৯ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:০৯

সীতাকুণ্ডে ১১ অক্সিজেন প্ল্যান্টের ৬টিতেই নেই ফায়ার সেফটি

 প্ল্যান আতঙ্কে শ্রমিক ও স্থানীয়রা হ সীমায় বিস্ফোরণের ঘটনায় ৩ মালিকসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চলে একের পর এক দুর্ঘটনায় বেঘোরে মৃত্যুতে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন কল-কারখানার শ্রমিকেরা। দুর্ঘটনা আতঙ্কে স্থানীয়রাও। সেখানে ১১টি অক্সিজেন প্ল্যান্টের মধ্যে ছয়টির নেই কোন ফায়ার সেফটি প্ল্যান। অন্য কারখানাগুলোতেও উপেক্ষিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এসব কারখানায় একের পর এক দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের পাশাপাশি স্থানীয়দেরও প্রাণহানি হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বসতঘর, দোকানপাট। তাতে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে পুরো এলাকায়।

কল-কারখানার পাশাপাশি সীতাকুণ্ডের বিস্তৃত উপকূলে গড়েওঠা শিপব্রেকিং ইয়ার্ডেও প্রতিনিয়ত প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। জাহাজভাঙা শিল্পের কালো ধোঁয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে আশপাশের বাসিন্দারা। শ্রমিকদের প্রাণ যাচ্ছে রি-রোলিং মিলগুলোতেও। এসব কারখানার দূষণে নাকাল স্থানীয়রা। সর্বশেষ গত শনিবার সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের সাথে অগ্নিকাণ্ডে কারখানাসহ আশপাশের বিশাল এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। আশপাশের কয়েকটি কল-কারখানা ছাড়াও সাধারণ মানুষের বসতঘর, দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অক্সিজেন কারখানা থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে উড়ে যাওয়া একটি লৌহখণ্ডের আঘাতে প্রাণ হারান এক গ্রামবাসী। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাতজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন আরও ১৭জন। বিস্ফোরণে আশপাশের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি ছাড়াও ঘরের আসবাবপত্রও ভেঙেচুরে গেছে। ফাটল দেখা দিয়েছে অসংখ্য ভবনে। ভবন ধসে পড়ার আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছেন বাসিন্দারা। কোন কারখানায় কখন ফের বিস্ফোরণ ঘটে সে আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন অনেকে।

এর আগে গত বছরের ৪ জুন বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার রূপ নেয় ডিপো ও আশপাশের এলাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল। টানা ৯৬ ঘণ্টার অগ্নিকাণ্ড এবং ডিপোর অভ্যন্তরে একের পর এক বিস্ফোরণে মারাত্মক পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে স্থানীয়রা। শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়েওঠা এসব শিল্প কারখানায় সবকিছু থাকলেও নেই শুধু নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন শ্রমিকেরা। কোন একটি দুর্ঘটনা ঘটলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে, হয় তদন্ত কমিটি, করা হয় হরেক সুপারিশ।

বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সাতটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এসব কমিটি তদন্ত শেষে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নানা সুপারিশও করেছে। সুপারিশ অনুযায়ী বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজায়। ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়নের পাশাপাশি অগ্নি দুর্ঘটনারোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয় তারা। তবে এতকিছুর মধ্যেও কয়েক মাস আগে সেখানে ফের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

বিএম ডিপোতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের পর সীতাকুণ্ডসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল, কল-কারখানায় নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে। বিশেষ করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বা ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়নে তোড়জোর শুরু করে প্রশাসন। তবে কিছুদিন পর তা আবার থেমে যায়। এর মধ্যে সীমা অক্সিজেনে দুর্ঘটনার পর টনক নড়ে প্রশাসনের। বলা হচ্ছে, সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে কোনরকম নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছিল না। অনুমোদনহীন এ কারখানায় অদক্ষ লোক দিয়ে চলছিল অক্সিজেন উৎপাদন। প্রতিষ্ঠানটির বয়লার ব্যবহার থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংযোগেরও ছিল না অনুমোদন। পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই এবং বিস্ফোরক অধিদফতরের আপত্তির মধ্যে টানা প্রায় ২৭ বছর কারখানাটি চালু ছিল। অদক্ষ লোক দিয়ে চলছিল স্পর্শকাতর এ কারখানার উৎপাদন। এ কারখানায় দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অব্যবস্থাপনা আর অনিয়মের কারণেই এ বিপর্যয় ঘটেছে।

সীমা প্ল্যান্টের মত অক্সিজেন উৎপাদনকারী আরও ১১টি প্ল্যান্ট রয়েছে সীতাকুণ্ডে। যার বেশিরভাগই চলছে সীমা প্ল্যান্টের মত জোড়াতালি দিয়ে। ফলে এসব প্ল্যান্টে যেকোন সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে এসব কারখানা কর্তৃপক্ষকে দ্রুত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এদিকে বিস্ফোরণে সাতজন নিহতের ঘটনায় সীমা প্ল্যান্টের তিন মালিকসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিক নোয়খালী জেলার সুধারাম এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাদের মিয়ার স্ত্রী রোকেয়া বেগম সোমবার গভীর রাতে সীতাকুণ্ড থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয়- সীমা অক্সিজেনের এমডি মো. মামুন উদ্দিন, পরিচালক আশরাফউদ্দিন বাপ্পি ও পারভেজ হোসেন, ম্যানেজার আব্দুল আলিম, অপারেটার ইনচার্জ শামসুজ্জামান সিকদার শিকদার, কর্মকর্তা খোরশেদ আলম, সেলিম জাহান, মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, গোলাম কিবরিয়া, সামিউল, শান্তনু রায়, ইদ্রিস আলী, সানাউল্লাহ, সিরাজউদ্দৌলা, রাকিবুল, রাজিবসহ অজ্ঞাত নামা আসামিদের।

থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ জানান, বাদীনি অভিযোগ করেন এ কারখানায় এক সময়ে দক্ষ শ্রমিক-কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে মালিকপক্ষ তাদের ছাঁটাই করে অল্প বেতনে বেশ কিছু অদক্ষ কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে কারখানা পরিচালনা করছেন। তাদের গাফেলতি ও অবহেলায় এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে তার স্বামীসহ ৭ জন নিহত হন। মালিক পক্ষের কেউ কোন সহযোগিতা করেনি। এমনকি তাদের কোন খবর পর্যন্ত নেয়নি। ঘটনার তিনদিন পর মামলা রুজু হলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।

অপরদিকে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত অক্সিজেন কারখানার আশপাশের কল-কারখানা ও বসতবাড়ির ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় আশপাশের বেশকিছু ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অনেক ভবনের দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল। বিস্ফোরণের ঘটনায় ভেঙে পড়েছে অনেক বাড়ির কাঁচের জানালা।

ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা জানান, ঘটনাস্থলের আধা কিলোমিটারের মধ্যে যেসব ভবন রয়েছে প্রায় সবগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ঘটনাস্থলের আশেপাশে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান রয়েছে বেশি। ভবনগুলোর দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেখান থেকে ভবন মালিকরা নিজে থেকেই সরে গেছেন।

অপরদিকে ভারী ও মাঝারি শিল্পপ্রবণ এলাকায় দুর্ঘটনারোধে প্রশাসনের তরফে ১৩টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মাস্টারপ্ল্যান ভিত্তিক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃক ৩টা ক্যাটাগরি করে ঝুঁকিপূর্ণ কলকারখানার তালিকা করতে হবে। প্রতি মাসে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সকল অফিসকে সংযুক্ত করে একটি সভা আয়োজন করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সকল কারখানায় পরিদর্শনকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিয়মিত তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।

বেশিরভাগ কারখানায় অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারের স্থলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে কেমিস্ট্র, ফিজিক্স, মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়ে কমিটি করে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্যাস প্ল্যান্টে গ্যাস তৈরি এবং ব্যবস্থাপনার ম্যানুয়েল তৈরি করে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। এছাড়া ফায়ার সেফটির সরঞ্জামাদির মেয়াদ উত্তীর্ণ কিনা সেটা ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক নিয়মিত তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।

নতুন কারখানা স্থাপন ও চালুর জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলি শতভাগ পূরণ ছাড়া যেন উৎপাদনে যেতে না পারে সে ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারখানার শ্রমিকদের কর্মশালার মাধ্যমে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আহত নিহতের বাইরেও আরো যেসব ক্ষতিগ্রস্ত আছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদফতর, সরকারি কল-কারখানা পরিদর্শক অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অভিযান ও তদারকি জোরদারের সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/national/article/560750