২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:১১

মানিকগঞ্জে গ্যাস না দিয়েই ৩০০ কোটি টাকা বিল নিয়েছে তিতাস

সংযোগ না দিলে বিল দেয়া বন্ধ : মেয়র

গ্যাস সরবরাহ না করেই গত একযুগে মানিকগঞ্জ অঞ্চলে জনগণের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিল নিয়েছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। গ্যাসের দাবিতে মিছিল-মিটিং, আন্দোলন করেও কোনো লাভ হয়নি আবাসিক গ্রাহকদের। বরং জনগণের গ্যাসের দাবিতে মিছিলে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে অনেক গ্রাহক। পুলিশের মামলায় জেল-জুলম হয়রানির শিকার হয়েছে গ্রাহকরা। দিশেহার গ্রাহকরা এখন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় ব্যস্ত।

২০১০ সাল থেকেই মানিকগঞ্জে গ্যাস সরবরাহ কমতে থাকে এবং ২০১২ সালের প্রথম দিকে আবাসিক গ্রাহকরা সপ্তাহে শুধু শুক্রবার গ্যাস পেত। কিন্তু বছরের মাঝামাঝিতে গ্যাস সরবরাহ শূন্যের কোটায় চলে আসে।

গ্যাস না পেয়েও বছরের পর বছর নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে থাকা গ্রাহকরা অসহায় হয়ে পড়লে ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বর্তমান মানিকগঞ্জ পৌর মেয়র মো: রমজান আলীর নেতৃত্বে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবিতে মিছিলে পুলিশের টিয়ার শেল ও গুলিতে আহত হয় দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিক, সাধারণ জনগণসহ মেয়র মো: রমজান আলী, তার স্ত্রী ও ভাই মো: দেলোয়ার হোসেনসহ অনেকেই। পুলিশ বাদি মামলায় সাধারণ নিরপরাধ মানুষসহ মিছিলে অংশগ্রহণ না করা বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের জেল-জুলুম হয়রানি করা হয় বলেও রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ।

তিতাস গ্যাস মানিকগঞ্জ অঞ্চলের ম্যানেজার প্রকৌশলী মো: আতিকুর হক সিদ্দিকী বলেন, দৈনিক আমাদের চাহিদা ২২.৬ এমএমসিএফডি। কিন্তু আমরা পাচ্ছি ১১.৮ এমএমসিএফডি। প্রতি দিন ঘাটতি থাকছে ১১ এমএমসিএফডি। আবাসিকে প্রতি এমএমসিএফডি গ্যাসের দাম ১৮ টাকা এবং সিএনজি পাম্পে ৩৫ টাকা।

মানিকগঞ্জ অঞ্চলে আবাসিক ডাবল চুলা হচ্ছে ২১৭৭৩টি এবং একক চুলা হচ্ছে ১১০৯টি। ডাবল চুলার প্রতি মাসে বিল ১০৮০ টাকা এবং একক (সিঙ্গেল) চুলার বিল হচ্ছে ৯৯০ টাকা। এ ছাড়াও ১৭টি সিএনজি পাম্প ও ৪৩টি শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ আছে। তার হিসেবেই শুধু আবাসিকে প্রতি মাসে বিল করা হয় ২ কোটি ৩৫ লাখ ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা। বছরে ২৯ কোটি ৫৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।

এ হিসেবে গত ১২ বছরের মধ্যে যে সামান্য গ্যাস মাঝেমধ্যে ছিল তাতে পুরো ২ বছরও যদি নিয়মিত সরবরাহ ধরা হয় তাহলে বিগত ১০ বছর কোনো গ্যাস ছিল না। এ হিসেবে গত ১০ বছরে ২৯৫ কোটি ৩৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা মানিকগঞ্জ অঞ্চলের শুধু আবসিক গ্রাহকদের কাছ থেকে গ্যাস না দিয়েই বিল নিয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। ম্যানেজার আতিকুল হক সিদ্দিকী আরো জানান, আশুলিয়ার সিএমবি রোড ডিআরএস (প্রেসার নিয়ন্ত্রক) হতে সাভার হয়ে মানিকগঞ্জ দিয়ে আরিচাঘাট পর্যন্ত এ লাইন গিয়েছে।

গ্যাস দিতে পারছেন না অথচ বিল নিচ্ছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংযোগ থাকলে অবশ্যই বিল দিতে হবে। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। তবে যারা লাইন বিচ্ছিন্ন করতে আসছে আমরা তাদের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। এ পর্যন্ত ৬০টি লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এবং আরো অবেদন আছে বিচ্ছিন্ন করার। তা ছাড়া গ্যাস না দিয়েই বিল নেয়ার বিষয়ে তিতাস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট হয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি আমরা আমাদের ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার অবহিত করে যাচ্ছি। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হতে কত দিন লাগবে তা আমরা বলতে পারব না।

মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার গ্রাহক মো: আলহাদ হোসেন বলেন, প্রায় একযুগ কোনো গ্যাস নেই কিন্তু আমাদের কাছে বিল নেয়া হচ্ছে। আবার সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি। সরকার নির্ধারিত দাম ১২ কেজির সিলিন্ডার ১৪৯৮ টাকা কিন্তু নেয়া হচ্ছে ১৭০০ টাকা হতে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত। দেখার কি কেউ নাই, এটা তো আমাদের ওপর জুলুম।

গৃহিণী রেবেকা সুলতানা বলেন, বছর ১০ আগে মাঝেমধ্যে গভীর রাতে গ্যাস আসত আর আমরা রাত জেগে হলেও তা দিয়ে রান্নাসহ পানি ফুটানোর কাজ করতাম। এখন আর পানি ফুটিয়ে পান করা সম্ভব নয়। গ্যাস নাই অথচ সরকার নিয়মিত বিল নিচ্ছে। এটা কি নাগরিকদের সাথে অন্যায় নয়? শিবালয় উপজেলার টেপড়ার সাবেক ব্যাংকার মো: মহিউদ্দিন বলেন, আমার বাসায় মোট ৮টি লাইন ছিল। আগেই সাতটি কাটা হয়েছে। আজ সর্বশেষটি বিচ্ছিন্ন করার আবেদন করে গেলাম। গ্যাস পাব না কিন্তু বছরের পর বছর বিল আর কতকাল দিবো। শিবালয় উপজেলার গোয়ারিয়া গ্রামের স্কুল শিক্ষক মো: হাবিবুর রহমানসহ চারজন ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আবেদন নিয়ে আসে স্থানীয় তিতাস গ্যাস কার্যালয়ে।

মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক বিপ্লব চক্রবর্তী বলেন, যেহেতু পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ সমস্যা হচ্ছে সেক্ষেত্রে সিলিন্ডার গ্যাসে ভর্তুকি দিয়ে দাম জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রেখে বিক্রয় করা হোক। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মানিকগঞ্জ জেলা সভাপতি গোলাম ছারোয়ার ছানু বলেন, সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বেশি নেয়া হচ্ছে এটা মোবাইল কোর্ট করে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। পাইপ লাইন হতে আবাসিক সংযোগ হয় বিচ্ছিন্ন করা হোক, না হয় যতদিন গ্যাস দেয়া না হয় ততদিন বিল মুক্ত করা হোক।

জেলা ভোক্তা অর্ধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান রুমেল বলেন, সিলিন্ডার গ্যাসের দাম যারা বেশি নিচ্ছে এ রকম অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিব। তা ছাড়া কিছু কোম্পানি অবৈধভাবে বেশি দাম নিচ্ছে তাদের প্রতিনিধিদের আমাদের হেড অফিসে ডাকা হয়েছে।
কোনো কোনো কোম্পানি বেশি দাম নিচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুনেছি ওমেরা, বেক্সিমেকো, বসুন্ধরার কথা।

মানিকগঞ্জ পৌর মেয়র ও জেলা আ’লীগের সদ্য মেয়াদ শেষকৃত কমিটির সহ-সভাপতি মো: রমজান আলী বলেন, এই গ্যাসের দাবিতে আন্দোলন করাতে আমার পরিবারের উপর গুলি করা হয়। আমার ভাই, আমার স্ত্রী এবং আমিও আহত হই। আমি ব্যক্তিগতভাবে গ্যাস না দিলে বিল দেবো না এবং সবাইকে বলে দেই গ্যাস না পেলে তোমরাও বিল দিবে না। তাতে হাইকোর্ট আর সুপ্রিম কোর্ট যাই করা হোক। আমার পৌরবাসী আর কতকাল গ্যাস না পেয়ে বিল দিবে?

সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবসায়ী বুলবুল এন্টারপ্রাইজের মানিক মো: বুলবুল বলেন, কোম্পানি থেকেই দাম বেশি নেয়া হচ্ছে। প্রতি ১২ কেজি সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি করে আমাদের সামান্য লাভ হলেই চলে কিন্তু কোম্পানিগুলোই সরকার নির্ধারিত দামে আমাদের দিচ্ছে না। বসুন্ধরা, টোটাল, বেক্সিমেকো ১৭০০ টাকার বিক্রি হচ্ছে। ফ্রেস, যমুনা, ইউনি, ডেল্টা, পেট্রোমেক্স বিক্রি হচ্ছে ১৬৫০ টাকায়। অথচ সরকারি দাম হচ্ছে ১৪৯৮ টাকা।

জেলা প্রশাসক মো: আব্দুল লতিফ বলেন, গ্যাস সঙ্কটের বিষয়টি মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে অবগত করা হয়েছে। যদি গ্যাস সরবরাহ না হয় তাহলে যেন বিল না নেয়া হয় তারও প্রস্তাব দিয়েছি। আর সিলিন্ডার গ্যাসের বেশি দাম নেয়ার বিষয়টি নিয়ে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুলতানুল আজম খান আপেল বলেন, আমি গ্যাস না পেয়ে আমার বাসার লাইন গত ৪ মাস আগেই বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। আমার দাবি যাদের বিগত সময়ে গ্যাস সরবরাহ করা হয়নি তাদের বিল মওকুফ করা হোক।

মানিকগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাড. মো: জামিলুর রশিদ খান বলেন, মানুষ বিল দিবে অথচ গ্যাস পাবে না। আবার গ্যাসের দাবিতে মিছিল করলে তাদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে, মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। এখানেই সরকারের নৈতিক পরাজয়।

জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাড. আজাদ হোসেন খান বলেন, মেয়র আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং তার নেতৃত্বে গ্যাসের দাবিতে মিছিল হয়েছে। এটা শুধু তার দাবি না, এটা জনগণের বৈধ দাবি। কিন্তু মিথ্যা মামলা করা হলো সব বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের নামে।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গুডলাক সিএনজি পাম্পের জিএম মো: আব্দুল্লাহ আল কাফি ও শিবালয় উপজেলার রুমি ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার নীল কমল হালদার জানান, গ্যাসের অভাবে আমরা এখন আর গাড়িতে গ্যাস দিতে পারছি না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিতাস গ্যাসের এক কর্মকর্তা বলেন, এমনিতেই তো গ্যাস নাই তার পরেও এমন সব প্রভাবশালী ব্যক্তি এসে শিল্পে নতুন সংযোগ চান এবং নিয়েছেন যা আমাদের কিছুই করার নেই।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/729778