২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ১১:৪৫

শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছাড়ছে বিদেশীরা


যে কোন মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছাড়ছেন বিদেশীরা। দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে ৬৩ হাজার বেনিশিফিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টধারী বিদেশি বিনিয়োগকারী রয়েছেন। তারা গতবছরের শেষ প্রান্তিকে শেয়ার কেনার পর গত ডিসেম্বর থেকে আবারও শেয়ার বিক্রি শুরু করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তাদের শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়েছে। এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে ‘ব্লক মার্কেটে কম দামে পার্টি অ্যারেঞ্জ (ঠিক) করে শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করেছেন ৬ গুণের বেশি। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সেচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

চার কারণে বিদেশীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে মনে করেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, প্রধানতম কারণ হলো- মার্কিন (ইউএস) ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। অর্থাৎ ডলার বাজারের সংকট বা অস্থিরতা কাটছে না। দ্বিতীয়ত: দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা। এর ফলে ভালো কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচা করতে পারছেন না। তবে সুযোগ পেয়ে এখন ব্লক মার্কেটে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তৃতীয় কারণ হলো- ভালো কোম্পানির অভাব, শেয়ারের দাম অতি মূল্যায়নের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। এসব কারণে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে টাকা হাতে রাখছেন। বিদেশি বিনিয়োগ কমার বিষয়টি স্বীকার করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে নতুন করে বিনিয়োগের জন্য চিন্তা করছেন। আশা করছি মার্চ থেকে বিদেশিরা বড় বিনিয়োগ করবেন।

বিএসইসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশিরা শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করেছেন বেশি। তবে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে তার ছন্দপতন হয়েছিল। সেই মাসে শেয়ার বিক্রির চেয়ে বেশি কিনেছেন বিদেশিরা। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরাও বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কিন্তু নভেম্বর মাস থেকে আবারও শুরু হয় শেয়ার বিক্রির প্রবণতা। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেও ২১ কোটি টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেছেন ১৩৫ কোটি টাকার শেয়ার। অর্থাৎ ৬ গুণের বেশি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন বিদেশিরা। শেয়ার বিক্রি বাড়লেও আশা জাগিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগ বাড়াতে নতুন করে ১২৯টি বিও অ্যাকাউন্ট খুলেছেন তারা। অর্থাৎ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবেন বিদেশিরা। বিএসইসির তথ্য মতে, দেশের পুঁজিবাজারে জানুয়ারি মাসে মোট ২৩ কর্মদিবসে ১১ হাজার ৭২৬ কোটি ৮৪ লাখ ১৪ হাজার ৩২৭ টাকার লেনদেন হয়েছে। তার মধ্যে বিদেশিরা শেয়ার কেনা-বেচা করেছেন ১৭৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৯ হাজার ৮৩৫ টাকার। অর্থাৎ মোট লেনদেনের ১ শতাংশের বেশি এসেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন থেকে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে বিদেশিদের শেয়ার কেনা-বেচা বাবদ লেনদেন হয়েছিল ৩৩১ কোটি ৪৬ লাখ ৫৯ হাজার ৯০১ টাকা। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ১৭৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৯ হাজার ৮৩৫ টাকা কম লেনদেন হয়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় ৫২ দশমিক ৭৫ শতাংশ কমেছে।

২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে বিদেশিরা ১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেছেন ১৭৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। সেই হিসেবে আগের বছরের তুলনায় ২৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি কমেছে। তবে এর মধ্যে একটু স্বস্তির খবর হলোÍ ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে লেনদেন বেড়েছে। ডিসেম্বরের মাসে লেনদেন হয়েছিল ১৩৭ কোটি ৬ লাখ ৫ হাজার ১৩৮ টাকা। অর্থাৎ ডিসেম্বর তুলনায় জানুয়ারিতে লেনদেন বেড়েছে ১৪ শতাংশ।

সূত্র মতে, ১৫৬ কোটি টাকার লেনদেনের মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করেছেন ১৩৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার। তার বিপরীতে শেয়ার কিনেছেন মাত্র ২১ কোটি ২৬ লাখ টাকার। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে বিদেশীরা ১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেছেন ১৭৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। সেই হিসেবে আগের বছরের তুলনায় ২৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি কমেছে। তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ৩৪ কোটি টাকা শেয়ার বিক্রি বেড়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের ৩৬ কোটি ১ লাখ টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে ১০১ কোটি ৪ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছিলেন বিদেশিরা। যা শতাংশের হিসাবে শেয়ার বিক্রি বেড়েছে ৩৩ শতাংশ।

টালমাটাল পুঁজিবাজারে বিদেশিরা যেসব কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করেছেন তার মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য কোম্পানি হলো- প্রকৌশল খাতের কোম্পানির মধ্যে সিঙ্গার বিডি লিমিটেড। বিদেশিরা গত এক মাসে এই কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ১ শতাংশ। অ্যাপোলো ইস্পাতের শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ৮ শতাংশ, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেম লিমিটেডর শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ৬ শতাংশ এবং বিএসআরএম লিমিটেডের শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ৪ শতাংশ।

ব্যাংক খাতের কোম্পানির মধ্যে উত্তরা ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ৬ শতাংশ। ট্রাস্ট ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ১ শতাংশ। পূবালী ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ২ শতাংশ। প্রিমিয়ার ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ১০ শতাংশ। যমুনা ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি হয়েছে দশমিক ৪ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি হয়েছে দশমিক ৩৫ শতাংশ। এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট ব্যাংকের (এক্সিম ব্যাংক) শেয়ার দশমিক ১ শতাংশ, ইবিএলের শেয়ার দশমিক ৩৫ শতাংশ। সিটি ব্যাংকের শেয়ার দশমিক ৮ শতাংশ ও ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি হয়েছে দশমিক ১৩ শতাংশ।

জানুয়ারি মাসে ওষুধ কোম্পানি রেনেটার দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছেন বিদেশিরা। স্কয়ার ফার্মার শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ২০ শতাংশ। বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ১ শতাংশ। মেরিকো বাংলাদেশের শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া যোগাযোগ খাতের কোম্পানি গ্রামীণ ফোনের শেয়ার বিক্রি করেছেন দশমিক ৯ শতাংশ।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক ও সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী জানান, বিদেশিরা আমাদের উদ্ধার করার জন্য আসে না। তারা বিনিয়োগ করে লাভ করতে আসে। ডলার মূল্যে অস্থিরতা থাকায় এখন শেয়ার বিক্রি করে অর্থ তুলে নিচ্ছেন। টাকার মান ঠিক হলেই তারা আবারও পুঁজিবাজারে ফিরতে পারেন। তিনি যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেন, এখন টাকার মান কমে যাওয়ায় ডলার বিক্রি করলেই ১০ টাকা লাভ পাবেন। এখন না বিক্রি করলে দেখা যাবে পরে ডলার প্রতি ২০ শতাংশ মূল্য কমছে। এই জন্যই শেয়ার বিক্রি করছে বিদেশিরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশিরা সবসময় ভালো মৌলভিক্তি সম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। তাদের শেয়ারগুলো এখন ফ্লোরে আটকে আছে। ফ্লোর না থাকলে বিক্রির প্রবণতা আরও বাড়ত। যেহেতু ডলারের মূল্য বাড়ছে আর টাকার মূল্য কমছে তাই বিদেশিরা যত দ্রুত পারছে শেয়ার বিক্রি করছেন। যত দ্রুত শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন, তত দ্রুত বেশি মুনাফা তুলতে পারছেন। বিদেশিরা এখন শেয়ার বিক্রির মানসিকতায় রয়েছেন।

https://dailysangram.com/post/517684