১৮ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৩৪

বাস–মিনিবাসে নৈরাজ্য, মানুষের চরম দুর্ভোগ

রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত এবং বিআরটিএর অভিযানে নগরে বাস–মিনিবাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক পরিবহনমালিক গত রোববার থেকে বাস-মিনিবাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন। গতকাল সোমবারও ছিল একই অবস্থা। সড়কে বাস-মিনিবাস অনেক কম থাকায় যাতায়াতে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। অন্যদিকে ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধ হলেও ভাড়া কমেনি।
ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি ১৫ এপ্রিল থেকে নগরে বাস–মিনিবাসে ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। রোববার থেকে রাজধানীতে শুরু হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। এই পরিস্থিতিতে শুরু হয় গণপরিবহনে নৈরাজ্য।
গতকাল ফার্মগেট, আরামবাগ, ফকিরাপুল, মতিঝিল, টিকাটুলী, গুলিস্তান, আজিমপুর, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গণপরিবহনের ভাড়া ও নিয়মের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাসের ভেতরে গন্তব্য অনুসারে ভাড়ার তালিকা টাঙানোর নিয়ম থাকলেও তা দেখা যায়নি। একই পথের কোনো পরিবহন সিটিং সার্ভিস বাতিল করলেও অন্য পরিবহন তা বহাল রেখেছে। বাস চলছে কম। প্রায় প্রতিটি বাসস্ট্যান্ডেই যাত্রীদের বাসের জন্য খররোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল মোড়ে জাকিয়া বেগম তাঁর নাতনি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ফাহমিদা আক্তারকে নিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। যাবেন যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগ। স্কুল ছুটি হয়েছে বেলা ১১টায়। অনেকক্ষণ পরপর একটি বাস আসছিল। প্রতিটিই লোকজনে ঠাসা। আগে সিটিং বাসে ১০ টাকা ভাড়ায় যেতেন। এখন লোকাল বাস ৫ টাকা নিচ্ছে, কিন্তু বাসে উঠতেই পারছিলেন না। একই কথা বললেন তাঁদের কাছাকাছি দাঁড়ানো টিপু সুলতান রোডের সলিমুল্লাহ ডিগ্রি কলেজের রসায়নের প্রভাষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। তাঁর বাসা শাহজাহানপুরে। তিনি বলেন, লোকাল বাসে ভাড়া অর্ধেক হয়েছে বটে, তবে বাস পাওয়া যাচ্ছে না।
যাত্রীদের এমন দুর্ভোগের দৃশ্য প্রায় সব বাসস্ট্যান্ডেই দেখা গেছে। গুলিস্তানে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অপেক্ষা করছিলেন নাদিরা বেগম। তিনি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। উৎসব পরিবহনের সিটিং সার্ভিসে নারায়ণগঞ্জ থেকে গুলিস্তান এসেছেন ৩৬ টাকায়। তিনি বললেন, গুলিস্তান-নারায়ণগঞ্জ পথে উৎসব ও বন্ধন নামে দুটি পরিবহন সিটিং সার্ভিস চালু রেখেছে। তাঁর গলায় সমস্যা, শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। কিন্তু গুলিস্তান নেমে বাস পাচ্ছেন না। মোহাম্মদপুরগামী এফটিসিএল পরিবহনের একটি বাস থামল। শাহবাগ হয়েই যাবে। চালকের সহকারী বললেন, লোকাল চলছে। সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা। নাদিরা ওঠার চেষ্টা করলেন। অপেক্ষমাণ অনেক লোক ছুটলেন বাসের দরজার দিকে। হুড়োহুড়ি শুরু হলো। তিনি উঠতে পারলেন না।
টিকাটুলী মোড়ের স্ট্যান্ডে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথের আনন্দ পরিবহনের টিকিটবিক্রেতা রাগিব হোসেন বললেন, তাঁরা সিটিং সার্ভিস চালাচ্ছেন। টিকাটুলী থেকে জুরাইন, পোস্তগোলার ভাড়া ১০ টাকা। তবে বলাকা পরিবহন লোকাল হয়েছে।
গুলিস্তান-ধামরাই পথের বাস লোকাল চলছে। এসব বাসে গুলিস্তান থেকে সাভারের ভাড়া ৩০ টাকা। কিন্তু ঠিকানা পরিবহন সিটিং সার্ভিসই রয়েছে। এই বাসে সাভার ও নবীনগরের ভাড়া ৫০ টাকাই।
ভাড়ার নৈরাজ্য নিয়েও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। দুপুরে আগারগাঁও থেকে নিসর্গ সার্ভিসের বাসে করে আজিমপুরে নামলেন কেরানীগঞ্জের মোহাম্মদ মোখলেস। ভাড়া নিয়েছে ১৫ টাকা। এটি লোকাল সার্ভিস। তিনি বললেন, সকালে আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার সময় ৩৬ নম্বর সিটিং বাসে ২০ টাকা ভাড়া দেন। মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে হিমালয় পরিবহনের বাসে চিটাগাং রোড যাচ্ছিলেন শিপন খান। তিনি বললেন, সকালে আসার সময় ২৫ টাকায় এসেছেন। এই পথে কোনো বাসে ২০ টাকা আবার কোনো বাসে ২৫ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে লোকাল সার্ভিসে আয় কমে যাওয়ার কথা বলেছেন পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আজিমপুর স্ট্যান্ডে দেখা গেল গাজীপুর চৌরাস্তায় যাবে মাইশা পরিবহনের একটি বাস। যাত্রীরা লাইন দিয়ে টিকিট কেটে বাসে উঠছেন। সুপারভাইজার শুক্কুর আলী বললেন, আগে এটি সিটিং সার্ভিস ছিল। ভাড়া ছিল ৫৫ টাকা। এখন লোকাল, ৪০ টাকা ভাড়া। ছাত্ররা উঠলে অর্ধেক ভাড়া দেয়, অনেকে দেয়ও না। ভাড়া নিয়ে কিছু বলতে গেলে নাকি ছাত্ররা গাড়ি আটকে দেয়, ভাঙচুর করে। বললেন, আয় কমে গেছে বলে তাঁদের সব বাস চলছে না।
বাস-মিনিবাসের সংখ্যা কমে যাওয়ার একই কারণ বলেছেন ফাল্গুন পরিবহনের সুপারভাইজার মো. রাজ। তাঁদের বাস চলে উত্তরা-আজিমপুর পথে। আগে সিটিং সার্ভিসে ভাড়া ছিল ৫০ টাকা, চার জায়গায় থামত (ভাড়ার হার ছিল ১৫+১৫+১০+১০)। এখন লোকাল সার্ভিস চলছে, ভাড়া ৩৫ টাকা। বাসগুলো চালকেরা মালিকের কাছ থেকে দিন চুক্তিতে নিয়ে চালান। প্রতিবার যাওয়ার জন্য ৭০০ টাকা জমা দিতে হয়। জ্বালানি তেল লাগে প্রায় ৫০০ টাকার। বাসে আসন ৪০টি। সিটিং সার্ভিসে ভাড়া আসত ২ হাজার টাকা। এখন ভাড়া উঠছে ১ হাজার ৪০০ টাকা। কাজেই চালকদের পোষাচ্ছে না। তাঁরা বাস নিচ্ছেন না। ফাল্গুন পরিবহনের ৩৫টি বাস, এর মধ্যে গতকাল সাতটি বাস পথে নেমেছে বলে সুপারভাইজার বললেন।
এদিকে জাবালে নূর পরিবহনের বাসে সিটিং বাসের ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ভাড়ার তালিকা চেয়েছিলেন একাত্তর টেলিভিশনের প্রযোজক আতিক রহমান। এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে ঘুষি মেরে আতিকের নাক ফাটিয়ে দেন বাসকর্মীরা। আতিককে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
একাত্তর টিভির জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক পারভেজ নাদির রেজা বলেন, এ বিষয়ে মিরপুর থানায় অভিযোগ করা হয়েছে।
আসাদগেটে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত নিউ ভিশন পরিবহনের একটি বাসকে বিভিন্ন অভিযোগে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। বাসটির যাত্রী দৈনিক সমকাল–এর প্রতিবেদক ইন্দ্রজিৎ সরকার বলেন, তিনি মিরপুর যাওয়ার জন্য ফার্মগেট থেকে উঠেছিলেন। মাঝপথে নেমে যেতে হওয়ায় তিনি ভাড়া ফেরত চাইলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনেই তাঁকে মারধর করেন কয়েকজন পরিবহনমালিক ও শ্রমিকনেতা।
বাস-মিনিবাসের স্বল্পতা ও নৈরাজ্যের বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাত্রীদের সুবিধার্থে লোকাল সার্ভিস চালু করা হয়েছে। সিটিংয়ের কারণে মাঝপথের অনেক যাত্রী বাসে উঠতে পারতেন না। এখন বাসগুলো আসনের বেশি যাত্রী নিতে পারছে। কাজেই জনপ্রতি ভাড়া কমলেও লোকসানের কারণ নেই। অনেকের কাগজপত্র হালনাগাদ করা নেই বলে তাঁরা বাস নামাচ্ছেন না। আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতকে সহায়তা দিচ্ছি। অনেক মালিক সিটিং বজায় রেখেছেন। এই বিশৃঙ্খলা সাময়িক। খুব শিগগির এর সমাধান হয়ে যাবে।’
এদিকে বিআরটিএ গতকাল পাঁচটি স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। এসব ভ্রাম্যমাণ আদালত ১১৯টি মামলা করেন। ৩ লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা ও দুজন চালককে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1148961/