৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ৭:০৭

কর্মঘণ্টা না মানায় ঘটছে দুর্ঘটনা

প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় চালক ও পরিবহন শ্রমিকের মৃত্যু বাড়ছে। তিন বছরের ব্যবধানে সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবহন চালক ও শ্রমিকের মৃত্যু প্রায় এক হাজার বেড়েছে। নিহত চালকদের মধ্যে মোটরসাইকেলচালকের সংখ্যা বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত চালকের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। চালকের গাড়ি চালনা নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার মধ্যে সীমিত রাখা হচ্ছে না। আইন থাকলেও এর কোনো বাস্তবায়ন নেই। এতে দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না।

নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন দুই হাজার ১৮৮ জন চালক ও সহকারী। আগের বছর ২০২১ সালে মারা গেছেন এক হাজার ৮৬৬ জন। ২০২০ সালে এক হাজার ২৬৬ জন এবং ২০১৯ সালে এক হাজার ১৯০ জন মারা গেছেন। দেখা যাচ্ছে, এই চার বছরে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়েছে।

চালকের নেই কর্মঘণ্টা : সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পরিবহন শ্রমিকের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করতে বলেছে। আইনের ৩৯ (১) ধারায় উল্লেখ আছে, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (২০০৬ সালের ৪২ নং আইন)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবহন যানের চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার-কাম-ক্লিনারদের কর্মঘণ্টা ও বিরতিকাল নির্ধারণ করতে পারবে। সেই সঙ্গে ৩৯ (২) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অথবা পরিবহন যানের চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার-কাম-ক্লিনার উপ-ধারা (১)-এর অধীন নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও বিরতিকাল মেনে চলবে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, চালকের কাঁধে বহু মানুষের প্রাণ থাকে। গোটা বিশ্বেই চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি চালককে টানা গাড়ি চালাতে দেওয়া হয় না। এটাই বিজ্ঞান। একজন চালকের একটানা গাড়ি চালানোর আন্তর্জাতিক অনুমোদন নেই। এটি সংশ্লিষ্টরা মনিটর করবে। চালকের পাঁচ ঘণ্টার বেশি টানা গাড়ি চালানো যাবে না—এটি গবেষণায় প্রমাণিত। এটা না মানায় অনেক বেশি দুর্ঘটনা বাড়ছে।

আইনে কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও মেনে চলার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা নেই। শ্রম আইনের ১০০ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে দৈনিক আট ঘণ্টার অধিক সময় কাজ করবে না বা তাঁকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। আবার শ্রম আইনের ১০১ (গ) ধারায় বলা হচ্ছে, এই আট ঘণ্টার মধ্যে দুবার কর্ম বিরতি দিতে হবে।

চালক ও সহকারীর মৃত্যু ২৭% : নিসচার প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত বছর পাঁচ হাজার ৭০টি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৭৬০ জন মারা গেছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুই হাজার ১৮৮ জন পরিবহন শ্রমিক, যা মোট মৃত্যুর ২৭ শতাংশ। এই দুই হাজার ১৮৮ জনের মধ্যে বাস, ট্রাক, পিকআপ, ট্রাক্টর/ট্রলি/ভ্যান, নছিমন/করিমনের চালক ও সহকারী মিলিয়ে মারা গেছেন ২৫৫ জন। মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী মারা গেছেন এক হাজার ৬১৮ জন। মোট মৃত্যুর ২০ শতাংশ মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী। এ ছাড়া অটোরিকশার চালক ১৫৯ জন ও সাইকেল আরোহী ১৫৬ জন মারা গেছে।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, পরিসংখ্যানের এমন তথ্য ভয়ংকর। দুর্ঘটনায় একজন চালকের সঙ্গে কতজন যাত্রী মারা যায়, সেটা একবার ভাবা দরকার। চালকের নিরাপত্তার কথা কেউ ভাবছে না।

নিরাপদ সড়ক চাইয়ের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রথমে আমাদের বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। দুর্ঘটনা ঘটছে, কেন ঘটছে, এটা আমরা জানি। সমাধানগুলোও চোখের সামনে আছে। কর্মঘণ্টা নির্ধারণসহ সব বিষয় মানলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।’

গাড়ি আছে ৫৬ লাখ, চালক ৪০ লাখের কম : গত ডিসেম্বর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৫৫ লাখ ৯২ হাজার ৫৯টি। এর মধ্যে বাস ৫২ হাজার ৪৬টি, ট্রাক এক লাখ ৪৮ হাজার ৫১৬টি, কাভার্ড ভ্যান ৪৫ হাজার ৩৯৭টি, মাইক্রোবাস এক লাখ ১৫ হাজার ৭৬৮টি, অটোরিকশা তিন লাখ ১৩ হাজার ১১৪টি, মোটরসাইকেল ৪০ লাখ সাত হাজার ৮১৭টি, মিনিবাস ২৭ হাজার ৯৪৭টি ও পিকআপ এক লাখ ৫৩ হাজার ৬৫৭টি।

এ ছাড়া ট্যাক্সি ক্যাব ৩৬ হাজার ১১১টি, ট্রাক্টর ৪৬ হাজার ৫১৫টি, ব্যক্তিগত কার তিন লাখ ৯৮ হাজার ৬৮৫টি, স্পেশাল পারপাস গাড়ি ১২ হাজার ৯৩টি, ট্যাংকার ছয় হাজার ৫৯২টি, জিপ ৮২ হাজার ৭৭৮টি, কার্গো ভ্যান ৯ হাজার ৫৪৩টি, অ্যাম্বুল্যান্স আট হাজার ১৬৩টি, অটো টেম্পো ১৬ হাজার ৪২টি, ডেলিভারি ভ্যান ৩৩ হাজার ২২৬টি, হিউম্যান হলার ১৭ হাজার ৩৭৮টি ও অন্যান্য ৬০ হাজার ৬৬১টি।

বিআরটিএর তথ্য মতে, সব ধরনের যানবাহন মিলিয়ে চালকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখের কাছাকাছি। মোট নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৫ লাখ ৯২ হাজার ৫৯টি। এ ক্ষেত্রে চালকের সংখ্যা ১৫ লাখ ৯২ হাজার জন কম রয়েছে।

নিরাপদ সড়ক চাইয়ের দাবি, সারা দেশে প্রায় ১৬ লাখ অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক পরিবহন খাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এক বছরের যান ও সংশ্লিষ্ট যানে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে বাসের সংখ্যা ৫২ হাজার ৪৬টি। এর মধ্যে এক হাজার ৮৯টি বাস দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এবং ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মিলে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে এক হাজার ৩৩৫টি।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের যানবাহনের তুলনায় চালকের সংকট রয়েছে। এ জন্য চালকদের কর্মঘণ্টা সঠিকভাবে মানা হয় না। তবে আমরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের সঙ্গে কথা বলছি। অনেক সময় চালকরাও নিয়ম মানছেন না।’



https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/02/06/1244120