১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ৯:৪১

তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্প ও আমাদের দায়িত্ব

-ড. মো. নূরুল আমিন

তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তে গত সপ্তাহে সংঘটিত ভয়াবহ ভূমিকম্পে স্মরণাতীতকালের ধ্বংসযজ্ঞে মানুষের জানমাল, সম্পত্তি ও সরকারি অবকাঠামোর যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা সারা বিশ^কে বিস্ময় বিমূঢ় করে তুলেছে। এতে শুধু তুরস্কেই মারা গেছেন ২২ হাজার লোক এবং সিরিয়ায় সাড়ে তিন হাজার। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই অনুমান করছেন যে, মৃতের এ সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। বহু মানুষ, শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পর্যটক ধ্বংসাবশেষের নিচে পড়ে আছেন। তাদের উদ্ধারও করা যাচ্ছে না। লাখ লাখ লোক বাড়িঘর হারিয়ে আশ্রয়হীন অবস্থায় খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ-মহাদেশ থেকে অসংখ্য উদ্ধারকর্মী উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কামনা করেছেন এবং বহু দেশ এতে সাড়া দিয়েছে। তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তে ভূমিকম্পে নিহত, আহত ও বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ হতভাগ্য মানুষের জন্য আমরা সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের রূহের মাগফিরাত, যারা আহত হয়েছেন এবং ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়েছেন তাদের দ্রুত মুক্তি ও চিকিৎসা এবং গৃহহারাদের আশু পুনর্বাসন কামনা করছি।

প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, ভূমিকম্পের পর পর গত ৮ ফেব্রুয়ারি আমরা সেখানকার অবস্থা জানা ও কর্তব্য নির্ণয়ের জন্য International Federation for Relief and Development নামক একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জুম বৈঠকে বসেছিলাম। IFRD প্রতিষ্ঠানটি কুয়ালামপুরভিত্তিক এবং সদস্য সংখ্যা ১০টি দেশের দশটি ইসলামী সংগঠন। এদের মধ্যে রয়েছে শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, সুদান ও তুরস্ক। তুরস্কের পক্ষ থেকে ESAM (Social and Economic Researh Centre-এর পক্ষে জনাব ইলমাজ এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা সেখানে যে ত্রাণ চাহিদা নিরূপণ করেছিলাম তার মধ্যে ছিল ১. খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা ও শুকনা এবং পানি, ২. আশ্রুয়স্থল, বিশেষ করে Makeshift তাঁবু, ৩. কাপড়চোপড়, কম্বল ইত্যাদি, ৪. ওষুধপত্র এবং ৫. টয়েলেট্রিজ প্রভৃতি। আইএফআরডি তাৎক্ষণিকভাবে সে ত্রাণ কাজ পরিচালনার জন্য ২৫০০০ মার্কিন ডলার মঞ্জুর করে তা প্রেরণের ব্যবস্থা করেছে। একই সভায় পাকিস্তানের আল খেদমত ফাউন্ডেশন ২ লাখ ডলারের একটি ত্রাণও ঘোষণা করেছে। আইএফআরডি তার সদস্য দেশগুলো বিশ^ সম্প্রদায়ের কাছে বিপন্ন মানবতার সেবায় যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ইসলামী এইড নামক একটি বেসরকারি সংস্থা তাদের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তুরস্ক ও সিরিয়ার দুঃস্থ মানুষের জন্য প্রেরণের ব্যবস্থা নিয়েছে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলগুলোর মধ্যে আমার জানা মতে, এ পর্যন্ত একমাত্র জামায়াতে ইসলামী তুরস্কের ত্রাণ ও পুনরুদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি উদ্ধারকারী দলও ইতোমধ্যে গত শনিবার তুরস্কে পৌঁছেছে। যতই দিন যাচ্ছে সেখানে উদ্ধার কাজে কিছু কিছু সমস্যাও হচ্ছে। বলতে ভুলে গিয়েছি যে, তুরস্ক ও সিরিয়ায় এখন প্রচ- তুষারপাত হচ্ছে। তার সাথে যোগ হয়েছে বৃষ্টিপাত, তুরষারপাত, বৃষ্টি ও ঠা-া বাতাসের মধ্যে উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন। আবার আন্তর্জাতিকভাবে ত্রাণ হিসেবে যে খাদ্যসামগ্রী ও কাপড় চোপড়, কম্বল আসছে সেগুলো মওজুত করে রাখার মতো স্থান সংকুলান করাও যাচ্ছে না। ভূমিকম্পে বাড়িঘর ও বিশাল বিশাল ভবন শুধু ধসে পড়েনি, মাটিতে দেবেও গেছে; রাস্তা দেবে নদী-পুকুরের অবস্থার মতো হয়েছে। গাড়িতে করে ত্রাণসামগ্রী বহন করা কঠিন। গত কয়েক বছরে তুরস্ক সরকার অবকাঠামো তৈরির উপর বেশি জোর দিয়েছিলেন, যেন উন্নয়ন অর্থই অবকাঠামোর উন্নয়ন। যেখানে সেখানে ফ্লাইওভার তৈরি করায় ভূমিকম্পে সেগুলো ধসে পড়ে চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ভবনের ধ্বংসাবশেষের সাথে এগুলো সরিয়ে আটকাপড়া মৃত ও অর্ধমৃত মানুষদের বের করে আনা এতই দুষ্কর হয়ে পড়েছে যে, এখন নিরাপত্তা উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে; দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। এ প্রেক্ষাপটে জার্মানি ও অস্ট্রিয়াসহ কয়েকটি দেশ উদ্ধার কাজ স্থগিত করে দিয়েছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এখন বিরাট সংকটে, কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলার দল তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি ইস্তাম্বুল, আঙ্কারাসহ বেশকিছু শহরের নেতৃত্বে তাদের কাছে হেরে গেছেন। ভূমিকম্প ইস্যুটিকে তারা তার বিরুদ্ধে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। ইসলামপন্থী দলগুলোর অনেকেই তাকে পছন্দ করেন না। তাদের ধারণা তিনি ইহুদিদের হাতে তুরস্কের অর্থনীতি তুলে দিয়েছেন এবং ব্যাংক ও অর্থনীতিকে ইসলামীকীকরণের কোনো পদক্ষেপ নেননি, ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে তার মেয়ের জামাতাসহ অযোগ্য স্বজনদের বসিয়েছেন।

অন্যদিকে মুসলিম পুনরুজ্জাগরণের নেতা হিসেবে পশ্চিমা জগতও তাকে পছন্দ করে না। এই অবস্থায় তুরস্কের এই ভূমিকম্পকে কোনো কোনো মহল মানবসৃষ্ট বলে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছেন। আমি বিজ্ঞানী নই, বিজ্ঞান সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। ভূগর্ভে শক্তিশালী বিষ্ফোরক ফাটিয়ে পৃথিবীর নির্বাচিত অংশের ভূগর্ভস্থ প্লেট Displace করে ভূমিকম্প সৃষ্টি করা যায় কিনা বিজ্ঞানীরাই তা বলতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোভুক্ত দেশসমূহের সাথে এরদোগানের মতানৈক্য চলছে। সুইডেনকে ন্যাটো সদস্য করার তিনি বিপক্ষে একইভাবে ইউক্রেনকেও। তাহলে এটা ঠিক কি তার প্রতিশোধ এবং ক্ষমতা থেকে সরানোর অভিসন্ধি? আল কুরআনে মানবসৃষ্ট ভূমিকম্পের কথা নেই, বাতাসের উপর ভর করে কোনো কিছু বিশ্বাস না করাই ভালো।

তুরস্কে আমি বহুবার ভ্রমণ করেছি। ওসমানী সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি এই দেশটিকে আমি উন্নয়নের একটি মডেল বলে মনে করি। ইতোপূর্বে আমি ইউরোপের উন্নত দেশগুলোও সফর করেছি। এই দেশগুলোর উন্নয়নে সর্বত্র শহর-মফস্বল একটা বৈষম্য সর্বদা পরিলক্ষিত হয়েছে, ইনসাফের দৃষ্টিতে যা কাম্য ছিল না। কিন্তু তুরস্কের ঘটনা ভিন্ন। ওসমানীয় শাসকরা সেই বৈষম্য সৃষ্টি হতে দেননি। তুরস্কের অনেকগুলো শহর আমি সফর করেছি। তুর্কী সুলতানরা গ্রামের প্রতি অবিচার করে শহরকে প্রাধান্য দিতে দেখা যায়নি। ইস্তাম্বুল, আঙ্কারার মতো বড় শহরগুলোতে যেমন সমৃদ্ধ অবকাঠামো রয়েছে, জনগণের সুযোগ-সুবিধা সহজলভ্য ছোট শহরগুলোতেও একই অবস্থা।

দেশটির ১১টি প্রদেশ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে হাতাই ও আনতাকিও রয়েছে। এই দুটি স্থানে আমি অনেক সময় কাটিয়েছি। এখানে হযরত ইউনুস আলাইহিসসালামের কবর এবং গুহাবাসী তিনজন মনীষীর কবরও রয়েছে। জিয়ারত করার সুযোগ আমার হয়েছে। যে গুহায় তারা ছিলেন পাহাড়ের উপর সেই গুহাও আছে। তার নিচেই গ্রীক আমলের পুরানা একটি শহর। তুরস্ক আমাদের ইসলামী ঐতিহ্যের অনেক ধারক ও বাহক। এখানে নবী ও সাহাবাদের কবর রয়েছে। সাললি উরকা প্রদেশটিতে রয়েছে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর অনেক স্মৃতি। এখানে নমরূদ তার জন্য যে অগ্নিকু- তৈরি করেছিল তা আজ লেইকের আকারে সংরক্ষিত আছে। এখানে আরেকটি অগ্নিকু-ও নমরূদ তৈরি করেছিল, সেটি ছিল তার কন্যার জন্য যিনি ইব্রাহিম (আ.)-এর আদর্শ অনুসরণ করেছিলেন। সাললি উরকারই অদূরে আরেকজন নবী আইয়ুব (আ.)-এর কবরও অবস্থিত। সেখানে তার পদাঘাতে সৃষ্ট কুয়াটিও এখনো বিদ্যমান এবং জমজম কূপের ন্যায় মানুষ দেশ-বিদেশ থেকে এসে এখান থেকে পানি নিয়ে যান। কথিত আছে যে, হযরত আইয়ুব (আ.) সাললি উরকাতেই প্রথম কৃষি কাজ শুরু করেছিলেন। তার প্রবর্তিত গম, তুলা ও আঞ্জির চাষ এখনো অব্যাহত আছে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ার দুর্গত মানুষের দুর্দশা লাঘব করুন এই কামনাই করি। মানবতার সেবায় আমাদের যার যা আছে তা নিয়েই এগিয়ে আসা কর্তব্য বলে আমি মনে করি।

 

https://dailysangram.com/post/516561