১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৫৬

ময়লার ভাগাড়ই আছে ঢাকার খাল

তিন বছরে দৃশ্যমান উন্নয়ন নেই

 খাল ভরাটের ফলে রাজধানীর পানিবদ্ধতা ও পরিবেশ দূষণ বাড়ছে
সিটি করপোরেশনের উচিত খালগুলো দখলমুক্ত করে পরিষ্কার করা : অধ্যাপক আকতার মাহমুদ

খালগুলো পরিষ্কারের কার্যক্রম অব্যাহত আছে : শেখ ফজলে নূর তাপস
মানুষ খালকে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করে এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে : আতিকুল ইসলাম

ধোলাইখালের নাম রাজধানীর সবাই জানেন। এই খালটি বুড়িগঙ্গা ও বালুনদীকে সংযুক্ত করেছে। এক সময় এই খাল দিয়ে ঢাকার আশপাশের জেলার যেমন নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ব্যবসায়ীরা নৌপথে ঢাকার সঙ্গে বাণিজ্য করতেন। খালটির এখন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। যতটুকু আছে, যেন ডাস্টবিন বা ময়লার ভাগাড়। এ ধোলাইখালের মতোই রাজধানীর প্রতিটি খাল এখন একেকটা ডাস্টবিন বা ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার খাল ময়লা-আবর্জনায় ভরাট ও অবৈধ দখলের ফলে পানিবদ্ধতা এবং পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। তা ছাড়া যানজট নিরসনে নৌ-রুট প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনাও ভেস্তে যাচ্ছে। ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে নেওয়ার পর দুই সিটি করপোরেশন নিজস্ব ফান্ড থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে অনেক খাল পরিষ্কার করে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। ঢাকার খালগুলো ময়লার ভাগাড়ই আছে। পরিষ্কারের পর কিছুদিন যেতে না যেতেই সব খাল আবারও ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে।

রাজধানীর খাল পরিষ্কারে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও এর বেহাল দশা দূর হচ্ছে না। আশপাশের বাসিন্দারা প্রতিটি খালে পলিথিন, পুরোনো সোফা, কার্পেট, চটের বস্তাসহ বাসাবাড়ির সব ধরনের ময়লা প্রতিদিনই ফেলে। ফলে বার বার সংস্কারের পরও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার কারণে খালগুলো ফের ভরাট হচ্ছে। আর সেই সুযোগে অনেক স্থানে খালের জায়গা বেদখল হয়ে যাচ্ছে।

এ নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস প্রচÐ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সিটি করপোরেশনের কোটি কোটি টাকা খরচ করে খাল পরিষ্কার কার্যক্রম সঠিকভাবে তদারক করা হচ্ছে না। এ কার্যক্রম যথাযথভাবে তদারকির জন্য কমিশনারদের প্রতি আহŸান জানান। গত ১৪ ফেব্রæয়ারি ডিএসসিসির এক বোর্ড সভায় কমিশনারদের উদ্দেশ্যে মেয়র তাপস বলেন, বার্ষা আসছে। যার যার এলাকায় খাল আছে, আপনারা দয়া করে একটু নজরদারি দিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করিয়ে নেবেন। এ জন্য ঠিকাদার নিয়োগ আছে। আপনাদের একটু নজরদারি বাড়িয়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতে হবে। চলতি মাসের শেষর দিকে শুরু হয়ে তা এপ্রিল পর্যন্ত চলমান থাকবে। আপনারা (কাউন্সিলর) অবশ্যই আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে ওয়ার্ডের নর্দমা পরিষ্কার করিয়ে নেবেন। তিনি বলেন, খালের দায়িত্ব নেয়ার পর প্রাথমিকভাবে পরিষ্কার কার্যক্রম শুরু হয়। গত ২ বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়। কিন্তু মানুষের সচেতনতার অভাবে আবার ময়লা জমতে শুরু করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ৪৬টি খালের মধ্যে ২০টিই বিলীন হয়ে গেছে। কাগজে-কলমে ২৬ খালের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও দখল ও দূষণে এগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছে। রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনে খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

ওয়াসা থেকে বুঝে নেয়ার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনে ১২টি খাল থেকে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে। পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে কিছু কিছু অংশে খননও করা হয়। তবে মাত্র দুই-তিন মাসের ব্যবধানে এসব খাল আগের চেহারায় ফিরে আসে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চারটি খাল সংস্কার এবং নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে ৮৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্প ২০২৬ সাল পর্যন্ত চলবে। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) এলাকার খালের জন্য ৬৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না। ঢাকার খাল ডাস্টবিন বা ময়লার ভাগাড়ই থাকছে। সিটি করপোরেশন মাঝে মাঝে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলে রাখে। এর পর কিছুদিন যেতে না যেতে খালের আশপাশের বাসাবাড়ি, দোকানপাট ও কল-কারখানা থেকে ফেলা বর্জ্য আর প্লাস্টিকে খালগুলো আবারও ভাগাড়ে পরিণত হয়।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর নন্দীপাড়া (জিরানি), রামপুরা, শাহজাহানপুর, মান্ডা, কাটাসুর, উত্তরা দিয়াবাড়ি ও ইব্রাহিমপুর খালের বেহাল অবস্থা। আশপাশের বাসাবাড়ির সব পয়ঃবর্জ্য এবং গৃহস্থালি বর্জ্যও গিয়ে পড়ছে এসব খালে।

খিলগাঁও রেলক্রসিং থেকে তালতলা মার্কেটের দিকে যাওয়ার পথে যে কারও চোখে পড়বে খিলগাঁও-বাসাবো খালের সীমানা পিলার। ঢাকা ওয়াসা এ পিলার স্থাপন করলেও সেখানে খালের কোনো অস্তিত্ব নেই। খাল ভরাট করে মাটির নিচে পাইপ ড্রেন তৈরি করে রেখেছে দখলদাররা। বাসাবো এলাকায় এ খালের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও খিলগাঁও অংশে তা বিলীন হয়ে গেছে। শাহাজাহানপুর এলাকার অংশে এ খালের কিছুটা অস্তিত্ব এখনো আছে। তবে সেটা ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

মান্ডা খালের গুদারাঘাট এলাকার ব্রিজের দুই পাশে যতদূর দেখা যায়, ততদূর চোখে পড়ে ময়লার স্ত‚প। কিছু অংশ দখল করে গোয়ালঘর, দোকান ও আবাসিক ভবনসহ নানা স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।

নন্দীপাড়া খালও ময়লার স্ত‚পে মৃতপ্রায়। মাদারটেক অংশে খালের মধ্যে খুঁটি পুতে বিপুলসংখ্যক দোকান বসানো হয়েছে। এসব বাঁশের খুঁটিতেও ময়লা আটকে স্ত‚প হয়ে আছে। আর বাগানবাড়ী মাদারটেক এলাকায় ওয়াসা পানির পাম্পের পাশে খালের অবস্থা খুবই করুণ। ওখানে খালে ময়লার স্ত‚প জমে আছে। কদমতলী সড়কের পাশ দিয়ে গেছে কদমতলী খাল। প্রায় আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে খালটির কিছু দূর পরপর সাঁকো। স্থানীয়দের অভিযোগ, দখলে খালটি সরু হয়ে গেছে। এখন ময়লায় ভর্তি। জুরাইনের রহমতবাগের পাটেরবাগ ও জুরাইন খালের দশাও একই। দেখে বোঝার উপাই নেই, এটি খাল নাকি ড্রেন।

রামপুরা খালে অবৈধ দখল তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও দূষণের ফলে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খালটির মেরাদিয়া বাজার অংশে বিশাল ময়লার ভাগাড় রয়েছে। ওখানে ময়লা ফেলার সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থাকলেও সেটি অনেকদিন ধরে নষ্ট। এ এসটিএসের সামনে খালের পাড়ে বনশ্রী ও দক্ষিণ বনশ্রীর বাসাবাড়ির ময়লা ফেলা হয়। কিছু ময়লা ল্যান্ডফিল্ডে নিলেও অধিকাংশ খালে পড়ে। একই অবস্থা কাটাসুর খাল, রূপনগর খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল, উত্তরা দিয়াবাড়ি খাল ও কল্যাণপুর খালের। বিভিন্ন সময় অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং খাল পরিষ্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও তা আবার পুরোনো রূপে ফিরছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ ইনকিলাবকে বলেন, মাত্র ৫৫ থেকে ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই রাজধানীতে পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। কারণ, রাজধানীর সারফেস ড্রেনের মুখগুলো প্লাস্টিক ও বর্জ্যে বন্ধ। বৃষ্টির পানি ড্রেনের মুখেই আটকে থাকে। সিটি করপোরেশনের উচিত, খালগুলো দখলমুক্ত করে পরিষ্কার করা। পাশাপাশি নিয়মিত তদারকি করা। খালগুলো বুঝে পাওয়ার পর ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন তোড়জোড় করে কিছু বর্জ্য অপসারণ করেছিল। তবে কিছুদিন পরই খালগুলো আবার পুরোনো রূপে ফিরেছে। এর অন্যতম কারণ কমিউনিটিকে এনগেজ করতে পারেনি। যদি এলাকার মানুষকে সচেতন করা হতো, তাহলে এই অবস্থা হতো না। এখন শুধু মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিক রুটিন মাফিক অভিযান চালিয়ে ক্ষ্যান্ত তারা। তিনি বলেন, খালগুলো হাতে পাওয়ার পর সর্বপ্রথম খালের দখলদারদের তালিকা করা উচিত ছিল। ওই তালিকা অনুযায়ী উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করত, তাহলে খালের এই অবস্থা হতো না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, খালের সীমানা নির্ধারণ করে পিলার বসানো হয়েছে। যে সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে খালের পাড়ে এই সীমানার বাইরেও অবৈধভাবে স্থাপনা করছে। তাদেরকে আমি বলেছি খালের পারের অবৈধ স্থাপনা নিজ দায়িত্বে আপনারা সরিয়ে নিবেন। নিজেরা অবৈধ স্থাপনা না সরালে আমরা বুলডোজার দিয়ে সেই স্থাপনা ভেঙে দেব। রামচন্দ্রপুর খাল একটি ঐতিহাসিক খাল ছিল। আমরা সেটি উদ্ধার করেছি। ময়লার কারণে খালটা আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখানে মাছের নয় মশার চাষ হচ্ছে। আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি মানুষ খালকে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করছে। খালে পলিথিন, পুরোনো সোফা, কার্পেট, চটের বস্তাসহ বাসাবাড়ির সব ধরনের ময়লা ফেলা হয়েছে। খালে ময়লা ফেলা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। খাল দিয়ে নৌযান চলবে, মাছের চাষ হবে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে। এর জন্য সরকার ও সিটি করপোরেশনের সঙ্গে জনগণেরও দায়িত্ব পালন করতে হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/556148