১ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৮:০০

হারিয়ে যাচ্ছে রাজশাহীর বড়াল নদ অস্তিত্ব সংকটে উত্তরের ৪০ নদী

বিশেষ প্রতিনিধি, রাজশাহী: দেশের উত্তরের ৪০ নদীর এখন অস্তিত্ব সংকট চলছে। পানির প্রবাহ না থাকা, দুইপাড় দখল আর দূষণে এসব নদী মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে। অপর দিকে সরকারের গৃহীত অপরিকল্পিত পদক্ষেপই কিছু নদ-নদীর মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছে। রাজশাহীর বড়াল নদ এর অন্যতম উদাহরণ হয়ে রয়েছে।

সম্প্রতি রাজশাহী বিভাগীয় নদী বিষয়ক একটি কর্মশালায় নদীগুলোর এমন চিত্র উপস্থাপিত হয়। রাজশাহী মহানগরীতে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) এই কর্মশালার আয়োজন করে। কর্মশালায় বলা হয়, রাজশাহী বিভাগের ৪০টি নদ-নদী এখন দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। অনেক নদী একেবারে হারিয়ে গেছে। কোন কোন নদী দখলের কারণে দীর্ঘ এলাকায় এর কোন অস্তিত্ব নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ভুল সিদ্ধান্তের কারণেও নদীর মৃত্যু হয়েছে। রাজশাহীর চারঘাট থেকে শুরু হওয়া বড়াল নদেরও মৃত্যু হচ্ছে পাউবোর ভুল সিদ্ধান্তে-এমন অভিযোগও আনা হয়েছে বেলার তথ্যে। এতে বলা হয়, চারঘাটে পদ্মার শাখা হিসেবে বড়াল নদের উৎপত্তি। ২২০ কিলোমিটার এর দৈর্ঘ। এই নদীর সঙ্গে সংযোগ ৫০ লাখ মানুষের। কিন্তু দখলের কারণে নাটোরের বড়াইগ্রামে প্রায় ১৮ কিলোমিটার এই নদীর কোন অস্তিত্ব নেই। নদীটির মৃত্যুর জন্য পাউবোর ভুল সিদ্ধান্তও দায়ী।

তথ্যে জানা যায়, ১৯৮১ সালে বড়ালের উৎসমুখে স্লুইসগেট দেয় পাউবো। তারপর থেকেই এ নদে পানিপ্রবাহ কমতে থাকে। ১৯৮৫ সালে নদের ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে আটঘড়ি নামক স্থানে আরেকটি বাঁধ পড়ে। এরপর ১৯৮৫ সালে নদের ১২৫ কিলোমিটার ভাটিতে তিনটি ক্রস বাঁধ দেয়া হয়। এতে এর অবস্থা করুণ হয়ে ওঠে। এভাবে বিভাগের আট জেলার অন্তত ৪০টি নদ-নদী মৃতপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। তবে এসব নদীর প্রাণ বাঁচাতে বেশকিছু সুপারিশ উঠে আসে কর্মশালায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নদ-নদীকে বাঁচাতে প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে গবেষণা করতে হবে। করতে হবে নদীর ডাটাবেজ। সিএস ম্যাপ অনুযায়ী সব নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। দখল-দূষণসহ নদীবিরোধী সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। নদীর ওপর নির্মিত ছোট ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে। শোধন ছাড়া কোন বর্জ্য নদীতে ফেলা যাবে না। শহরে নদীর দুইধারে পায়ে হাঁটা রাস্তাসহ বসার ব্যবস্থা করে নগর পরিকল্পনা করতে হবে। নদীপাড়ে লাগাতে হবে ফলজ ও ওষুধি বৃক্ষ। লোকায়ত জ্ঞানকে গুরুত্ব দিয়ে এলাকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিবেচনায় রেখে নদী সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি নদী রক্ষায় নিতে হবে আইনি পদক্ষেপ। তাহলেই নদ-নদীগুলো টিকে থাকতে পারবে।
বড়ালের দুর্দশা-চিত্র

একসময় বড়াল ছিল খরস্রোতা এক নদীর নাম। এখন নাব্যতা নেই, যৌবন হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন বড়ালের বুকে চাষ হচ্ছে গমসহ বিভিন্ন ফসল। দখল-দূষণ আর অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নদীর বুকে পলি জমে উঁচু হয়েছে। দখল আর দুষণের কারণে দুই পাড় চেপে গেছে। ফলে খরস্রোতা বড়াল নদী আজ শুধুই স্মৃতি। স্থানীয়রা জানান, প্রমত্তা পদ্মা নদীর শাখা হিসাবে বড়াল নদীর উৎপত্তি হয়ে রাজশাহীর চারঘাট, বাঘা, নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে বাঘাবাড়ি হয়ে হুড়া সাগরের বুকে মিশে নাকালিয়ায় যমুনায় পড়েছে। একসময় যোগাযোগের সুবিধার কারণে বড়াল নদীর দুই পাড়ে চারঘাট বাজার, চারঘাট উপজেলা পরিষদ, চারঘাট মডেল থানা, চারঘাট পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, চারঘাট এমএ হাদ্বী কলেজ, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী, আড়ানী বাজার, রুস্তমপুর পশুহাট, পাঁকা বাজার, জামনগর বাজার, বাঁশবাড়িয়া বাজার, তমালতলা বাজার, বাগাতিপাড়া থানা, দয়ারামপুর সেনানিবাসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। পাউবো সূত্র জানায়, বড়ালে পদ্মার পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে এবং নাব্য ফিরিয়ে আনতে বড়াল নদীকে ঘিরে গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ‘নাটোরের নারদ ও মুসা খান (আংশিক) নদী ও রাজশাহীর চারঘাটের রেগুলেটরের ইনটেক চ্যানেল খনন’ নামে ১৩ কোটি ৩ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রায় ১৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার নদী খনন ও প্রবেশ মুখে খনন করতে এই অর্থ ব্যয় করা হয়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চারঘাট বড়াল নদীর ইনটেক চ্যানেল খনন কাজ শেষ হয়। ইনটেক চ্যানেল খনন কাজ হলেও বর্ষায় বড়ালে পানি আসেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, দায়সারা কাজ করার কারণে নদী থেকে খনন করা বালু আবার নদীতে চলে গেছে। পাউবো ১৯৮১-৮২ অর্থ বছরে নদীর তীরবর্তী উপজেলাগুলোকে বন্যামুক্ত করার জন্য উৎসমুখ চারঘাটে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক গতি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে স্লুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক গতি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে স্লুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্রমান্বয়ে বড়াল নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে।

বর্ষায় নদীতে কিছু পানি জমলেও শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়। এলাকার কৃষকরা নদীর বুক জুড়ে ফসলের আবাদ করেন। শুষ্ক মৌসুমে পরিণত হয় গবাদী পশুর চারণ ক্ষেত্রে। এক সময় যে বড়ালের পানির সেচে নদীর তীরবর্তী মানুষ তাদের জমিতে ফসল ফলাত। এখন সে নদীর বুকে অগভীর নলকূপ বসিয়ে হয় ধান চাষ। নদী আছে, নৌকা আছে, নেই শুধু পানি। নদীতে পানি না থাকায় এ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলো তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। সেচসহ প্রতিদিনের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে। এখনই সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করে এ নদীটি পুনঃখনন করা না হলে বড়াল নদীই একদিন হারিয়ে যাবে। এক সময়ে এই বড়াল নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা হলেও এখন আর নদীতে মাছ শিকার করা হয় না। পানি থাকায় জেলেরা আজ অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। পদ্মার মুখে পলি মাটি জমে পানির প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড়াল আজ নিজের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বড়ালটি পুনঃখনন করে অবাধ পানি প্রবাহের ব্যবস্থার দাবি জানান স্থানীয় জেলেরা। পাউবো’র একজন প্রকৌশলী জানান, ইতোমধ্যে পদ্মার শাখা বড়ালের মুখে খনন কাজ করে নাব্যতা ফিরিয়ে আসতে পানি সম্পদ পুনুরুদ্ধার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। দ্রুত এর বাস্তবায়ন করা হবে।

https://dailysangram.com/post/518023