৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার, ৪:০৩

ভুলে ভরা সরকারি অফিসের চিঠিপত্র

সরকারি অফিসে নথির নোটশিট ও চিঠিপত্রে প্রায় সময় বাংলা বানানে অনেক ভুল ধরা পড়ে। এমনকি সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিবদের কাছে উপস্থাপন করা নোটেও থাকছে ভুল। আবার গণমাধ্যমে পাঠানো দায়িত্বশীল সচিবের চিঠিতেও অসংখ্য বানান ভুলের প্রমাণ মিলেছে।

দাপ্তরিক কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের সরকারি নির্দেশনা না মানায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চরম উদাসীনতা এবং সঠিক চর্চা না থাকয় এ ধরনের ভুল অব্যাহত আছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষে (বাবাকো) কর্মরত সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, জবাবদিহি ও তদারকি না থাকায় এমনটি হচ্ছে।

এদিকে ভুল বাংলা বানান সংশোধনে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

দাপ্তরিক কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত করতে ২০১২ সালে সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগ সৃষ্টি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ অনুবিভাগে যুক্ত করা হয় বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ। অবশ্য এ কোষটি আগে থেকে চালু ছিল। তবে বাবাকোতে ভাষাবিশেষজ্ঞের বড়ই অভাব। প্রশাসন ক্যাডারের তত্ত্বাবধানে কোষ পরিচালিত হলেও বাস্তবে তারা ভাষা প্রমিতীকরণে কোনো কাজ করেন না। মূলত প্রশাসনিক বিষয়গুলো দেখভাল করে থাকেন। প্রধান কাজটি করেন ভাষাবিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে বাবাকোতে চারজন ভাষাবিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। এর মধ্যে দুজন সহযোগী অধ্যাপক এবং দুজন সহকারী অধ্যাপক। এ চারজনের মধ্যে তিনজন করেন বাংলা ভাষা প্রমিতীকরণের কাজ। অবশিষ্ট একজন করছেন ইংরেজি ভাষা প্রমিতীকরণের কাজ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এসব বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের প্রেষণে আনা হয়েছে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ কোষের জন্য আলাদা কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাজেট থেকে এটি পরিচালিত হয়। এ যাবতীয় প্রকাশনা বিজি প্রেস থেকে ছাপানো হয়।
অর্থাভাবের কারণে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজই করতে পারছে না বাবাকো। বিশেষ বরাদ্দ থাকলে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে অনেক কাজ করা যেত বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সূত্রগুলো বলছে, দেশে অনেক যোগ্য ভাষাবিশেষজ্ঞ কর্মহীন অবসর কাটাচ্ছেন। তাদের দিয়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে অনেক বড় বড় কাজ করানো সম্ভব। হয়তো একসময় অনেক অর্থকড়ি খরচ করা হবে। কিন্তু তখন এই মানুষগুলো আর পাওয়া যাবে না।

বাবাকোর শুরুর দিকে জনবল ছিল ২৩ জন। বর্তমানে কর্মরত মাত্র ১২ জন। এর মধ্যে অধিকাংশ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। কাজের জায়গায় লোক না থাকায় তাড়াহুড়া করতে গিয়ে অনেক সময় ভুলভ্রান্তি থেকে যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, এখনো আনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন, বিধি, নীতিমালা প্রমিতীকরণের কাজ শেষ হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাখা পর্যায়ে নোট দেওয়ার কথা শাখা প্রধানের। অথচ নোট দিচ্ছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও)। এমনকি অনেক সময় কম্পিউটার অপারেটরও নোট দিয়ে থাকেন। এ কারণে ভুলভ্রান্তি বেশি হচ্ছে। ভুল নোট সংশোধন না করেই অনেক সময় ওপরের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে চিঠিপত্রও জারি করা হয়। ভাষাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলা বানান ভুল সংশোধনের জন্য লাগাতার প্রশিক্ষণ এবং প্রমিত বাংলা অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করা হলে এসব সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে। এছাড়া প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এবং অধীনস্থ দপ্তর-সংস্থায় একটি করে ভাষাবিশেষজ্ঞের পদ সৃষ্টি করে নিয়মিত অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাবাকোর পোস্টিংয়ে ক্যাডার কর্মকর্তারা অসন্তুষ্ট থাকেন। কারণ, সেখানে শুধু একাডেমিক কাজ করতে হয়। এ কোষে কাজ করে বাড়তি কিছুই পাওয়ার সুযোগ নেই। শুধুই খাটাখাটনি। এছাড়া প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের অনেকের মধ্যে কর্তৃত্বপরায়ণ মানসিকতার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বাবাকোতে এ ধরনের হম্বিতম্বি করার সুযোগও কম। ফলে বাবাকোর পোস্টিংকে অনেকে ডাম্পিং মনে করেন।

সচিবালয়ে একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, কর্মকর্তাদের কক্ষে বুকসেলফে বাংলা একাডেমির বাংলা ও ইংরেজি অভিধান শোভা পাচ্ছে। বইগুলো এতই নতুন দেখায় যে, মনে হবে কেনার পর একবারের জন্য খুলে দেখা হয়নি। শাখা পর্যায়ে এও এবং কম্পিউটার অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবাকো কী, তারা তা বলতেই পারছে না। বাবাকোর গাইডলাইনও নেই অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। তবে বাংলা একাডেমির অভিধান আছে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। প্রশাসন ক্যাডারের হাজার হাজার অফিসার। তাদের অনেকেই নানান বিষয়ে বইপুস্তকও লিখেছেন। তবে বানানরীতি, প্রমিত বাংলা বানান বিষয়ে মাত্র একজন কর্মকর্তার একটি বইয়ের সন্ধান মিলেছে। বইয়ের নাম ‘ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানানসমগ্র’। লিখেছেন ড. মোহাম্মদ আমীন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি উইংপ্রধান ভালো বলতে পারবেন।’ তিনি সেখানে কথা বলার পরামর্শ দেন।

এ উইংয়ের প্রধান অতিরিক্ত সচিব আমেনা বেগম। তার অফিসরুম সংস্কারের কাজ চলছে। এ কারণে তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

বাবাকোর সাবেক অতিরিক্ত সচিব আলম আরা যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর উদাসীনতাই এ ধরনের ভুলভ্রান্তির জন্য দায়ী। এ অবস্থায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ, শিক্ষা বোর্ড, অধিদপ্তর, দপ্তর ও পরিদপ্তরে একটি করে বাংলা ভাষা মুখপাত্রের পদ সৃষ্টি করা সময়ের দাবি।

আলম আরা বলেন, ‘বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা দিয়েই আমাদের শিক্ষাজীবনের শুরু এবং শেষ হয়। কর্মজীবনে এসেও এর প্রভাব পড়ে। অধিকাংশ শিক্ষক বাংলা বানানরীতি জানেন না। ছাত্ররা শিখবে কোথা থেকে। অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের বাংলা শেখাতে চান না। তারা ইংরেজির পেছনে ছুটছেন।’

বাবাকোর সাবেক কর্মকর্তা হেলালউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সরকারি অফিসের পত্রাদিতে ভুলভ্রান্তির কারণ হচ্ছে দায়াবদ্ধতা ও জবাবদিহির বড় অভাব। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় প্রমিত বাংলা বানান লেখা হচ্ছে কি না, তা তদারকির লোকও নেই।

সূত্র জানায়, হাজার সমস্যার মধ্যেও বাবাকো ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩৭৩টি আইন, বিধি এবং নীতিমালা প্রমিতীকরণ করেছে। গত বছর জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে ৪৭টি আইন, বিধি এবং নীতিমালা প্রমিতীকরণ করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে শুধু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ৭টি আইন, বিধি ও নীতিমালা প্রমিতীকরণ করা হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রশাসনিক পরিভাষা ও সরকারি কাজে ব্যবহারিক (ব্যাবহারিক) বাংলা, ২০১৭ সালে সরকারি কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের নিয়ম এবং ২০১৯ সালে পদবির পরিভাষা প্রণয়ন করে তা অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছে বাবাকো।

বাবাকোর কাজ হচ্ছে জনপ্রশাসনসহ মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো থেকে জারি করা আইন, অধ্যাদেশ, বিধি এবং ইংরেজি ফর্মের বঙ্গানুবাদ ও প্রমিতীকরণ। সরকারি ফর্ম, প্রজ্ঞাপন, ডিও প্যাড প্রকাশনা ও অন্যান্য কাগজপত্র ইংরেজিতে মুদ্রণের ছাড়পত্র দেওয়া। দাপ্তরিক কাজে বাংলা ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া। অ্যাপ ও ফেসবুক এবং টেলিফোনে সেবা দেওয়া। প্রমিত বাংলা ব্যবহারে উৎসাহিত করতে পুস্তক প্রণয়ন, প্রকাশ ও বিতরণ।

বাংলা ভাষা কোষের চলমান কাজগুলোর মধ্যে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো থেকে আসা আইন, বিধি ও নীতিমালা প্রমিতীকরণ। সরকারি কাজে ব্যাবহারিক বাংলা নামে একটি বই আগামী জুনে প্রকাশ করা হবে। এছাড়া এ কোষ থেকে ইতঃপূর্বে প্রকাশিত ‘প্রশাসনিক পরিভাষা’-এ পরবর্তী সংস্করণও জুনে প্রকাশিত হবে বলে জানা গেছে। এ কোষের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মচারীদের শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারে দেশব্যাপী মোটিভেশন ও দাপ্তরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া, শুদ্ধ বানানে মানসম্মত বই প্রকাশ করা এবং বৃহত্তর পরিসরে বাংলা প্রশাসনিক পরিভাষা প্রকাশ করা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/642804