৫ মার্চ ২০২৩, রবিবার, ১২:২২

তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ শেষ নিয়ে শঙ্কা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নতুন একাডেমিক এবং আবাসিক ভবনের নির্মাণকাজ সাত বছরেও শেষ হয়নি। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে তিনবার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ দেখানো হয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে কাজের অগ্রগতি ৬৫-৭০ শতাংশ। এর মধ্যে খরচ হয়েছে ৪০৯ কোটি টাকা (প্রকল্পের ৬৭ শতাংশ)।

এখন পর্যন্ত তিন ভবনের ফার্নিচারের টেন্ডার হয়নি। কোনো ভবনেই ইলেকট্রিক কাজের টেন্ডার হয়নি। এ ছাড়া এলসি জটিলতায় ভবনগুলোর লিফট আমদানি নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ আগামী জুনে কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হলেও এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, করোনা অভিঘাতের পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি, তবে বাড়েনি প্রকল্প ব্যয়। ফলে কাজের গতি কমিয়েছেন ঠিকাদাররা। বিভিন্ন ভবনে ডিজাইন পরিবর্তিত হয়ে বেড়েছে কাজ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগের সূত্রমতে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক এই প্রকল্পের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ এবং পুরোনো ভবন বর্ধিতকরণ মিলে ২৭টি অবকাঠামোর কাজ ২০১৬ সালের জুলাইয়ে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। ৬১৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে চার বছরমেয়াদি এই প্রকল্প ২০২০ সালের জুনে সম্পন্ন করার কথা ছিল।

তবে করোনা মহামারির কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেয়াদ ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু এর মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের ব্যয় প্রয়োজনে হ্রাস-বৃদ্ধি করে ৬১৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা সংশোধিত ব্যয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ অনুমোদন করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। পুরোনো ভবন বর্ধিতকরণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। শঙ্কা নির্মাণাধীন নতুন ভবন নিয়ে।

জানা যায়, প্রকল্পের সুষ্ঠু পরিচালনা এবং তদারকির জন্য ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি) ও প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি (পিআইসি) নামে দুটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রতি তিন মাস পরপর কমিটিগুলোর সভা হওয়ার কথা থাকলেও গত এক বছরে পিএসসির কোনো সভা হয়নি। একবার পিআইসির সভা হয়, তবে তাতে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি না থাকায় সভা ফলপ্রসূ হয়নি।

এ ছাড়া প্রকল্পের মুখ্য কোনো ভূমিকায় নেই প্রকল্প পরিচালক (পিডি)। টেন্ডার প্রক্রিয়া এবং প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ন ও অগ্রগতি সব কাজ করেন প্রকল্প ব্যবস্থাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা। ফলে দায় নিতে চান না পিডি।

নির্মাণাধীন এই ভবনের মধ্যে রয়েছে– আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ২১ তলা একাডেমিক ভবন, জগন্নাথ হলে ১৫ তলা ভিতে ১০ তলা রবীন্দ্র ভবন ও ১১ তলা আবাসিক শিক্ষক ভবন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ১১ তলা ভিতে ১১ তলা ভবন ও ১১ তলা আবাসিক শিক্ষক ভবন এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের পাশে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য ২০ তলা শেখ কামাল টাওয়ার।

এগুলো চালু হলে আর্থ ভবনে অনুষদের বিভাগগুলো আধুনিক ল্যাব সুবিধাসম্পন্ন প্রশস্ত শ্রেণিকক্ষ পাবে। এ ছাড়া রবীন্দ্র ভবন ও বঙ্গবন্ধু হলের ভবনে পৃথকভাবে ২ হাজার ছাত্র আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন, টাইলসকৃত রুমে আবাসন সুবিধা পাবে। এতে কমবে সিট সংকট।

সরেজমিন দেখা যায়, সবচেয়ে পিছিয়ে আছে আর্থ ভবন এবং শেখ কামাল টাওয়ার। এগুলোর সিভিল অংশের কাজ যথাক্রমে ৭৮ শতাংশ ও ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রথমটির ঠিকাদার তমা কনস্ট্রাকশন এবং দ্বিতীয়টির ঠিকাদার যৌথভাবে মেসার্স টিসিএল ও মল্লিক এন্টারপ্রাইজ। এর মধ্যে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই আর্থ ভবনে দুই মাসের বেশি সময় কাজ বন্ধ ছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিসের উপপরিচালক মো. আমির হোসেন বলেন, ‘আমি শুধু মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের কাজ করি। প্রকৌশল দপ্তর ও হিসাব পরিচালকের দপ্তর বাকি কাজ করে।’

নাম না প্রকাশের শর্তে এক প্রকৌশলী জানান, লিফটের এখনও টেন্ডার হয়নি, আমদানি করতে হয় বাইরে থেকে। আনতে তিন-চার মাস লেগে যায়। ফলে ভবন চালু হলেও সময়মতো লিফট চালু করা সম্ভব হবে না।

কাজ বন্ধ থাকার বিষয়টি স্বীকার করে আর্থ ভবনের তমা পক্ষের প্রকৌশলী মো. সুমন বলেন, শ্রমিকরা বাড়িতে যাওয়ায় কাজ বন্ধ ছিল। দেরিতে ওয়ার্ক অর্ডার হয়েছে। তাঁরা জুনে কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন।

বঙ্গবন্ধু হলের ভবনের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মঈন উদ্দিন ও ঠিকাদার ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশনের ইঞ্জিনিয়ার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, করোনায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে অল্প কাজ হয়েছে।

বাকি তিন ভবনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আক্রাম হোসেন বলেন, ডিজাইন পরিবর্তন, রুমে টাইলস করার বিষয় পরে যুক্ত করাসহ নানা কারণে টেন্ডারের কাজ বেড়েছে, খরচও বেড়েছে। এ বাড়তি খরচের নির্মাণসামগ্রীর দাম বর্তমান দামে চাচ্ছেন ঠিকাদাররা।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার সমকালকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত। তবে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সরকারি অর্থে হয়। এখানে পিপিআর না মানার সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রকল্পের ‘প্রকিউরিং এনটিটি’। তিনি যাকে দায়িত্ব অর্পণ করবেন, তাঁর (উপাচার্য) অনুমতিক্রমে যাবতীয় কাজ সে করবে।

পরিকল্পনা কমিশনের শিক্ষা অনুবিভাগের যুগ্ম প্রধান রাহনুমা নাহিদ বলেন, ডিপিপিতে যদি প্রকৌশলীদের টেন্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা টেন্ডারের যাবতীয় কাজ করতে পারবেন। অন্যথায় নিয়মের ব্যত্যয় হবে। যিনি কাজ করবেন, তাঁকে কাজের বিষয়ে তিনি জবাবদিহি করবেন।

 

https://samakal.com/bangladesh/article/2303160442