২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ১১:৫৯

মার্চে মশা চার-পাঁচ গুণ বাড়বে

‘দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হয়। সন্ধ্যা হলে উৎপাত কয়েক গুণ বেড়ে যায়। খাইতে-বসতে শান্তি পাই না। সারাক্ষণ কানের কাছে ভনভন করে।’

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মহানগর এলাকার এক চায়ের দোকানে বন্ধুকে এসব কথা বলছিলেন খাইরুল ইসলাম।

এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মশার উৎপাত তো ১২ মাসই থাকে। কিন্তু এবারের মতো এত মশা গত পাঁচ বছর দেখি নাই। কয়েল, এরোসল, ক্রিম ব্যবহার—কোনো কিছুতেই কাজ হয় না। সিটি করপোরেশনের লোকজন মাঝেমধ্যে এসে ওষুধ দিয়ে যায়, কিন্তু আগের মতো মশা কমে না।’
শুধু মহানগর এলাকা নয়, ঢাকার বস্তি থেকে অভিজাত এলাকা—সব জায়গায় মশার রাজত্ব। গত এক সপ্তাহে মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি, বাংলামোটর, বাবুবাজার, শনির আখড়া, উত্তরা, গুলশান ও বসুন্ধরা এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিনের বেলা মশার কামড় থেকে রেহাই পাচ্ছে না নগরবাসী। মশাবাহিত রোগ নিয়ে যেমন শঙ্কা বেড়েছে, তেমনি প্রশ্ন উঠেছে মশা নিধন কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, মার্চে মশার ঘনত্ব চার-পাঁচ গুণ বাড়বে।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা লুৎফা রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার ছয় মাসের ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকি। ১৫ দিন হলো ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠেছে। এখন সারা দিন মশারি টানিয়ে রাখি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ছিটায়, এতে কি মশা কমতে দেখেছেন?’

প্রতিবছর সাধারণত জানুয়ারিতে মশার উপদ্রব বাড়ে। এ মৌসুমে মশা বেড়েছে নভেম্বরের শুরু থেকে। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অন্য সময়ের তুলনায় এ বছর ঢাকায় মশার লার্ভার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। উড়ন্ত মশার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় আট গুণ।

মাঠ পর্যায়ে মশার স্বভাব, ঘনত্ব, প্রজনন ও পরিবেশের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক নিয়ে গত আট মাসের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, মার্চে মশার ঘনত্ব চরমে পৌঁছবে। গত বছরের জুন-জুলাইয়ের তুলনায় মার্চে মশার ঘনত্ব চার-পাঁচ গুণ বাড়তে পারে। এই ঘনত্ব শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশেই হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমাদের গবেষকদল বছরের অন্যান্য সময়ে (জুন-জুলাইয়ে) প্রতি ডিপে লার্ভার ঘনত্ব পেত গড়ে ১৫ থেকে ২০টি, বর্তমানে তা ৫০টির বেশি। আবার পার ম্যান আওয়ার (পিএমএইচ) উড়ন্ত মশার ঘনত্ব ওই সময় আমরা পেতাম ২০টির কম, যা বর্তমানে গড়ে ১৫০টির বেশি। পিএমএইচ বলতে আমরা বুঝি, একটি মানুষকে এক ঘণ্টায় কত মশা কামড়াতে আসে। এই ঘনত্ব মার্চ মাসে আরো অনেক বেশি হবে।’

ঢাকার ছয়টি স্থানকে কেন্দ্রস্থল হিসেবে নিয়ে নিয়মিত লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে নিয়ে এসে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে।
কবিরুল বাশার বলেন, শীত-পরবর্তী সময়ে পচা পানিতে জন্মানো কিউলেক্স মশার ঘনত্বই সবচেয়ে বেশি, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব এই সময়ে কম।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। উনারা প্রতিবছর এ ধরনের উদ্ভট ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন। এর আগেও উনাদের ভবিষ্যদ্বাণী ফলেনি, এবারও ফলবে বলে মনে হয় না।’

ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘এখন মূলত কিউলেক্স মশার মৌসুম। ড্রেন, ডোবা, নালা, খাল-বিল এগুলো হলো মশার আবাসস্থল। এরই মধ্যে অনেক জায়গা পরিষ্কার করেছি, বাকিগুলোও দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আশা করছি, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মশা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলছি। এতে ড্রেনে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। মূলত এ কারণেই মশা বেশি। তবে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন খাল ও ডোবাগুলো পরিষ্কার।’

মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি : রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ উভয় সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণের বাজেট প্রতিবছরই বাড়ে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই সিটি করপোরেশন বরাদ্দ রেখেছে প্রায় ১৪৭ কোটি টাকা, যেখানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ১০১ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ৪৫.৭৫ কোটি টাকা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ জি এম সাইফুর রহমান বলেন, ‘মশা নিধনে আমরা যে পদ্ধতি অনুসরণ করছি, এটি সঠিক নয়। এ পদ্ধতিতে মশা মরে না, বরং জনগণের অর্থের অপচয় হয়। কারণ আমি যে লার্ভিসাইডিং করলাম, এতে মশা মরল কি না, এর মূল্যায়ন করতে যাই না। বলা হয় না, কত শতাংশ মশা মরল। এখানে কোনো সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম নেই, মনিটরিং সিস্টেম নেই, ল্যাবরেটরি নেই।’

তিনি বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের সঠিক কোনো পদ্ধতি না থাকায় মশার লার্ভা কন্ট্রোল করতে পারছি না। একই সঙ্গে অব্যবস্থাপনা ও কারিগরি ব্যবস্থা না থাকায় মশা বেড়েছে। সেটা সামনে আরো বাড়বে। বলা যায়, এবার এপ্রিলের শুরু পর্যন্ত মশার যন্ত্রণা মানুষকে সইতে হবে। এর বাইরে যদি ব্যাপকভাবে বৃষ্টি হয়, তবে মশা হয়তো কিছুটা কমবে।’

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের মায়ামি শহরে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামও বলেছেন, ‘আমরা এত দিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। এতে মশা ধ্বংস হয়নি, বরং অর্থের অপচয় হয়েছে।’

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/02/25/1255385