৬ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ৬:৫০

বিবেচনার বিবরে রাজস্ব আহরণের বাজেট

-ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

বিগত বেশ কয়েকটি বাজেট বছরে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেশ পিছিয়ে পড়লেও, বছর বছর রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি শতকরা ১৭-২০ হলেও ছিল যথেষ্ট, সেখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ( ৩২ শতাংশের বেশি) প্রাক্কলন করেই ২০২২-২৩ এর জাতীয় বাজেট করা হয়েছিল। নির্বাচনী বাজেট নামে খ্যাত চলতি বর্ষের বাজেট বিগত আট মাসের বাস্তবায়নের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ধার দেনা বেশ বেড়েছে, সুদ পরিশোধের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়াটাকে যে বেশ ভাবনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বছরের মাঝপথে গিয়ে উন্নয়ন বাজেট ওরফে এডিপি বড় কাটছাঁটের শিকার হচ্ছে, অনুন্নয়ন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাত বিশেষ করে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণসহ স্বাস্থ্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হিস্যা হ্রাস পেতেই হচ্ছে, ব্যাংক ঋণসহ নানান সংস্কারের শর্তসংবলিত দাতা সংস্থার বাজেট সাপোর্ট ফান্ডের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে। প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর কর রাজস্ব জিডিপির অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত পরের কিস্তি মিলবে না, সেহেতু কর রাজস্ব আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের যৌক্তিকতা থেকেই যাবে। কিন্তু আসল কথা থেকে যাবে; করের হার না বাড়িয়ে কর জালের সম্প্রসারণ ঘটিয়েই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যথাযতœবান হতে হবে। উপলব্ধিকে বাস্তবতায় এভাবে আনতে হবে সব পক্ষকেই যে, বাঞ্ছিত পরিমাণ রাজস্ব বা অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য নয় শুধু, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা সুষমকরণের দ্বারা সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণের জন্যও জরুরি। অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের দ্বারা, দুর্নীতির দুয়ার খুলে রেখে, পুঁজি লুণ্ঠন অবারিত রেখে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হচ্ছে সেখান থেকে, উপরন্তু রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব থেকে দেশকে তুলে আনতে ও পরনির্ভরতার নিগড় থেকে বের করে আনতে কর রাজস্ব অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা জরুরি আবশ্যক হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তরফে সরকারের সামষ্টিক আয়ব্যয় ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলনে উন্মোচিত আত্মবিশ্বাসের, সহযোগিতা সঞ্জাত মনোভঙ্গি ভজনের, পদ্ধতি সহজীকরণের, করদাতার আস্থা অর্জনের অয়োময় প্রত্যয়। গতানুগতিক কর্মধারায় নয়; নীতিনির্ধারক, বাস্তবায়ক ও নাগরিক নির্বিশেষে সবাইকে সক্রিয় সচেষ্ট হতে হবে সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণে। আসন্ন নতুন ২০২৩-২৪ এর জাতীয় বাজেটে সে মর্মে দিকনির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনার পথনকশা প্রত্যাশিত থেকেই যাবে। এ কথা মাথায় রাখা আবশ্যক হবে, নতুন বাজেটটির বাস্তবায়নের দায় ভার বর্তাবে দু’টি সরকারের ওপর, জাতীয় নির্বাচনের আগের ও পরের সরকারের। ইতোমধ্যে চলতি বছরের রাজস্ব ঘাটতি কমাতে রাজস্ব বিভাগের তরফ থেকে এলোপাতাড়ি পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যমান নিয়মিত করদাতাদেরই চাপের মধ্যে ফেলা হচ্ছে, নতুন কর দাতা খোঁজার বা বানানোর অভিযানে বা প্রয়াসে সময় ও ক্যালরি ক্ষয়ে যাচ্ছে পুরনোদের পেছনে মনোযোগ দিতে গিয়ে। পুঁজি পাচার ও লুণ্ঠনকারীদের, অর্থবাজার ধ্বংসকারীদের কর-ওয়াকওভার দেয়ার খেসারত ন্যায্য ও নিয়মিত করদাতাদের দেয়ার অর্থই দাঁড়াবে, কর আহরণ সংস্কৃতিকে আত্মপ্রবঞ্চনার বিবরে নিক্ষেপ করা।

২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো বৃত্তাবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে কর রাজস্ব আহরণের সাফল্য লাভের পরবর্তী পাঁচ বছরে পেছনে তাকাতে হয়নি এনবিআরকে। সেই পাঁচ অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আয় প্রায় শতভাগ বৃদ্ধি পায়। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পেছনে অন্যান্য কারণের সাথে এডিপির আকার বৃদ্ধিজনিত প্রবৃদ্ধিও সহায়ক ভূমিকায় ছিল। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাস্তবায়িত এডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা আর ২০১৮-১৯ এ তা এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০১৪-১৫ পরবর্তী অর্থবছরগুলোতে এডিপিতে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সাথে সমানুপাতিক হারে রাজস্ব অর্জিত হয়নি। বিষয়টি বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। দেখা গেছে, আগের পাঁচ অর্থবছরে কোম্পানি ও কোম্পানি ব্যতীত করের অনুপাত ৫৯:৪১ থেকে ৫৫:৪৫ এর মধ্যে ওঠানামা করলেও পরবর্তী পাঁচ অর্থবছরে এই অগ্রগতি অনুপাত পরিলক্ষিত হয়নি। রাজস্বে আয়করের হিস্যা ২৫ থেকে ৩৩-এর মধ্যে ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও এখনো আয়কর কর রাজস্ব প্রাপ্তির পরিবারে অন্যতম শরিক হওয়ার পথে। অর্থনীতির আকার অবয়ব চেহারা ও চরিত্র অনুযায়ী, আমদানি শুলক (আশু) ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) কে টপকিয়ে আয়করের অবস্থান অনেক উপরে হওয়া বাঞ্ছনীয়, নয় কি? সার্বিক রাজস্ব আয়ে অধিক পরিমাণে মূসক হিস্যা এখনো শতকরা ৩৫ আর আশু ৩৩। সামষ্টিক অর্থনীতিতে আয়করের অবদানকে অগ্রগামী গণ্য হতে হলে আরো জোরে চালাতে হবে পা, হতে হবে আরো গতিশীল, দায়িত্বশীল, জবাবদিহিমূলক।

দেখা যাচ্ছে, আয়কর আয়ের প্রবৃদ্ধির মাত্রা এখনো ধীর, মিশ্র ও নৈরাশ্যজনক, অথচ অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনুযায়ী ইতোমধ্যেই প্রত্যক্ষ করের মুখ্য ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্রমেই কোম্পানি ও কোম্পানি ব্যতীত কর আয়ের অনুপাত ৭০:৩০ থেকে ৫৮:৪২ এ পৌঁছেছে। দেশে করপোরেট ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও কোম্পানি প্রদত্ত আয়করের প্রবৃদ্ধি সেভাবে বা সে হারে বাড়েনি বলে প্রতীয়মান হয়। অন্য দিকে কোম্পানি ব্যতীত করদাতার মধ্যে ব্যক্তি করদাতা, পার্টনারশিপ ফার্ম, অ্যাসোসিয়েশন অব পারসন, আর্টিফিশিয়াল জুরিডিক্যাল পারসনস রয়েছেন- তাদের করনেটের আওতায় আনার উদ্যোগ আরো জোরদারকরণের অবকাশ রয়েছে। ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা (টিআইএন ধারীর হিসাব অনুযায়ী) নিকট অতীতেও যথাযথভাবে শুমার ও সংরক্ষণ করা না হলেও যখন থেকে এসবের অগ্রগতির পরিসংখ্যান পর্যালোচিত হচ্ছে তখন থেকে অগ্রগতির ধারা কাগজে কলমে বেগবান করার প্রয়াস চলছে। যারা আয়কর নথি খুলেছেন তাদের শতকরা মাত্র ২৫-৩০ ভাগ করদাতা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, বাকিদের উপযুক্ত অনুসরণের উদ্যোগ জোরদার করার আবশ্যকতা রয়েছে। আয়কর বিভাগের লোকবল বাড়ানো ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যমান লোকবল ও কাঠামোকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো এবং দেশীয় দায়িত্বশীলতার সাথে প্রত্যক্ষ কর প্রশাসন-ব্যবস্থাপনা-প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। ধার্য ও আদায়কৃত আয়কর যথাসময়ে ও প্রকৃত পরিমাণে কোষাগারে আসার ব্যাপারে নজরদারি ও পরিবীক্ষণ যেমন জরুরি তেমনি করারোপ, হিসাবায়ন ও জমা দান পদ্ধতি প্রক্রিয়াকে যতটা সম্ভব করদাতাবান্ধব বা সহজীকরণ করা যাবে, তত দূরত্ব কমবে করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যে। আর এভাবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হলে করনেটের সম্প্রসারণ ঘটতে থাকবে। দেশের কর জিডিপি রেশিও উপযুক্ত পর্যায়ে উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে এ কথা অনস্বীকার্য যে, সার্বিক রাজস্ব আয়ের পরিবারে প্রত্যক্ষ করকেই মোড়লের ভূমিকায় আসার যথেষ্ট অবকাশ ও সুযোগ রয়েছে।

গত কয়েক বছরে প্রকৃত অর্থে বোঝা যাচ্ছে না, করদাতা সত্যিই বাড়ছে কি-না। সার্বিকভাবে উৎসে কর ও কোম্পানির করের ওপরই আয়কর নির্ভর হয়ে পড়েছে। এটি বাড়ছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। দেখতে হবে করের প্রকৃত পরিধি বাড়ছে কি না। করদাতার সংখ্যা বাড়ছে কি না এবং সেই হারে করের পরিমাণ বাড়ছে কি না। আবার এর সাথে ঢালাও রেয়াত ও অব্যাহতি প্রদানসহ কর ফাঁকি রোধ বা সীমিত করতে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে করপোরেট করও যারা দিচ্ছেন, তারা সবাই সঠিক পরিমাণে দিচ্ছেন কি না সেটিও দেখার বিষয় রয়েছে। কারণ প্রায়ই প্রতিবেদনে দেখা যায়, অমুক প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির এত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি। এটি তো ছেলে খেলার বিষয় নয়। এখানে কর আহরণকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ সেখানে কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ের, প্রয়াসের, দক্ষতার, সততার দায়িত্বশীলতার ঘাটতির প্রতিই ইঙ্গিত আসতে পারে।
কয়েক বছরে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় এনবিআরের বেশ কিছু সংস্কার ও জনবল কাঠামোয় ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে ভেবে দেখতে হবে- যে হারে সংস্কার ও সম্প্রসারণ হয়েছে, সে হারে কর বা করদাতা বাড়ছে কি না, কিংবা যারা যুক্ত হচ্ছে তারা পরে থাকতে পারছে কি না। বিদ্যমান কর ব্যবস্থায় কিছু সীমাবদ্ধতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে কর বিভাগের অপারগ পরিস্থিতির কারণে করদাতারা যেন হয়রানির শিকার না হন সে, দিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। করের ভিত্তি বাড়ানোর জন্য এটি জরুরি।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/732252