১০ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ৭:২৬

৬০ শতাংশ পাইপলাইনের ‘টেকনিক্যাল লাইফ’ শেষ

তিতাস গ্যাসের বেশিরভাগ পাইপলাইনের ‘টেকনিক্যাল লাইফ’ শেষ হয়ে গেছে। কমপক্ষে ২০ বছর আগে এসব পাইপলাইনের মেয়াদ শেষ হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপের বিভিন্ন স্থানের ছিদ্র দিয়ে ধীরে ধীরে গ্যাস বের হয়ে আশপাশের শূন্যস্থানে জমা হচ্ছে। আগুন, উচ্চতাপ বা অন্য কোনো গ্যাসের সংস্পর্শে এলেই ঘটছে বিস্ফোরণ। এসব কারণে বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস পাইপলাইনগুলো এখন একেকটি বোমায় পরিণত হয়েছে।

তিতাস গ্যাস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিনটি কারণে গ্যাসের পাইপলাইনে লিকেজ হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে-অতি পুরোনো পাইপলাইন, পাইপলাইনে সঠিকভাবে জং প্রতিরোধী আবরণ না দেওয়া এবং মানহীন পাইপ ব্যবহার।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ মোল¬াহ সাংবাদিকদের বলেন, পুরোনো জরাজীর্ণ গ্যাস বিতরণ লাইন প্রতিস্থাপন, বিদ্যমান লাইনে কোথাও ছিদ্র থাকলে সেগুলো চিহ্নিত করে মেরামতসহ বেশকিছু কাজের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, এ কাজে একটি বিদেশি কোম্পানিকে জরিপের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা অস্থায়ীভাবে বন্ধ গ্যাস সংযোগ চিহ্নিত করেছে। রাজধানী ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ তিতাসের বিতরণ এলাকায় এমন আরও অস্থায়ীভাবে বন্ধ সংযোগ চিহ্নিত করার কাজ চলমান।

জানা গেছে, ১৯৭০ সাল থেকে এসব পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস বিতরণ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মাটির ক্ষার ও লবণের কারণে পাইপগুলো ক্ষয় হয়ে অধিকাংশ জায়গায় ছিদ্র হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় জং ধরে পাইপ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তৈরি হয়েছে হাজার হাজার ছিদ্র। এসব ছিদ্রপথে প্রায়ই গ্যাস বের হচ্ছে। এছাড়া অবৈধভাবে ফুটো করে গ্যাস সংযোগ দেওয়ায় বেশিরভাগ লাইনের অবস্থা জরাজীর্ণ। এর বাইরে প্রায় ৫০ হাজার সংযোগ রয়েছে যেগুলো সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করা রয়েছে। কিন্তু সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও গ্রাহক আঙ্গিনায় রাইজার রয়ে গেছে। তিতাসের অসাধু কর্মীরা রাতের আঁধারে এসব বিচ্ছিন্ন সংযোগ ফের চালু করে দিচ্ছে। যেগুলো পুরো তিতাস গ্যাসের নেটওয়ার্ককে বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এসব কারণে প্রায়ই তিতাসের পাইপলাইনে বিস্ফোরণ ঘটছে। কিন্তু তারপরও গ্যাসলাইন সংস্কারের উদ্যোগ নেই সরকারের। হাত গুটিয়ে বসে আছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি।

পেট্রোবাংলার এক শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন,প্রতিটি পাইপলাইন স্থাপনের আগে সেগুলোর টেকনিক্যাল লাইফ বিবেচনা করে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপর্মা) তৈরি করা হয়। ১৯৭০ সালে যখন এই পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছিল তখন টেকিনিক্যাল লাইফ ধরা হয়েছিল ৩০-৩৫ বছর। সে হিসাবে তিতাসের ৬০ শতাংশের বেশি পাইপলাইনের বয়স ৫৫ থেকে ৬০ বছরের অধিক। এসব বিবেচনায় নিয়ে করোনাভাইরাসের আগে তিতাস গ্যাসের পুরো পাইপলাইন সংস্কারের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৪শ কোটি টাকা। কিন্তু ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

ইকোনমিক রিলেশন্স ডিভিশনের (ইআরডি) একটি সংস্থা আইআইএফসি (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কোম্পানি) এই প্রকল্পের ড্রয়িং, ডিজাইন ও প্রাক্কলন তৈরির কথা ছিল। জাপানি একটি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু এত বছর পরও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

২০১০ সাল থেকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় বেড়েছে অবৈধ সংযোগের সংখ্যা । সরকারও বাসাবাড়িতে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগকে নিরুৎসাহিত করছে। এসব কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিতরণ নেটওয়ার্কের দিকে নজর কম দিচ্ছে কোম্পানিটি। এতে ঝুঁকি আরও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে গ্যাস পাইপলাইনে এক ধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়। যাতে কোথাও লিকেজ হলে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং সাবধান হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু এ কার্যক্রম এখন বন্ধ থাকায় লিকেজ থেকে গ্যাস ছড়িয়ে পড়লেও কেউই তা জানতে পারছে না।

তিতাসের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার গ্যাসলাইন পুরোপুরি পালটানো খুবই দুরূহ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। দীর্ঘদিনের এই সিস্টেম একবারে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ঢাকা শহরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা গ্যাস পাইপলাইনের পরিপূর্ণ কোনো ম্যাপ নেই। অনেক এলাকায় স্থাপিত লাইনের ওপর রাস্তা কয়েক দফায় উঁচু করা হয়েছে। তাছাড়া রাস্তা সরু হওয়ার কারণে একই পথে অন্যান্য ইউটিলিটি সার্ভিস যুক্ত হয়েছে। এতে গ্যাসলাইনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাসাবাড়ির গ্যাস সংযোগে এক ইঞ্চি পাইপলাইন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকার অনেক গ্যাসের লাইন ছিদ্র হয়ে সেই গ্যাস স্যুয়ারেজ লাইন ও শৌচাগারের পাইপের মাধ্যমে ভবনে গিয় জমা হচ্ছে। বদ্ধস্থানে জমে থাকা এসব গ্যাস পরে বিস্ফোরণ কিংবা বৈদ্যুতিক স্পার্কের মাধ্যমে বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৯৬৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে তিতাস গ্যাসের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। ৩০ জুন ২০২২ অনুসারে তিতাসের মোট পাইপলাইন রয়েছে ১৩ হাজার ৩২০ কিলোমিটার। গ্রাহক সংখ্যা আছে ২৮ লাখেরও বেশি। মোট পাইপলাইনের মধ্যে ঢাকায় রয়েছে সাত হাজার কিলোমিটার। এছাড়া ঢাকার আশপাশে অর্থাৎ নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর এবং কিশোরগঞ্জেও তিতাসের পাইপলাইন আছে।
জানা গেছে মূলত ৮০ এবং ৯০-এর দশকে এসে পাইপলাইন ব্যাপক সম্প্রসারণ করা হয়। তবে ২০০০ সালের পর লাইন সম্প্রসারণ অনেকটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর ২০১০ সালের পর থেকে তিতাসে নতুন পাইপলাইন খুব একটা বসানো হয়নি।
সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় ২০২১-২২ অর্থবছরে নতুন পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে গ্যাস নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা হয়নি। তবে বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের স্বল্পচাপ নিরসন ও সংস্কারসহ মাত্র ৮২ কিলোমিটার লিংক লাইন সংস্কার ও প্রতিস্থাপন করা হয় ওই অর্থবছরে। এছাড়া ২০২০-২১ সালে করা হয় ৫২ কিলোমিটার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে করা হয় ৫৮ কিলোমিটার, আর ২০১৭-১৮ সালে করা হয় ১৯ কিলোমিটার পাইলাইন প্রতিস্থাপন ও সংস্কার।

তিতাসের সাবেক দুই ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একাধিক জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৬৭-৬৮ সালে ডেমরা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ১২ ইঞ্চি এবং ডেমরা থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ১৪ ইঞ্চি ও ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন মাটির নিচ দিয়ে বসানো হয়। এরপর সেখান থেকে দুই ইঞ্চি থেকে ছয় ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ নেটওয়ার্ক স্থাপন করে গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। ৯০ দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশে ৫০ পিএসআই চাপের বিভিন্ন ব্যাসের বিতরণ লাইন ছিল। অর্থাৎ বিতরণ কোম্পানিটির প্রায় সব পাইপলাইনের মেয়াদই শেষ হয়ে এসেছে। ফলে পুরোনো পাইপলাইন সরিয়ে এখন নতুন পাইপলাইন বসানো জরুরি।

প্রায় একই সুরে সব কর্মকর্তা জানান, পাইপগুলো মাটির নিচে দেওয়ার সময় এক ধরনের জং নিরোধক কালো প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হয়। আনাড়ি অথবা অনেক সময় ইচ্ছা করে কেউ যদি সেটি দিয়ে না মুড়িয়ে মাটির নিচে স্থাপন করে তাহলে পাইপে জং ধরে লিকেজ হতে পারে। এছাড়া পাইপের মানের ওপরেও অনেক সময় লিকেজ হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে। তিতাস মূলত চীন থেকে পাইপ কিনে আনে। চীনের পাইপ অন্য দেশের তুলনায় সস্তা। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এরপর বিশেষ করে কোরিয়া থেকে আমদানির চিন্তা করা হলেও পরে দাম বেশি বলে আর বিষয়টি এগোয়নি।

জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রায় ৫০ হাজার সংযোগ আছে যেগুলোর লাইন কেটে দেওয়া হলেও গ্রাহকের আঙ্গিনায় রাইজার রয়ে গেছে। এসব সংযোগ ব্যবহার করে বেশকিছু গ্রাহক পরে অবৈধভাবে পুনরায় গ্যাস সংযোগ নিচ্ছেন। এমন অবৈধ সংযোগের কারণে তিতাস গ্যাস একদিকে লোকসানের শিকার হচ্ছে। অপরদিকে এগুলো থেকে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। গত বছরের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে একটি তিনতলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ১২ জন মারা যান। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। ওই ভবনে থাকা অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন একটি গ্যাস সংযোগ স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন না করায় লাইন লিকেজ হয়ে গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

মগবাজারের বিস্ফোরণের পর তিতাসের তদন্ত কমিটি জানায়, প্রায় ৮ বছর আগে ওই ভবনের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। ফলে বিস্ফোরণটি সিলিন্ডার গ্যাস বা অন্য কোনো কারণে হতে পারে। যদিও একাধিক সংস্থার তদন্তে বলা হয়, তিতাসের বিচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগই এ জন্য দায়ী। সিআইডির তদন্তেও জানা যায়, ওই বাড়ির অবৈধ গ্যাস সংযোগ শুধু রাইজার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল তিতাস। কিন্তু লাইনে গ্যাসের সরবরাহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়নি। ওই পাইপলাইনে সৃষ্ট ছিদ্র থেকে গ্যাস বের হয়ে মগবাজারের ওই ভবনের একটি কক্ষে জমে। এটি থেকে পরে বিস্ফোরণ ঘটে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/652918