২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ৭:৪৬

আন্দোলনের হুমকি শ্রমিকদের, অস্থিরতার আশঙ্কা

দফায় দফায় তেল, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। টাকার মান অব্যাহতভাবে কমছে। বাসা ভাড়া, চিকিৎসা ও যাতায়াত ব্যয় বেড়েছে। ফলে বর্তমানের সর্বনিম্ন মজুরি দিয়ে একজন শ্রমিকের জীবনযাপন সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি ওভারটাইম করেও সংসারের খরচ চালাতে পারছেন না শ্রমিকরা। এ কারণে ন্যূনতম মজুরি ইস্যুতে ক্রমেই ফুঁসে উঠেছেন দেশের পোশাক শ্রমিকরা। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মিল রেখে বেতন বাড়ানোর জন্য মজুরি বোর্ড গঠনের দাবি তাদের। তা না হলে দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলনে নামবেন বলে হুমকি দিয়েছেন শ্রমিক নেতারা। ইতিমধ্যেই ঢাকা ও এর আশেপাশে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন তারা।

শ্রমিকদের পাশাপাশি বাম ধারার সংগঠনগুলোও আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন। তবে নির্বাচনের আগে পোশাক শিল্পে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দারিদ্র্যসীমার আয়ের যে মানদ- বিবেচনা করা হয় তারচেয়ে বর্তমানে শ্রমিকরা কম মজুরি পাচ্ছেন। টাকার মান কমায় শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশছোঁয়া। সেই হিসাবে ২০১৮ সালের গঠিত সর্বনিম্ন মজুরি ৮ হাজার টাকা দিয়ে বর্তমানে একজন শ্রমিকের কিছুই হয় না। ওভারটাইম মিলেও মাসিক খরচ জোগাতে পারছেন না। তাই মজুরি পুনঃনির্ধারণ করা জরুরি। সেই হিসাবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে হওয়া উচিত বলে তারা মনে করেন।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণায় দেখা গেছে, মোটামুটি চার জন সদস্যের একটি পরিবার পরিচালনায় (নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয়) ঢাকার জন্য ১৯,২০০ থেকে ২২,৯০০ টাকা, চট্টগ্রামের জন্য ২১,৩০০ টাকা থেকে ২৬ হাজার টাকা এবং গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের জন্য ২২ হাজার ৯০০ টাকার প্রয়োজন। কিন্তু কর্মীদের রিপোর্ট করা গড় উপার্জন ২০২২ সালের এপ্রিল-জুন পর্যন্ত ছিল অনেক কম। তাদের গড় আয় ছিল প্রায় ৯ হাজার ৯৮৪ টাকা। এলাকাভেদে বর্তমান মজুরি ও প্রয়োজনের মধ্যে ব্যাপক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এই ব্যবধান পূরণ করার জন্য কর্মীরা ক্রমবর্ধমান ওভারটাইম এবং অতিরিক্ত ঘণ্টার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু তারপরও সেটি অনেক ক্ষেত্রে পূরণ হচ্ছে না। ফলে পরিবারের নানা চাহিদা থাকছে অপূর্ণ।

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করতে দ্রুত মজুরি বোর্ড গঠন করা উচিত। বর্তমানে শ্রমিকের মজুরি পুনঃনির্ধারণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের তুলনায় পৃথিবীতে এত কম মজুরি আর কোথাও দেয়া হয় না। উৎপাদন ব্যয় বাড়লে যদি মূল্য সমন্বয় করা হয়, তাহলে শ্রমিকের মজুরি কেন সমন্বয় হবে না?

শ্রমিক নেতারা অবিলম্বে মজুরি বোর্ড গঠন, বোর্ডে প্রকৃত শ্রমিক প্রতিনিধি নিয়োগ, শ্রমিকদের জন্য ২৫ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণ, পূর্ণাঙ্গ রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকার ও গার্মেন্ট মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান। অন্যথায় শ্রমিকরা রাজপথে নামতে বাধ্য হবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন তারা।

শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহ-সভাপতি জলি তালুকদার বলেন, ২০১৮ সালে গার্মেন্ট শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা হয় ৪ হাজার ১০০ টাকা, বাসা ভাড়া ২ হাজার ৫০ টাকা, খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬০০ টাকা ও যাতায়াত ভাতা ৩৫০ টাকা। সবমিলিয়ে সর্বনিম্ন মজুরি ধরা হয় ৮ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে বর্তমানে কিছুই হয় না। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মিল রেখে সরকারকে মজুরি বাড়াতে হবে। আগামী এক মাসের মধ্যে মজুরি বোর্ড গঠন করতে হবে। এই বোর্ডে শ্রমিকদের একজন প্রকৃত প্রতিনিধি থাকতে হবে। ন্যূনতম মজুরি আমরা ২৫ হাজার টাকা দাবি করছি। দাবি না মানা হলে রাজপথে আন্দোলন করা হবে। ইতিমধ্যেই মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আগামী ১লা মার্চ মন্ত্রণালয় অভিমুখে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে। এর পরেও দাবি আদায় না হলে আগামী এপ্রিলে সব শ্রমিক সংগঠন মিলে যৌথভাবে বড় সমাবেশ করার কথা জানান তিনি।

মজুরি বোর্ডের সাবেক সদস্য ও জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, সব কিছুর দাম বেড়েছে। তাই আমাদের মূল দাবি হলো অবিলম্বে মজুরি বোর্ড গঠন করা।

এদিকে সম্প্রতি রাজধানীর প্রেস ক্লাবে শ্রমিক সমাবেশ এবং মিছিল শেষে অবিলম্বে মজুরি বোর্ড গঠন করে ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি ঘোষণা এবং প্রতিটি কারখানায় রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

অবিলম্বে মজুরি বোর্ড গঠন, প্রকৃত শ্রমিক নেতাকে মজুরি বোর্ডে সদস্য নির্বাচন ও ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবি জানিয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলন। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে এসব দাবি জানান গার্মেন্টস শ্রমিক নেতারা।

এদিকে সম্প্রতি সাভারের আশুলিয়ায় পোশাক শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় পোশাক খাতে মজুরি বোর্ড পুনর্গঠনের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করেছে বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সদস্যরা। মানববন্ধনে ফেডারেশনের আঞ্চলিক কমিটির আলমগীর হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অরবিন্দু ব্যাপারী বিন্দু।

বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রাণই হচ্ছে এ দেশের শ্রমিকরা। শ্রমিকদের সুস্থ দেখতে চায় কারখানা মালিকরা। এ গুরুত্ব বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হচ্ছে। শ্রমিকরা সুস্থ থাকলে তারা খুশি মনে কাজ করে। কারখানায় অনুপস্থিতির ঘটনা কম হয়। ফলে কারখানার মালিক কর্তৃপক্ষও সন্তুষ্ট থাকে। তবে আন্দোলন হলে পোশাক শিল্পে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

https://mzamin.com/news.php?news=44457