২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৪৪

লণ্ডভণ্ড বিশ্ব অর্থনীতি

ইউক্রেনের পশ্চিম দিকে ঝুঁকে পড়া নিয়ে কয়েক বছরের চাপা উত্তেজনার বোমাটি বিস্ফোরিত হয়েছিল ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ‘বেয়াড়া প্রতিবেশী’ ইউক্রেনকে শায়েস্তা করতে কয়েক গুণ শক্তিশালী রাশিয়া সেনা অভিযান চালায় সে দেশে। রাশিয়াসহ অনেক দেশের ধারণা ছিল, চোখের পলকে কিয়েভের পতন ঘটবে। সেখানে মনমতো সরকার বসিয়ে ঘরে ফিরবে রুশ ফৌজ।

বিশেষ করে রাশিয়ার হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়ে ইউক্রেন পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও পশ্চিমাদের সহায়তায় যুদ্ধকে বছর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করেছে সাবেক সোভিয়েত দেশটি। তবে ইউক্রেনের সীমা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে বৈরী অর্থনৈতিক প্রভাব ডেকে আনে তা।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, আগের বছরের তুলনায় গত বছর খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশ। যুদ্ধের কারণে জ্বালানির বাজারও অস্থিতিশীল হয়। জুন নাগাদই অপরিশোধিত তেলের দাম হয় ব্যারেলপ্রতি ১২২ ডলার, যা যুদ্ধ শুরুর আগে ছিল ব্যারেলপ্রতি মাত্র ৯২ ডলার।

এ যুদ্ধ শিগগিরই থামার লক্ষণ এখনো নেই। বরং এক বছর পূর্তিতে পূর্ব ও পশ্চিম দুই শিবির যেন বিগত দিনের শীতল যুদ্ধের আবহ নিয়ে মুখোমুখি।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ ঘোষণা দেন। কাছাকাছি সময়ে দেওয়া দুটি ভাষণে ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগদানের আগ্রহ ছাড়াও সে দেশের রুশভাষী সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন পুতিন। তিনি আরো বলেন, পশ্চিমারা রাশিয়াকে অপদস্থ করতে চায়।

বেশ কিছুদিনের চেষ্টার পর কিয়েভে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়ে এপ্রিল থেকে নিজের সীমানার কাছের পূর্ব ইউক্রেনে দখল প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয় রাশিয়া।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, যুদ্ধকে এক বছর ধরে দীর্ঘায়িত করার নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রিত কিন্তু অব্যাহত সামরিক সহায়তা।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউক্রেনকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অর্থ সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সহায়তার পরিমাণ চার হাজার ৬৬০ কোটি ডলার। যুক্তরাজ্য দিয়েছে ৫১০ কোটি ডলার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সহায়তা করেছে ৩৩০ কোটি ডলার। এ ছাড়া পশ্চিমাদের মিত্র অন্য দেশগুলো ইউক্রেনকে সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।

খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির মূল্যে যুদ্ধের প্রভাব : যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্ব কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। ইউক্রেন থেকে কৃষিপণ্য সরবরাহে তৈরি হয় গুরুতর সংকট। এতে বিশ্বজুড়ে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, আগের বছরের তুলনায় গত বছর খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশ।

এশিয়া থেকে আফ্রিকার দরিদ্র অঞ্চলজুড়ে এর চরম প্রভাব দেখা যায়। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের তীব্র মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাত কোটি ১০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের মুখে পড়েছে।

যুদ্ধের কারণে জ্বালানির বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। পেট্রল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও রূপান্তরিত তরলায়িত গ্যাসের (এলএনজি) দামও ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। বিশ্ববাজারে তেলের অন্যতম প্রধান জোগানদাতা রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ সংকট আরো ঘনীভূত করে।

বর্ষপূর্তিতে হামলার আশঙ্কায় ইউক্রেন : ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি বেশ কিছুদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন, নতুন করে আক্রমণের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে মস্কো। হামলার আশঙ্কায় ইউক্রেনের অনেক জায়গায় স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে কিয়েভের অনেক কর্মকর্তা এও বলছেন, শক্তিমত্তা দেখানোর মতো পরিস্থিতি মস্কোর এখন আর নেই।

ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান ক্রাইলো বুদানোভ বলেন, কোনো কিছুই অস্বাভাবিক নয়। (বর্ষপূর্তি উপলক্ষে) রাশিয়ার দিক থেকে ছোটখাটো ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

রুশ-মার্কিন দ্বৈরথের আশঙ্কা : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্তির প্রাক্কালে কথার লড়াইয়ে লিপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অতি সম্প্রতি ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে ২০১০ সালে সম্পাদিত আলোচিত পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’ থেকে আপাতত সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন পুতিন। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্নায়ুযুদ্ধ পরিসমাপ্তির পর পরমাণু অস্ত্র সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় সমঝোতাটি মুখ থুবড়ে পড়ার মাধ্যমে বড় ঝুঁকি তৈরি হলো। এই চুক্তি মেনে না চলার পরিণতিতে পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা আবার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন একে ভুল পদক্ষেপ আখ্যা দিয়েছেন।

এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাব্যতা নিয়েও পাল্টাপাল্টি মন্তব্য করেছে রুশ ও মার্কিন পক্ষ।
সহায়তা অব্যাহত রাখবে পশ্চিমারা : মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে নিজে কিয়েভ সফর করেছেন। দেশটিকে সহায়তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে আধুনিক ট্যাংক পাওয়ার নিশ্চয়তা এরই মধ্যে আদায় করে নিয়েছেন জেলেনস্কি। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল স্ক্যান্ডিনেভীয় অঞ্চলের দেশ ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিক্ক সাভোলা ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা ইউক্রেনকে জার্মানির তৈরি দুটি ‘লেপার্ড২’ ট্যাংক সরবরাহ করতে যাচ্ছেন। অন্যদেরও একই কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। সুইডেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পল জনসন ঘোষণা দিয়েছেন, নর্ডিক দেশগুলো ইউক্রেনকে আরেক দফা সহযোগিতা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সূত্র : এএফপি, বিবিসি, আলজাজিরা

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/02/24/1255102