১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ১২:০০

বেপরোয়া রাবি ছাত্রলীগ

একের পর এক শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগ। গত এক বছরে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে নির্যাতন, হুমকি প্রদান, ভয়ভীতি প্রদর্শন, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও আবাসিক শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক হল থেকে বের করে দেওয়া এমনকি স্বাধীনতা দিবসের খাবার লুট করার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

এসব ঘটনার লিখিত অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও জড়িত কাউকে স্থায়ী শাস্তির আওতায় আনেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর শাস্তি না হওয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অন্তত ৪২টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এছাড়া নির্যাতনের শিকার হয়েও প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়নি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে শতাধিক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে ১৩টি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। তার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে মাত্র ৬টির। তবে কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দু-একটি ঘটনার বিচার হলেও সেগুলো ছিল সাময়িক।

সর্বশেষ গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে এক সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীকে শিবির ট্যাগ দিয়ে হলকক্ষে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রক্টর ও হল প্রাধ্যক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

এর আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে চেয়ার ভাঙচুর হয়। এ ঘটনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক সৌমিক এবং আতিক নামে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে ধরে বিভাগের অফিসে নিয়ে যান সাধারণ ছাত্ররা। কিন্তু সন্ধ্যায় ওই দুজনকে সেখান থেকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতির বিরুদ্ধে। এ সময় তিনি শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন বলেও জানা গেছে।
এছাড়া ১৯ জানুয়ারি রাত ১১টায় রাবির শাহ মখদুম হলের ২১৪ নম্বর কক্ষের সামিউল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে মানিব্যাগ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল ওই হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তাজবিউল হাসান অপূর্বের বিরুদ্ধে। বিষয়টি কাউকে বললে প্রাণনাশের হুমকি দেন তিনি। এ ঘটনায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী।

গত ২২ জানুয়ারি রাতে শহিদ শামসুজ্জোহা হলের ছাত্র জাকির হোসেনকে বিছানাপত্রসহ নামিয়ে দেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোমিন ইসলাম ও তার অনুসারীরা। পরে সেই সিটে আরেকজনকে তুলে দেওয়া হয়। বিষয়টি একাধিকবার হল প্রাধ্যক্ষকে জানিয়ে সমাধান না পেয়ে বিছানাপত্র নিয়ে প্রশাসন ভবনের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন ওই শিক্ষার্থী। পরে বিষয়টির সমাধান করা হয়।

একই হলে গত বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের খাবার লুট করে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি চিরন্তন চন্দ ও সাধারণ সম্পাদক মোমিন ইসলাম। ঘটনাটি হল প্রাধ্যক্ষ গণমাধ্যমকর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানালে অভিযুক্তরা উলটো হল প্রাধ্যক্ষকে গালিগালাজ করেন। পরে এ ঘটনায় ক্ষমা চান অভিযুক্তরা।

গত বছরের ২৪ জুন গভীর রাতে নবাব আবদুল লতিফ হলের ২৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে রসায়ন বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মুন্না ইসলামকে মারধর করে বের করে দেওয়া হয়। এরপর মারধরের শিকার হয়ে তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আল-আমিন ক্যাম্পাস ছাড়েন। পরে তিনি গত বছরের ২৬ আগস্ট প্রক্টরের দপ্তরে অভিযোগ সংবলিত একটি চিঠি কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠান।

আল-আমিনকে গত বছরের ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নির্যাতন করা হয়। আল-আমিনের অভিযোগ, নির্যাতনের পর ছাত্রলীগের দুই নেতা তার ডেবিট কার্ড থেকে ৪৫ হাজার টাকা তুলে নেন।

গত বছরের ১৯ আগস্ট চাঁদা না দেওয়ায় মতিহার হলের অর্থনীতি বিভাগের সামছুল ইসলামের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা। হলকক্ষে তিন ঘণ্টা আটকে মারধর করা হয় তাকে।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরও নানা ধরনের অন্যায় অপকর্মের ঘটনা ঘটিয়েছেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তবে খুব কম ঘটনারই প্রতিবেদন জমা পড়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, করোনার পর অন্তত ২৩টি ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হল প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টর দপ্তর ও ছাত্র-উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এসব ঘটনায় ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পাওয়া গেছে। তবে একটি ঘটনায়ও ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

আবাসিক হলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের দখলদারিত্ব, আসন-বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ করে আসছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। বিভিন্ন সময় মানববন্ধন, প্রতীকী অনশনে বসেছেন তিনি।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ছাত্রলীগের এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা নিজেরাও ভাবছি। তাদের এমন ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডে আমরা অসহায় অনুভব করছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ছাত্রলীগের এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হতাশাজনক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ কারণে এগুলো আরও বেড়ে যাচ্ছে। আমরা ভাবছিলাম এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে যাবে। এখন দেখছি তারা ছাত্রলীগের মাথায় হাত বুলিয়ে চলছে। কোনো অপকর্মের পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এর ফলে সামনে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা করছি।

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, আমরা ইতোমধ্যে অনেকগুলো বিষয়ের তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছি। সেগুলো শিগগিরই শৃঙ্খলা কমিটিতে উত্থাপন করা হবে। এ মাসের ২০ তারিখে আমাদের শৃঙ্খলা কমিটির সভা হওয়ার কথা থাকলেও সেদিন সংগত কারণে সভাটি হবে না। তবে শিগগিরই আমরা সভার আয়োজন করব। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল- ইসলাম বলেন, আমরা এসব বিষয়ে সচেষ্ট আছি। ছাত্র নির্যাতন ও শিক্ষক লাঞ্ছিতের প্রতিরোধ বিষয়ে আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি। দু-একদিনের মধ্যে এ কমিটির সদস্যরা আলোচনায় বসবেন এবং কীভাবে এর প্রতিকার করা যায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/646204