৩ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৫২

বিদ্যুতের দাম আর কতো বাড়বে?

দেশে প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। সমন্বয়ের নামে নির্বাহী আদেশে বৃদ্ধি হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী চাহিদা অনুপাতে কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। মূল্যবৃদ্ধি পালে হাওয়া দিচ্ছে বিদ্যুতের নিয়মিত মূল্যবৃদ্ধি। ইতিমধ্যে তিন মাসে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ আর পাইকারিতে ২৮ শতাংশ। সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালেও সংকট কাটছে না। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সমস্যা সামাল দিতে অগ্রিম টাকাও নিচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলো থেকে। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকের প্রশ্ন আর কতো বাড়বে বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামনে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে।

আপাতত ৫ থেকে ৭ শতাংশ বাড়ানোর পর কোম্পানিগুলোর সমতা পরিস্থিতিতে আসতে পারে। তখন হয়তো মূল্যবৃদ্ধির বিরতি হবে।

এক মাসের ব্যবধানে দুবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করেছে সরকার। যার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক ব্যয়ে। হাজারীবাগের বাসিন্দা খিজির আহমেদ। তিনি সাধারণ একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করে কোনো রকম ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে জীবনযাপন করেন। বললেন, হিসাব করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি। তারপরও হাজার টাকার কম বিল আসে না। সামনে রমজান, গরমের মৌসুম। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। কিন্তু সরকার যেভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, তাতে কিছুদিন পর পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। মুদি দোকানি সেন্টু মিয়া বলেন, দফায় দফায় সরকার যে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, একবারও কি সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করছে? বাজারে এখন সবকিছুর দাম বাড়তি। প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতেই সব টাকা চলে যাচ্ছে। বাড়তি বিদ্যুৎ বিলের বোঝা কীভাবে সামাল দেবো?

এদিকে, গত মঙ্গলবার নির্বাহী আদেশে ফের বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম আরও ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। মার্চ মাসের বিদ্যুতের বিলেই নতুন এ দাম কার্যকর হবে। এর আগে গত জানুয়ারিতে দুই দফায় বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এটি জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দুই ভাগে কার্যকর হয়েছে। সর্বশেষ ৩০শে জানুয়ারির প্রজ্ঞাপনে খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ সামলাতে এ বছর প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করছে সরকার। এ নিয়ে গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করতো এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এরপর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানো হচ্ছে। দেশের সরকারি- বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কম দামে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ঘাটতি মেটাতে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়। তবে বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো ভর্তুকি পায় না। তারা নিয়মিত মুনাফা করছে। গত অর্থবছরেও মুনাফা করেছে বিতরণ সংস্থাগুলো। বিদ্যুতের নতুন দাম অনুযায়ী, আবাসিকের লাইফ লাইন (৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী) গ্রাহকদের প্রতি ইউনিটের জন্য ৪ টাকা ১৪ পয়সার পরিবর্তে ৪ টাকা ৩৫ পয়সা দিতে হবে।

এ দফায় আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিটের দাম ৪ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৮৫ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৩১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬৩ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৯৫ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৯৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৩৪ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের দাম ১০ টাকা ৯৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৫১ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের উপরে দাম ১২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।

দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি নিয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, আমরা অনেক আগেই বলেছি যে, ভুল পরিকল্পনা এবং নানা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ফলে বার বার দাম বাড়ানো হচ্ছে। মানুষের ওপর বোঝা চাপানো হচ্ছে। পিডিবি বার বার লোকসানের অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে। আর পিডিবি’র দাম বাড়ানোর অজুহাতে বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বাড়াচ্ছে।
অন্যদিকে রেন্টাল, কুইক রেন্টালসহ বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে ২০ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এ ছাড়াও পিডিবি’র কাছে সরকারের অন্যান্য কোম্পানিরও প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া আছে। সময়মতো বকেয়া পরিশোধ করতে না পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবছর মার্চ থেকে জুনে কৃষি সেচ ও রমজানে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ। ফলে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পাওনা টাকা এবং জ্বালানি তেল আমদানি নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিল বাবদ অগ্রিম টাকা আদায় করছে পিডিবি।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে এপ্রিল মাসে বিদ্যুৎ বিল বাবদ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা অগ্রিম আদায় করেছে সংস্থাটি। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এপ্রিল-২০২২ সালের সমপরিমাণ ৬৪৩ কোটি টাকার বিলের বিপরীতে এ পর্যন্ত ৩২৭ কোটি টাকা পিডিবিকে অগ্রিম দিয়েছে ডিপিডিসি, ডেসকো, ৪১২ কোটি টাকার বিপরীতে দিয়েছে ৩০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বাপবিবো) ১৯৫৩ কোটি টাকার বিপরীতে দিয়েছে ১৩৪৮ কোটি টাকা, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) দিয়েছে ২০৫ কোটি টাকা, নর্দার্ন ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) ২০৮ কোটি টাকা দিয়েছে।

এ বিষয়ে ডেসকো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী মানবজমিনকে বলেন, সামনে গরম আসছে। তেল ও কয়লা আনতে হবে। বিশ্বে জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা চলছে। আমরা পিডিবি’র কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করি। আসন্ন গ্রীষ্মে প্রয়োজনীয় জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করতে পিডিবিকে আমরা অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করেছি। তিনি বলেন, জানুয়ারি মাসে ৩০০ কোটি টাকা অগ্রিম দিয়েছি। যা প্রতি মাসের বিলের সঙ্গে ১০ শতাংশ করে কমিয়ে সমন্বয় করা হবে। ইতিমধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে এভাবে টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এবছর হয়তো বিদ্যুতের তেমন লোডশেডিং হবে না দেশে।

বিদ্যুতের দাম আর কতো বাড়তে পারে- জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক (ডিজি) প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, খুচরা পর্যায়ে ইতিমধ্যে দফায় দফায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এটা হয়তো ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পর আর বাড়ানো প্রয়োজন হবে না। গরমে লোডশেডিং হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করছি, গত বছরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না।

https://mzamin.com/news.php?news=45071