১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ১১:৫২

টানা ৪২ দিন স্বাস্থ্যকর বাতাস নেই ঢাকায়

কখনো অস্বাস্থ্যকর, কখনো খুবই অস্বাস্থ্যকর, আবার কখনো বিপজ্জনক। বাতাসের মানের তালিকায় টানা দেড় মাস এই তিন ক্যাটাগরিতেই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজধানী ঢাকা। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৩১ দিনের ১০ দিনই বাতাসের মান বিপজ্জনক পর্যায়ে ছিল। অন্যদিকে বাকি ২১ দিন ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর কিংবা অস্বাস্থ্যকর। শুধু তাই নয়, পদক্ষেপ নেয়া হলেও চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের গেল ১১ দিনেও বায়ুমানে তেমন উন্নতি নেই। সুইজারল্যান্ডের বায়ুদূষণ পরিমাপক সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) তথ্য অনুযায়ী গতকালও ঢাকার বায়ু ছিল বিপজ্জনক। এদিন সকালে ঢাকার বায়ুমান সূচক ৪৪৫ পর্যন্ত উঠে যায়।

বায়ুমান সূচক এত তীব্রমাত্রায় পৌঁছালে যথাসম্ভব সবাইকে ঘরে রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করার সুপারিশ করে থাকেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। দেশের পরিবেশবিদরাও বলছেন, ঢাকার বায়ুদূষণের এই পরিস্থিতিতে এখনই জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয় নিয়ে চরম উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।

একিউ এয়ারের তথ্য বলছে, গত ৫ই জানুয়ারি ঢাকার বায়ুমান ১৫৭ একিউ এয়ারের সূচকে পৌঁছালেও ১৮ থেকে ২৩শে জানুয়ারি পর্যন্ত টানা ৬ দিন এই মান ছিল ২০০’র কাছাকাছি।

এরপর ২৪শে জানুয়ারি ঢাকার একিউআই কিছুটা কমে আসে। তারপরও এই বায়ুমান ১৭০-এর নিচে নামেনি। পরবর্তীতে ২৬শে জানুয়ারি সর্বোচ্চ ৩১৩-তে পৌঁছায়। ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত বায়ুর মান খারাপ হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তর পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে। তাতেও নির্মল বায়ু পায়নি ঢাকাবাসী। পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বায়ুর মান ১৭০-এর উপরে ছিল। গতকাল সকালে তা বেড়ে ৪৪৫ পর্যন্ত উঠে যায়।

উল্লেখ্য, বায়ুমানের ক্ষেত্রে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক তথা একিউআই’র মান ৫০ পর্যন্ত হলে তাকে স্বাস্থ্যকর বায়ু বলা হয়। ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত থাকলে তা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের ধরা হয় যদিও ব্যক্তিবিশেষে তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত মাত্রাকে বলা হয় অরেঞ্জ লেভেল যা সাধারণ মানুষের জন্য খুব একটা ক্ষতিকর না হলেও কারও কারও স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। ১৫০ থেকে ২০০ পর্যন্ত থাকলে তা অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর এই মান ২০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত চরম অস্বাস্থ্যকর। আর একিউআই ৩০০-এর বেশি হলে সেটিকে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

বায়ুদূষণ রোধে সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট না জানিয়ে জলবায়ু অভিযোজন ও অর্থায়ন বিশ্লেষক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ’র প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান মানবজমিনকে বলেন, বায়ুদূষণ রোধে কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় এটা নেই। ঢাকা শহরে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সেন্টারের প্রয়োজন। সেটাও করা হচ্ছে না।

তিনি বলেন, বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হলো যানবাহন। এটাকে ফেজ আউট করা হচ্ছে না। সরকারকে এখনই ঘোষণা দিতে হবে যে, ২০২৫ সালের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কোনো গাড়ির অনুমতি দেয়া হবে না। ২০২৫ সাল থেকে সবাইকে ইলেকট্রিক বা সৌরচালিত যানবাহন চালাতে হবে। তিনি বলেন, রাতে বায়ুদূষণের আরেকটি উৎস হলো নির্মাণকাজ। নির্মাণকাজের মাধ্যমে বায়ুদূষণ রোধের জন্য সারা বিশ্বে প্লাস্টিকের একটি পরিবেষ্টন দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা করা হয় না। এটা বাধ্যতামূলক করতে হবে। আরেকটি উৎস হলো- ইটের ভাটা। ঢাকার চারপাশে অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। যেগুলো থেকে বায়ুদূষণ হচ্ছে। কিন্তু এগুলো বন্ধ করা হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, ঢাকায় ব্যাপক হারে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া ফুসফুসের ক্যান্সার বাড়ছে। কর্তৃপক্ষ যদি এগুলো হিসাব করতো, তাহলে বায়ুদূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতো। স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে। একটা অস্বাস্থ্যবান জাতি নিয়ে কি আপনি স্মার্ট বাংলাদেশ করতে পারবেন? অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পারবেন? এগুলো তাদের মাথায় কাজ করছে না। তারা মনে করছে কতোগুলো অবকাঠামো বানালেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে। মানবসম্পদকে অসুস্থ রেখে, তাদের কর্মদিবস নষ্ট করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব হবে না।

এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ঢাকার রাস্তা ও গাছে প্রতিদিন পানি ছিটানো হচ্ছে। এ ছাড়া মেয়র মহোদয় ও আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন হতে বলছি। এখানে দায়-দায়িত্ব শুধু আমাদের না। নির্মাণকাজ ও ইটভাটার কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর হলো প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। এখানে তাদেরও কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, অনেক দেশে বায়ুমানের সূচক বিপজ্জনক হলে বাসায় অবস্থান করতে বলা হয়। কিন্তু ঢাকা শহরে এটা করা সম্ভব না।

আরেক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ বলেন, বায়ুদূষণ রোধ করতে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করছি, ঠিক হয়ে যাবে। কুয়াশার কারণে দূষণটা বেশি হচ্ছে। কুয়াশা কমে গেলে বায়ুর মান উন্নত হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=42595