৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ১২:০৭

ব্যাংক ব্যবস্থার সংকট দীর্ঘ দিনের অনিয়মের ফল

ব্যাংকের বর্তমান সংকটকে ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি অনিয়মের ফল বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজন। তাঁরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে না। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানটি এখন আর স্বায়ত্তশাসিত নয়। স্রেফ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বর্ধিত অংশে পরিণত হয়েছে। রাজধানীতে দু'দিনের ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের প্রথম দিন গতকাল শনিবার তাঁরা এসব মন্তব্য করেন।

ব্র্যাক সেন্টার ইনে এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। সম্মেলন উদ্বোধন করেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কেউ ঋণ নিল, কিন্তু পরিশোধ করল না। পুনঃতপশিল করা হলো। এর মানে, ঋণের পেছনে রাষ্ট্রের বড় অঙ্কের ভর্তুকি যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই।

অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সমালোচনা করে অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরও বলেন, করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ অর্থ সংকটের অভিঘাত থেকে সুরক্ষায় যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো স্বল্পমেয়াদি। বাজেট ঘাটতি, রিজার্ভ কমার বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বিনিয়োগে অগ্রাধিকারভিত্তিক নীতি নেওয়া এবং গণতান্ত্রিক সুশাসন ও জবাবদিহিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। তিনি মনে করেন, গণতান্ত্রিক সুশাসন ও জবাবদিহিতার মধ্যেই সামষ্টিক অর্থনীতিতে সুশাসনের বিষয়টি নিহিত রয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব আঘাত এসেছে, সেগুলোর কোনটিতে প্রাধান্য দেওয়া উচিত, তা খুঁজে বের করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করবে এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পরিম লে এসব আঘাতের প্রভাব কেমন হবে- এর ওপর জোর দিতে হবে।

অধিবেশনে ভারতের শীর্ষ ধনী আদানি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক সোবহান বলেন, যতটুকু মনে পড়ে, আদানির বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করার কথা ছিল। আর ভারতের আদানির খনি থেকে কয়লা আসার কথা ছিল বাংলাদেশে। পরে আদানি অস্ট্রেলিয়ায় কয়লাখনিতে বিনিয়োগ করে। তবে সেটা ভালো বিনিয়োগ ছিল না। কথা ছিল, সেই খনি থেকে কয়লা ভারতে আসবে। ভারত থেকে বাংলাদেশে আসবে। এখানে বাংলাদেশকে অস্ট্রেলিয়ার খনি থেকে উত্তোলিত কয়লার দাম দিতে হচ্ছে। পাশাপাশি সেই কয়লা বাংলাদেশে আসার যে খরচ, সেটাও ভারতকে দিতে হচ্ছে। এটা একটি অদ্ভুত চুক্তি। বাংলাদেশ ৪০০ ডলার করে আদানি থেকে কয়লা কেনার চুক্তি করেছে। অথচ এর চেয়ে অনেক কম দামে এখনই কয়লা কিনছে বাংলাদেশ।

প্রথম দিনের বিভিন্ন কর্ম অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বিভিন্ন অধিবেশন সঞ্চালনা করেন।

লিখিত প্রবন্ধে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রসঙ্গে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, রিজার্ভের পরিমাণ বড় কথা নয়, বরং দেখতে হবে রিজার্ভের প্রবণতা কোন দিকে যাচ্ছে। দেশের রিজার্ভ একসময় ৩ বিলিয়ন ডলারও ছিল। এখন ৩২ বিলিয়ন ডলারও উদ্বেগের। কারণ, গত এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ৮ বিলিয়ন ডলার। সে কারণে পরিমাণ অনেক সময় বড় সমস্যা নয়, প্রবণতাটাই আসল কথা। রিজার্ভের প্রবণতা নিচের দিকে নামতে থাকলে ঠেকানো কঠিন।

আইএমএফের ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংস্থাটির পরামর্শ অনুযায়ী ব্যাংকের সুদহারে সর্বোচ্চ সীমা তুলে দিলে সুদের হার বেড়ে যাবে। এতে সৎ উদ্যোক্তাদের পক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব হবে না। অসাধু ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ নেবে। তারা ঋণ নেবে তবে ফেরত দেওয়ার জন্য নেবে না। সুতরাং তাদের কাছে সুদের বেশি হার কোনো বিষয় নয়। খেলাপি ঋণ কমাতে আইএমএফের পরামর্শ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার কথা আইএমএফের তরফ থেকে বলা হয়েছে। একটা কাগজে সই করলেই কি খেলাপি ঋণ কমে যাবে? অনেক দশক ধরে দেখেছি, এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাপার। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, আসলে আইএমএফ জানে সরকারের পক্ষে এটা করা সহজ নয়। তার পরও খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত দেওয়ার মাধ্যমে আইএমএফের আমলাতন্ত্র খুশি, আমরাও খুশি। আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আঞ্চলিক বাণিজ্যের সুযোগ বেড়েছে। সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের আঞ্চলিক বাণিজ্যের সুযোগ রয়েছে। তবে প্রভাবশালী দেশের চাপে যাতে স্যান্ডউইচের মতো অবস্থা না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, অর্থনৈতিক এই সংকট থেকে বের হয়ে আসতে আইএমএফ থেকে নেওয়া ঋণ দেশের জন্য ইতিবাচক হিসেবে কাজ করবে। এর ফলে অন্য দাতা সংস্থারও আস্থা বাড়বে। আর্থিক খাতের সংস্কার প্রশ্নে আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত যৌক্তিক এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। আইএমএফের পরামর্শে আর্থিক খাতে ধারাবাহিক সংস্কার করা হচ্ছে। সরকার এসব প্রস্তাব ইতিবাচকভাবে নেওয়ার ফলে এখন অন্য দাতা সংস্থাগুলোও বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আহরণ কম। সঠিক মুদ্রানীতি নেই। বিনিময় হার অস্থিতিশীল। এসব সংকট থেকে পরিত্রাণে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা খুবই প্রয়োজন। তবে এত নেতিবাচক অবস্থার মধ্যে একটি ভালো দিক হচ্ছে- সরকার সময়মতো আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে এবং তা পেয়েও গেছে। বাকি কিস্তির অর্থ ছাড় হবে সংস্কারের পর। সুতরাং সে বিষয়গুলোর দিকে সতর্কতার সঙ্গে দৃষ্টি রাখতে হবে।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অর্থনৈতিক সমস্যায় শুধু দরিদ্র পরিবারগুলোই ভুগছে না। এখন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরাও ভুগছেন। ঘুরেফিরে ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনা, খেলাপি ঋণ আর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসনের অভাবের কথাই আসে। দেশের স্বার্থেই আইএমএফের ঋণের বিপরীতে দেওয়া শর্ত অনুযায়ী সংস্কার চালিয়ে নিতে হবে।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পোশাকের রপ্তানি ৪২ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ববাজারের মাত্র ৬ শতাংশ। সুতরাং রপ্তানি বাড়ানোর বড় সুযোগ রয়েছে। পোশাকের পাশাপাশি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার ওপর জোর দেন তিনি।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে বৈশ্বিক সমস্যাকে দায়ী করা হয়, এটা ঠিক নয়। দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণেই অর্থনীতি এমন অবস্থায় পড়েছে। এই সমস্যা স্বীকার করে উত্তরণের জন্য কাজ করতে হবে। অনেকদিন ধরেই বলা হচ্ছিল দুই মাসের মধ্যে ডলার সংকট কমে যাবে। কিন্তু সেই সময় আর শেষ হলো না। তবে আইএমএফের ঋণ, ডলার সংকট হয়তো কিছুটা কমাবে।

সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের ১৫০ অর্থনীতিবিদ অংশ নিচ্ছেন। দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ গবেষকদের মোট ৮০টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হচ্ছে বিভিন্ন কর্ম-অধিবেশনে। আজ রোববার সম্মেলন শেষ হবে।

 

https://samakal.com/economics/article/2302155077