৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার, ৩:৪৮

আইএমএফ’র ঋণ

-এম এ খালেক

ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এর পরিচালনা পর্ষেেদর ৩০ জানুয়ারি সভায় বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের জন্য আবেদন করলেও সংস্থাটি শেষ পর্যন্ত ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ প্রাপ্তির ব্যাপারে আর কোনো অনিশ্চয়তা রইল না। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গত বছর ২৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে আইএমএফ’র নিকট ঋণের জন্য আবেদন জানানো হয়। প্রাথমিক আবেদনে বাংলাদেশ প্রত্যাশিত ঋণের কোনো অঙ্ক উল্লেখ করেনি। পরবর্তীতে ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ’র বার্ষিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকালে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের কথা বলেন। ইতিমধ্যেই অনুমোদিত ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ করা হয়েছে। আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিতে যাচ্ছে। ২০ কোটি মার্কিন ডলার বাড়তি ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে আইএমএফ ঋণ দেয়া এসডিআরের (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) বিপরীতে। সাম্প্রতিক সময়ে এসডিআরের বিপরীতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার কমে যাওয়ায় অনুমোদিত ঋণের পরিমাণ ২০ কোটি মার্কিন ডলার বেড়েছে। ইতিমধ্যেই অনুমোদিত ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ করা হয়েছে। মোট ৭ কিস্তিতে ৪২ মাসে এই ঋণ বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড় করা হবে। অনুমোদিত ঋণের সুদ হার হবে বার্ষিক ২ দশমিক ২ শতাংশ।

আইএমএফ’র এই ঋণ নিয়ে স্থানীয়ভাবে যে বিতর্ক এবং আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে অতীতে আর কোনো ঋণ নিয়ে তেমনটি হয়নি। আইএমএফ’র প্রস্তাবিত ঋণ নিয়ে দেশের অর্থনীতিবিদগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়। এক শ্রেণির অর্থনীতিবিদ নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, সরকার হাজার চেষ্টা করলেও আইএমএফ’র নিকট থেকে আবেদিত ঋণ পাবে না। এমনকি প্রাথমিকভাবে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদিত হলেও শেষ পর্যন্ত ঋণ অধরাই থেকে যাবে। কারণ সংস্থাটির দেয়া শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হলে মাঝ পথে ঋণ ছাড়করণ বন্ধ করে দেয়া হতে পারে। ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় পাবার জন্য বাংলাদেশকে কোনো শর্ত পরিপালন করতে হবে না। এ প্রসঙ্গে অনেক দিন আগে শোনা একটি গল্পের কথা মনে পড়লো। গ্রামের এক দরিদ্র কৃষকের সন্তান স্কুলে ভর্তি হলে সেই গ্রামের বিত্তবান ব্যক্তিটি মন্তব্যে করেন, ওমুকের ছেলে স্কুলে ভর্তি হলেও পাশ করতে পারবে না। ছেলেটি যখন উচ্চ শিক্ষিত হলো তখন সেই ব্যক্তি মন্তব্য করেন, শিক্ষা লাভ করলেও কোনো কিছু হবে না। কারণ চাকরি পাবে না। চাকরি পাওয়ার পর মন্তব্য করেন, চাকরি পেলেও বেতন পাবে না। কিন্তু এক সময় ছেলেটি চাকরিতে বেতন পেতে শুরু করলে লোকটি আবারো মন্তব্য করেন, চাকরি পেলেও বেশি দিন টিকবে না। পরে দেখা গেলো ছেলেটি চাকরিতে বেশ ভালোভাবেই টিকে গেছে। আইএমএফ’র ঋণ নিয়ে এক শ্রেণির অর্থনীতিবিদের আচরণ ঠিক একই রকম। বর্তমানে এটা বাস্তবতা যে, বাংলাদেশ আইএমএফ’র নিকট থেকে প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ অনুমোদন পেয়েছে। ইতিমধ্যে ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ করা হয়েছে। এখানে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন তাহলো, আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন কিছু নয়।

কারণ সংস্থাটি বিভিন্ন দেশকে ঋণদানের জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কোনো মর্যাদাবান দেশই আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতে চায় না। কারণ এই ঋণ নিতে হলে কঠিন শর্ত পরিপালন করতে হয়। এসব শর্তের কোনো কোনোটি জাতীয় স্বার্থ এবং সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি। কাজেই কোনো দেশই একান্ত বিপদে না পড়লে আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী হয় না। যেসব দেশের কোনো উপায় থাকে না শুধু তারাই আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করে। আর এক শ্রেণির শাসক আছেন যারা ঋণের অর্থে নিজেদের পকেট ভারি করতে চায় তারাই ঋণ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ একান্ত অসুবিধায় না পড়লে আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতো না। কেউ সাধে আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতে যায় না। কাজেই আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। বাংলাদেশ যদি অসুবিধায় না পড়তো তাহলে আইএমএফ’র নিকট থেকে কোনো কারণেই ঋণ গ্রহণ করতো না। যারা বলছিলেন, বাংলাদেশ আইএমএফ নিকট থেকে ঋণ পাবে না। এমনকি অনুমোদিত হবার পরও এই ঋণ না পাবার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের কথা মোটেও ঠিক নয়। কারণ আইএমএফ এমন একটি সংস্থা যারা পুঁজিবাদি দেশের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সদা তৎপর। তারা ঋণ গ্রহীতা দেশের স্বার্থ কখনোই দেখে না। একটি দেশ যদি সত্যিকারার্থে মর্যাদাবান দেশ হয় এবং একান্ত বিপাকে পতিত না হয় তাহলে কোনো আইএমএফ’র কঠিন শর্ত মানতে যাবে? আমরা ঋণ গ্রহণ করবো। ঋণের কিস্তি সুদ সমেত পরিশোধ করবো। তাহলে ঋণদাতার শর্ত মানতে হবে কেনো? কিন্তু আইএমএফ’র ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে এ ধরনের যুক্তি চলে না। তারা ঋণ দেয় একটি দেশকে তাদের শর্তের বেড়াজালে আটকে ফেলার জন্যই। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, আমরা যেভাবে চেয়েছি আইএমএফ ঠিক সেভাবেই ঋণ দিচ্ছে। সত্যি কি তাই? যদি অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক হয় তাহলে আইএমএফ এতগুলো শর্ত দিচ্ছে কেনো? আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে তার বেশির ভাগই আমাদের দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। কিন্তু অধিকাংশ শর্তই সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে। অর্থমন্ত্রী আর্থিক খাতে যে সব পরিবর্তন সাধন করেছেন তা আইএমএফ’র শর্ত মানতে হলে তার অধিকাংশই বাতিল করতে হবে। মোটা দাগে আইএমএফ বাংলাদেশকে ৩৮টি শর্ত দিয়েছে। এসব শর্ত মানা বাংলাদেশ সরকারের জন্য বেশ কঠিন হবে। যদিও স্থানীয় অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন এসব শর্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বার্থেই পরিপালন করা প্রয়োজন। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম শামসুল ইসলাম অবশ্য এগুলোকে শর্ত বলতে চাইছেন না। তিনি বলছেন, আইএমএফ’র পরামর্শ। আইএমএফ’র শর্ত মানতে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে অধিকাংশ পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। যার জের বহন করতে হবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে।

আইএমএফ’র ঋণের প্রথম কিস্তি পাবার জন্য সরকারকে কোনো শর্ত মানতে হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়করণের আগে আইএমএফ তাদের আরোপিত শর্ত কতটা পালিত হয়েছে বা সরকার শর্ত পালনে কতটা আন্তরিক তা বিবেচনা করা হবে। আবার সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ যেভাবে ঋণ চেয়েছে আইএমএফ ঠিক সেভাবেই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। তাহলে কি সরকার বিভিন্ন শর্ত সহযোগেই আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ চেয়েছিল? আসলে কোনো পক্ষের বক্তব্যই পুরোপুরি সত্যি নয়। আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে। কাজেই বাংলাদেশ যেভাবে ঋণ চেয়েছে ঠিক সেভাবেই ঋণ পেয়েছে এটাও ঠিক নয়। আইএমএফ’র ঋণ সব সময়ই শর্তযুক্ত থাকে। তবে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশের জন্য তারা এক রকম শর্ত দেয়। আবার শক্তিশালি অর্থনীতি সম্বলিত দেশের ক্ষেত্রে তাদের দেয়া শর্ত থাকে তুলনামূলক নমনীয়। আইএমএফ কোনো দেশকে শর্তহীন বা শর্তমুক্ত ঋণ দিয়েছে এমন নজীর নেই বললেই চলে। আর কোনো দেশ একান্ত সঙ্কটে পতিত না হলে আইএমএফ থেকে সাধারণত ঋণ গ্রহণ করে না। আত্মমর্যাদাবান এবং নিজস্ব আর্থিক শক্তিতে চলতে পারে এমন কোনো দেশ আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করে না। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১২ বার আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে। নিকট অতীতে বাংলাদেশ আইএমএফ’র নিকট থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি। ফলে আইএমএফ বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা ধরনের সংস্কার প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশ তাতে কর্ণপাত করেনি।

আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ঋণ দিতে যাচ্ছে তা কোনোভাবেই শর্তহীন নয়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ প্রাপ্তির জন্য কি কি শর্ত পালনে সম্মত হয়েছে তা এখনো পরিষ্কার নয়। কারণ বাংলাদেশ সরকার এবং আইএমএফ কোনো পক্ষই ঋণের শর্ত প্রকাশ করেনি। ঋণের শর্ত জানার জন্য আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে যেটুকু অনুমান করা যায় তাহলে মনে হচ্ছে, আর্থিক খাত সংস্কার, বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনার জন্য তাগিদ দেয়া হবে। ব্যাংকিং সেক্টরে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইনি সংস্কার করা হয়েছে তার মাধ্যমে এই খাতের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেকেই মনে করছেন, ব্যাংকিং সেক্টরের আগের আইনগুলো ছিল আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু সংস্কারের নামে সেগুলোকে ঋণ খেলাপি বান্ধব আইনে পরিণত করা হয়েছে। এসব আইন পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা না হলে আগামীতে ব্যাংকিং সেক্টর ধসে পড়তে পারে।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিয়ে থাকে তা কমিয়ে আনার জন্য শর্ত দেয়া হতে পারে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া হয় তা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হতে পারে। সরকার বিষয়টি অনুধাবন করেই বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে চলেছে। মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে ভর্তুকি কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে স্থানীয় বাজারেও জ্বালানি তেলের একাধিক বার বাড়নো হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সময় বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেলে স্থানীয় বাজারেও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ৬ মাসের মাথায় আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। বর্তমান তা ৮০ মার্কিন ডলারের নিচে নেমে এসেছে, যা যুদ্ধ শুরু কালীন সময়ের আগের অবস্থার সমতুল্য। কিন্তু স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য এখনো কমানো হয়নি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের মতো ইউটিলিটি সেবাসমূহের মূল্য বৃদ্ধির আগে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিআইআরসি) গণশুনানির আয়োজন করতো। এতে সংশ্লিষ্ট সেবাসমূহের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ভারসাম্য রক্ষা হতো। এখন সরকার সেই ক্ষমতা নিজ হাতে নিয়েছে। ফলে সরাকার ইচ্ছা করলেই জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সেবামূলক সামগ্রির মূল্য বাড়াতে পারবে। সরকার যদি নিজ বিবেচনায় এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করেন তাহলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিআইআরসি) নামক সংস্থাটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কি প্রয়োজন আছে?

আইএমএফ’র শর্ত মোতাবেক, বাংলাদেশ ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রস এবং নিট পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাবায়ন করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলকে দেয়া ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ অন্যান্য ফান্ডে বিনিয়োগ করা মোট ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারকে রিজার্ভে যোগ করে দেখানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মালিকানাধীনে হলেও যে অর্থের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেই এবং চাইলেই তা ব্যয় করা যাবে না তাকে রিজার্ভ অর্থ হিসেবে দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে যে অর্থ বিভিন্ন ফান্ডে বিনিয়োগ করেছে তা রিজার্ভ হিসাবায়ন থেকে বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, হঠাৎ করেই আমাদের আইএমএফ’র কঠিন শর্তের ঋণ গ্রহণের আবশ্যকতা কেনো দেখা দিলো? এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূচকের অবস্থান দেখে নেয়া যেতে পারে। ব্যাংকিং সেক্টরের ঋণ খেলাপিদের জন্য বিস্তর সুবিধা দেবার পরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। গত কোয়ার্টারের হিসাব মোতাবেক, ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক টাকাও বাড়বে না। তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার কোটি টাকার মতো। অর্থমন্ত্রী অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেননি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ছাড়কৃত ঋণের ২৩ শতাংশ।

আইএমএফ চায় বাংলাদেশ এই হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনুক। রাজস্ব আদায়ের হার এখন জিডিপি’র ১০ দশমিক ৯শতাংশ। অথচ নেপালে কর-জিডিপি হার ২৪ দশমিক ২ শতাংশ,ভারতে ২০ শতাংশ, মিয়ানমারে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এক বছরে রেমিটেন্স আয় কমেছে ৭৯ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে রেমিটেন্স এসেছিল ২ হাজার ২০৭ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২২ সালে এসেছে ২ হাজার ১২৯ কোটি মার্কিন ডলার। সাম্প্রতিক সময়ে দেশ থেকে অর্থপাচার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রদর্শিত পরিমাণ হচ্ছে ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ব্যবহারযোগ্যতার ভিত্তিতে হিসাব করলে রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আইএমএফ’র ঋণ গ্রহণের পেছনে রিজার্ভ বাড়ানো থেকে শুরু করে আরো অনেক উদ্দেশ্য সাধনের ইচ্ছে সরকারের রয়েছে। কিন্তু আইএমএফ’র ঋণ দিয়ে সেই উদ্দেশ্য কতটা সাধিত হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই ঋণ একবারে ছাড়করণ করা হবে না। তবে এই ঋণের অন্য একটি ‘মাহাত্ম্য’ আছে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেছেন, ‘আইএমএফ’র ঋণ হচ্ছে চরিত্রগত সার্টিফিকেটের মতো।’ তার এই কথা অত্যন্ত মূল্যবান। কারণ আইএমএফ যে দেশকে ঋণ দান করে আন্তর্জাতিক অন্যান্য ঋণদানকারী সংস্থা সেই দেশকে ঋণ দেবার ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা করে না। সেটাই বা কম কিসের?

https://dailysangram.com/post/516004