সরকারের ঋণের বোঝা এখন সকল সময়ের সীমা অতিক্রম করেছে। অর্থনৈতিক সেক্টরে দুর্নীতি, লাগামহীন লুটপাট এবং উন্নয়ন প্রকল্পে ভ্রান্তনীতির কারণেই এই জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঝুঁকিমুক্ত থাকলেও সর্বশেষ হিসাবে দেশে মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ কোটি টাকা। এটি জাতীয় বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ। এই ঋণের বিপরীতে গেল অর্থবছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকার সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে। যা অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা হিসাবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরেও সুদ খাতে গুনতে হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। একই সাথে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও ডলারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি। ফলে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ও সুদ ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণসংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ঋণ ও সুদ ব্যয়ের তথ্য। সূত্রমতে, মোট ঋণের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ ৮ লাখ ৪৭ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। যা সরকারকে অনেকটা লেজেগোবরে অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।
এদিকে প্রতিবছরই ঋণের আকার বাড়ছে। এক বছরের ব্যবধানে ২ লাখ ৭৭৬ কোটি টাকা বেড়েছে ঋণ। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঋণের অঙ্ক ছিল ১০ লাখ ৬ হাজার ২০২ কোটি টাকা। এখানেও এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। কোভিড-১৯ আঘাত হানার পর ঋণের বহর বেড়েছে বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মানদ-ে একটি দেশ তার মোট জিডিপির ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবে। সেটি ঝুঁকি মুক্ত হিসাবে গণ্য হবে। সে হিসাবে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ মোট জিডিপির ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণের অনুপাত জিডিপির ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে এখনও ঝুঁকিমুক্ত বাংলাদেশ এমনটি বলা হয় সেখানে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সম্পূর্ণ আলাদা।
সারা বছরের আয় ও ব্যয় করতে বাজেট প্রণয়ন করে সরকার। এই বাজেটের একটি অংশ ঘাটতি থাকে। এই ঘাটতি পূরণে দেশের ভেতর ব্যাংকিং খাতসহ অন্যান্য উৎস ও বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়। ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের পর যে পরিমাণ অর্থ সরকারের কাছে পাওনা আছে সেটি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে অর্থ বিভাগ।
মূলত, ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাব ধরে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। চলতি অর্থবছরের গত ৭ মাসে আরও ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ করা হয়েছে। তবে প্রকৃত ঋণের হিসাবটি করা হয় অর্থবছরের শেষে। যে কারণে চলতি অর্থবছরের প্রকৃত হিসাব পেতে জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ফলে আগস্ট থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আইএমএফসহ বৈদেশিক ঋণ এখানে যুক্ত হয়নি।
ঋণ হিসাবে দেখা গেছে, ব্যাংকিং খাত থেকে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ ঋণ গ্রহণ এবং বিপরীতে পরিশোধ করা হয়েছে এরপরও ঋণ আছে ৪ লাখ ১৯ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। এটি দেশের মোট ঋণের ৩১ শতাংশ। দ্বিতীয় ঋণের খাত হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। এ খাত থেকে ৩ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়া আছে। এটি মোট ঋণের ২৭ দশমিক ২০ শতাংশ। ঋণের তৃতীয় খাত হচ্ছে ট্রেজারি বন্ড। এখান থেকে নেয়া হয় ৩ লাখ ২৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। এভাবে পর্যায়ক্রমে ট্রেজারি বিল থেকে ৭৭ হাজার কোটি টাকা, সুকুক বন্ডের ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং সরকারি চাকরিজীবীদের সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিল (জিপিএফ) থেকে নেয়া হয়েছে ৬২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এসব ঋণ আগামীতে সরকারকে পরিশোধ করতে হবে।
সূত্র জানায়, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জরুরিভাবে স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনা, টিকা দেওয়া কার্যক্রমসহ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে একদিকে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। অপরদিকে বৈদেশিক সহায়তা পাওয়ার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৫৫ কোটি ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণ পাওয়া গেছে ৪৫৯ কোটি ডলার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের ঋণের বিপরীতে প্রতিবছরই বড় অঙ্কের সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধে গেছে ২৪ হাজার ৩৮৮ টাকা, সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে সুদ পরিশোধ ব্যয় হয় ৪০ হাজার ৮ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হয় ৪২৩৫ টাকা। সাধারণ ভবিষৎ তহবিলের ঋণের বিপরীতে ৭ হাজার ১২৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। যা আমাদের অর্থনীতিকে অস্থির ও অশান্ত করে তুলেছে।
যদিও আন্তর্জাতিক মানদ-ে আমাদের ঋণের পরিমাণ ঝুঁকিমুক্ত বলে মনে করা হয়। কিন্তু সরকারের ঘাড়ে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের বোঝা যেভাবে বেড়েছে এবং নানাবিধ কারণে জাতীয় অর্থনীতি যেভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তাতে এই ঋণের পাহাড় সরকারকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে। এমতাবস্থায় সরকারের ঋণের বোঝা না বাড়িয়ে সকল ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতা সাধনের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। প্রয়োজনে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও কাটছাঁট করার সময় এসেছে। মূলত, অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারকে অর্থনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করা দরকার। অন্যথায় ঋণের বোঝা সরকারের জন্য বিপর্যয় ঢেকে আনতে পারে। এমনকি ব্যহত হতে পারে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কার্যক্রমও।