২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ১২:২০

প্রাথমিকের বই ছাপতে চায় অধিদপ্তর

প্রস্তাব যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, বেসরকারি প্রকাশকরা না পারলে বই ছাপানো হবে বিজি প্রেসে

প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই নিজেরাই ছাপাতে চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। যথাসময়ে পাঠ্যবই সরবরাহ, মুদ্রণ মান তদারকি ও নিশ্চিত এবং ভুলত্রুটিমুক্ত রাখার লক্ষ্যে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি বৈঠক করে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

নীতিগত সিদ্ধান্তের জন্য দু-একদিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পরিবর্তে নিজেরাই দরপত্র প্রক্রিয়া করে পাঠ্যবই মুদ্রণ করবে মন্ত্রণালয়।

প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কেবল বই মুদ্রণের এখতিয়ার এনসিটিবির কাছ থেকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই তৈরিসহ অন্যান্য কাজ যথারীতি এনসিটিবির কাছেই রাখতে চাচ্ছে তারা।

এজন্য এনসিটিবির আইনে পরিবর্তন আনতে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে। এটি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় ২০২৪ সালের পাঠ্যবই এনসিটিবির মাধ্যমেই মুদ্রণ করাতে চায় তারা। সবকিছু ঠিকঠাক চূড়ান্ত হলে ২০২৫ সাল থেকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) পাঠ্যবই মুদ্রণের দায়িত্ব পাবে।

এসব বিষয় নিশ্চিত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফরিদ আহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রম তৈরি, বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণসহ আনুষঙ্গিক কাজে এনসিটিবি ‘ওভারলোডেড’ (কাজের ভারে ন্যুব্জ)। এ কারণে ডিপিই-এর মাধ্যমে কেবল বই মুদ্রণের চিন্তা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এছাড়া বইয়ের মুদ্রণ ও কাগজের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

তাই বেসরকারি প্রকাশকদের মাধ্যমে যদি শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত বই ছাপানো সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে সরকারি ছাপাখানায় (বিজি প্রেস) কাজটি করানোর চিন্তাও আছে। দু-একদিনের মধ্যে এ সংক্রান্ত সারসংক্ষেপ অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। নীতিগত সিদ্ধান্ত পেলে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা হবে। তবে ২০২৪ সালের পাঠ্যবই এনসিটিবির মাধ্যমেই মুদ্রণ করানো হবে। এজন্য একটি সময়সূচি তৈরি করা হয়েছে। সেটি অনুযায়ী অক্টোবরের মধ্যে মুদ্রণকাজ শেষ করে পাঠ্যবই নভেম্বরের মধ্যে উপজেলায় সরবরাহের পরিকল্পনা আছে।

বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী আছে। তাদের জন্য প্রতিবছর ১০ কোটি বই মুদ্রণ করা হয়ে থাকে। ১৩ বছর ধরে ৯৮ লটে ৩০-৩২টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব বই মুদ্রণ করা হচ্ছে। এই বই নিয়ে ৮-৯ বছর ধরে নানান সিন্ডিকেট কাজ করছে।

কখনো চক্রবদ্ধ হয়ে ১ টাকার জিনিস ৩ টাকা দর হাঁকার অভিযোগও আছে। আবার কখনো ১ টাকার জিনিস ৭৫ পয়সায় দর হাঁকার দৃষ্টান্তও আছে। শেষের ঘটনা ২০১৪ সালে এবং চলতি বছর ঘটেছে। আর যেহেতু বই ছাপার মূল উপকরণ কাগজ, কালিসহ অন্যান্য জিনিসের ঊর্ধ্বমূল্য সত্ত্বেও অস্বাভাবিক কম দরে বই ছাপানোর কাজ নিয়েছে।

সংগত কারণে তাই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে নিুমানের কাগজে বিশেষ করে নিউজপ্রিন্টে বই ছাপানোর অভিযোগ আছে। এছাড়া ১ জানুয়ারি শিক্ষাবর্ষ শুরু হলেও এবার এক মাস পরও এই স্তরের বই সরবরাহ করতে না পারার অভিযোগ আছে। মূলত দর কমানো কিংবা বাড়ানো-সবই সিন্ডিকেটের কারসাজি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তা অসাধু মুদ্রাকরদের পক্ষ নিয়ে আসছেন।

সূত্র জানিয়েছে, পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ নিজেদের কবজায় নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি কারণ নেপথ্যে কাজ আছে। এর একটি হচ্ছে-গত বছর (২০২২) কিছু প্রতিষ্ঠান নিুমানের কাগজে বিশেষ করে নিউজপ্রিন্টে বই সরবরাহ করেছে। ডিপিই চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানাসহ শাস্তির সুপারিশ করেছে। কিন্তু নানান কারণে এনসিটিবি সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি।

এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই তৈরি নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। পিইডিপি-৪ (চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি) থেকে পাঠ্যবইয়ের অর্থের সংস্থান হয়। তাই এতে অর্থায়নকারী বিদেশি সংস্থার পরামর্শ মানতে হয় মন্ত্রণালয়কে।

দাতাদের পরামর্শে ২০১৯ সালেই নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করে তারা। তাই এবার যখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা’কে জোর দিয়ে শিক্ষাক্রম তৈরি এবং প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে অনুমোদন করায়, তখন সেটি বাস্তবায়নে অনীহা প্রকাশ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শেষ পর্যন্ত উপর্যুপরি চাপে ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা’র কিছু অংশ নিয়ে এবং আগে তৈরি শিক্ষাক্রম থেকে কিছুটা সরে এসে একটি ‘খিচুড়ি-মার্কা’ শিক্ষাক্রম চালু করেছে। সেই অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে এবার নতুন পাঠ্যবইও দিয়েছে। কিন্তু এই দুটি দ্বন্দ্বে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এর প্রতিক্রিয়া হিসাবেই বই মুদ্রণের এই আলাদা পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।

তবে আরেকটি সূত্র তৃতীয় কারণটির বিষয়ে জানিয়েছে। বই ছাপানোর কাজে কৌশলে মোটা অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য করা হয়। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রভাবশালী মহল যুক্ত থাকায় এ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না। সংগত কারণে বহুদিন থেকে এ বিষয়গুলো অভিযোগ আকারে বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে। কার্যত কেউ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। ভবিষ্যতে অলিখিত এই কমিশন বাণিজ্য অব্যাহত থাকবে কি না, সেটি তদন্তের দাবি রাখে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৯ সাল পর্যন্ত কেবল প্রাথমিক স্তরে বিনামূল্যে বই দেওয়া হতো। ২০১০ সালে মাধ্যমিক স্তরেও বিনামূল্যে বই দেওয়া শুরু হয়। তখন থেকে প্রাথমিক স্তরের বই আগেই ছাপিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এবার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই তৈরি এবং তা অনুমোদনে দেরি হয়। ফলে এই (প্রাথমিক স্তরের) বই ছাপার কাজও পরে শুরু করা হয়।

এছাড়া বকেয়া বিলের দাবিতে মুদ্রাকররা প্রায় দুই সপ্তাহ ধর্মঘট করেন। এ দুই কারণে এবার স্কুলে বই পাঠাতে দেরি হয়। এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, নিজেদের অধীনে ছাপার কাজ নেওয়ার পেছনে এই দেরি হওয়ার অজুহাতও কাজে লাগাচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ এর দায় এনসিটিবির নয়।

জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বিস্তারিত মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করে বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা-সরকারের দুটি মন্ত্রণালয়। সার্বিকভাবে সরকার জাতীয় স্বার্থে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সিদ্ধান্ত হলে ডিপিই তাদের বই আলাদা ছাপাতে পারে। তবে আইনে সেই সুযোগ নেই। তাছাড়া চলতি বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেই দায়ভার এনসিটিবির নয়। কেননা বই মুদ্রণের প্রয়োজনীয় অনুমোদনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ই বিলম্ব করেছে।

সূত্র জানায়, এবার প্রথম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যবই গেছে। আগামী বছর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে বই দেওয়া হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আগামী বছরের নতুন পাঠ্যবই এবারের নভেম্বরের মধ্যে স্কুলে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ লক্ষ্যে মার্চের মধ্যে দ্বিতীয় এবং এপ্রিলের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণির নতুন পাঠ্যবই লেখার কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এছাড়া প্রাক-প্রাথমিক, ৬টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বই এবং প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র জুনের মধ্যে শেষ করার সময়সূচিও নির্ধারণ করা হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/648909