১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৪৬

পর্যবেক্ষক সমন্বয়কে মিলছে না সুফল ১৫ ব্যাংকে

দুর্বলতা ও বিশৃঙ্খলায় ঘুরপাক খাচ্ছে ব্যাংকিং খাত। অবস্থার উন্নতিতে কোনো উদ্যোগেই মিলছে না সুফল। সমস্যাগ্রস্ত ১৪টি ব্যাংক ও একটি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে স্বাভাবিক করতে পর্যবেক্ষক, সমন্বয়ক ও প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কিন্তু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে তারা নিতান্তই অসহায়। এসব পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক কেবল কাগজে-কলমে নিয়ম রক্ষার দায়িত্বে ব্যস্ত। কারণ ব্যাংক পরিচালনার প্রকৃত ক্ষমতা পর্ষদের ওপরই ন্যস্ত।

এমনকি পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক ব্যাংকের ঋণ অনুমোদন, পুনঃতফশিল, খেলাপি, অবলোপন, নিয়োগ, আয়, ব্যয় ও শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। কোনো অনিয়মের বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতাও নেই।

তারা কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অবস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করতে পারে। অথচ প্রচলিত আইনেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে যে কোনো ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে পথে হাঁটছে না। এতে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক নিয়োগ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম রক্ষার কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘একজন পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক একা কী করবেন। একার পক্ষে কতটুকু করা সম্ভব তা সবারই জানা। তারা তো ঋণ অনুমোদন, খেলাপি আদায় কিংবা নিয়োগে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে যে কোনো ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে।

যদিও এটা কোনো সমাধান নয়। তবে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক নিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো প্রজ্ঞাপন নেই। তাদের ক্ষমতাও কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ নেই। প্রাথমিকভাবে পর্যবেক্ষক ব্যাংকের পর্ষদ সভায় উপস্থিত থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে তা অবহিত করেন। কিন্তু সমন্বয়ক পর্ষদ সভায় সশরীরে উপস্থিত থাকেন না। তারা সাধ্য অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করেন।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, অপেক্ষাকৃত কম দুর্বল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক এবং বেশি দুর্বল ব্যাংকে সমন্বয়ক দেওয়া হয়। সে আলোকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ৫ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ৯ ব্যাংকে দেওয়া হয় সমন্বয়ক। এছাড়া একটি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বসানো হয় প্রশাসক।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষকরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারেন না এমন অভিযোগ বেশ পুরোনো। পর্যবেক্ষকরা পর্ষদে মতের প্রতিফলন ঘটাতে পারছেন না।
পর্যবেক্ষক বা সমন্বয়ক মতামত দেওয়ার পরই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে-এমন নিয়ম করা দরকার। তা করতে না পারলে কাগুজে দায়িত্ব পালন ছাড়া তাদের কিছুই করার নেই। এতে দুর্বল ব্যাংকেরও কোনো পরিবর্তন আসবে না।’

একটি বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার জানান, গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, ১০টি দুর্বল ব্যাংককে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্রুতই সেগুলোকে সবল করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। গভর্নরের এমন বক্তব্যের পর কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে সভা করা হয়। বেশ কিছু লক্ষ্য দিয়ে এমওইউ সই করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হলো। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অপর্যাপ্ত জামানত, অনিয়মের মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণ, উচ্চ খেলাপি ঋণ, আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি দেখানোসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে কোনো উন্নতি চোখে পড়ছে না।

এতে বোঝা যায়, পর্যবেক্ষক সমন্বয়ক নিয়োগ নয়, ব্যাংকে ঋণ ছাড়ের তদবির বন্ধ করতে হবে। তা না হলে ব্যাংকে সুশাসন ফিরবে না। আবার কয়েকটি ব্যাংকে তো পর্যবেক্ষকরাই অসহায় থাকেন। কারণ ব্যাংক মালিকদের হাত পর্যবেক্ষকের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা ও অন্যান্য ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তা পর্যবেক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। আর পর্যবেক্ষকরা পর্ষদ সভায় নিজেদের মতামত উপস্থাপন করতে পারবেন। তবে ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকে সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যারা সশরীরে ব্যাংকে যাবেন না। কিন্তু ব্যাংকের সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখবেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করবেন।

একজন সমন্বয়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ব্যাংকগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে সমন্বয়ক নিয়োগ কার্যকর হওয়ার সুযোগ খুবই কম। ব্যাংকের পর্ষদ তো অনেক সময় বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এমনকি পর্যবেক্ষক থাকা অবস্থাতেই কয়েকটি ব্যাংকে অনিয়মের ঘটনা ঘটে। পর্যবেক্ষকরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় অংশ নিতে পারেন। মন্তব্য দেওয়ারও সুযোগ রাখেন। তবে তা রোধ করার ক্ষমতা তো নেই।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘সমন্বয়কদের ব্যাংকের পর্ষদ সভায় উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের থাকতে হয়। এতে অনেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ ঠিকমতো করতে পারেন না। এজন্য পর্যবেক্ষক পদের পরিবর্তে সমন্বয়ক নিয়োগ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

জানা গেছে, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল), বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক), আইসিবি ইসলামিক, বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের সঙ্গে সভা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব শেষ আরও একটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে সভা করা হয়। এর মধ্যে কোনো কোনোটির সঙ্গে তিন বছর মেয়াদি এমওইউ সই হয়েছে। নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে সমন্বয়ক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় এসব ব্যাংকে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/645877