনীতিকদের যদি মূল্যবোধের স্তর নিম্নমানের হয় তবে তা আর রাজনীতি থাকে না বরং অপরাজনীতি হিসেবে আখ্যা পায়। এর কুপ্রভাবে হাজারো মূল্যবোধ নষ্ট হয়। ব্যক্তির মূল্যবোধ নষ্ট হলে ক্ষতি শুধু একজনের কিন্তু শাসক শ্রেণির মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

মূলত, সভ্যতার সঙ্কট, সাংস্কৃতিক বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে মূল্যবোধহীনতা, ধর্মবিমুখতা, ধর্মের অপব্যবহার ও ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের মতো আরো কিছু বিষয়। ধর্মের যথাযথ চর্চা ও অনুশীলন কখনোই ব্যক্তিকে ধর্মান্ধ হতে শেখায় না বরং ধর্মীয় আদর্শের মাধ্যমেই ধর্মান্ধতার অভিশাপ মুক্ত হওয়া সম্ভব। ধর্মই মানুষের জীবনপ্রণালী অন্যান্য ইতর প্রাণী থেকে আলাদা করেছে; মানুষকে সভ্য, সংবেদনশীল ও পরিশীলিত করে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে আমরা ধর্মকে মনে করি এগিয়ে চলার পথের প্রধান অন্তরায়। কিন্তু বাস্তবতা সে ধারণার অনুকূলে কথা বলে না।

বস্তুত, বিশ্ব ইতিহাসের সকল সভ্যতার ক্রমবিকাশই ছিল ধর্মাশ্রিত। ইতিহাসে এমন কোন সভ্যতার নজীর পাওয়া যায় না, যা ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে গড়ে উঠেছে বরং ধর্মই সকল সভ্যতাকে পরিশীলিত করেছে। তাই একটি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি সৃষ্টি ও অবক্ষয়হীন সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে নাগরিকদের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি, ধর্মীয় মূল্যবোধের লালন ও অনুশীলন করতে হবে। মনীষী সাইয়্যেদ কুতুবের ভাষায়, ‘যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে সে সমাজই সভ্য সমাজ’। মূলত, মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে মানব সভ্যতাকে গতিশীল ও সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চা সম্ভব। অন্যথায় সভ্যতার সঙ্কট ও সংঘাত মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না বরং সভ্যতার অধঃপতনই অনিবার্য হয়ে উঠবে। সভ্যতার অন্তরালে ঢাকা পড়ে যাবে অনেক কিছুই। যা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত!

 

https://dailysangram.com/post/518854