৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ১২:০৪

অভিবাসন ব্যয় আকাশচুম্বী

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায়

জনশক্তি রফতানির অন্যতম দেশ মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চলছে ধীরগতি। দেশটিতে এ যাবৎ প্রায় ৫০ হাজার কর্মী গেছে। আরো ১ লক্ষ ৪ হাজার কর্মীর কলিং এসেছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ধীরগতির দরুণ ইতোমধ্যেই কয়েক লক্ষ বাংলাদেশি কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার সিøপ তুলতেই অযৌক্তিভাবে কর্মীদের ২৬শ’ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মেডিক্যাল সেন্টারগুলো। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীরা। কর্মী প্রেরণে ধীরগতির দরুণ মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। নেপাল থেকে লক্ষাধিক কর্মী মালয়েশিয়ায় চাকরি লাভ করেছে। দ্রুত কর্মী পাওয়ার সুবাদে অনেক নিয়োগকর্তা নেপাল থেকে কর্মী নিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করছে। একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

দেশটির নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশি কর্মীদের বেশি পছন্দ করেন। কারণ বাংলাদেশিরা কঠোর পরিশ্রমী এবং ওভারটাইম করতে বেশি আগ্রহী। মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় দিন দিন আকাশচুম্বী হচ্ছে। ফ্লাইট সঙ্কট এবং ওয়ানওয়ে টিকিটের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় ভিসাপ্রাপ্ত হাজার হাজার কর্মী দেশটিতে যাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। অভিবাসন ব্যয়ের টাকা যোগাতে বিদেশগামী কর্মীদের নাভিশ্বাস উঠছে। দেশটিতে প্রায় ৬ লাখ বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন।

নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং অভিবাসন ব্যয় কমানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও সেনা কল্যাণ ওভারসীজের মাধ্যমে দক্ষ সিকিউরিটি নেয়ার লক্ষ্যে গতকাল শনিবার মালয়েশিয়ার দাতুক সেরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইলের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় পৌঁছেন। সফররত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল আজ রোববার প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হবেন। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের মাধ্যমে দেশটিতে কর্মী প্রেরণ প্রক্রিয়া সহজীকরণসহ শুধু সিন্ডিকেট নয় সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে কর্মী প্রেরণের সুযোগ পাবেন বলে বায়রার অর্থসচিব মিজানুর রহমান আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন ৭৫টি এজেন্সির মাধ্যমে মাত্র সাড়ে ৩ হাজার কর্মী দেশটিতে গেছে। বাকি কর্মীরা ২৫ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গিয়েছে। ১ লক্ষ ৩ হাজার কলিং ভিসা বাংলাদেশে এসেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে মূল সমস্যা হচ্ছে ফ্লাইট সঙ্কট। ফ্লাইট স্বল্পতার দরুণ হাজার হাজার কর্মী যেতে পারছে না। আটাবের কালচারাল সেক্রেটারি মোহাম্মদ তোহা চৌধুরী গতকাল শনিবার ইনকিলাবকে বলেন, আগামী এক মাস পর্যন্ত মালয়েশিয়াগামী কোনো বিমানের টিকিট নেই। বিমান প্রতিদিন স্বল্প আসনের একটি ফ্লাইট ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে পরিচালিত করছে। বিমান ওয়ানওয়ে কর্মীর টিকিট ৬৩ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। ইউএস বাংলা ওয়ানওয়ে টিকিট বিক্রি করছে ৬৫ হাজার টাকায়। মালিন্দো এয়ার ওয়ানওয়ে টিকিট বিক্রি করছে ৬০ হাজার টাকায়। কিছু দিন আগেও ওয়ানওয়ে টিকিট বিক্রি হয়েছে ৩০ হাজার টাকা থেকে ৩৫ হাজার টাকায়।

আটাব নেতা ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে বিমানে অতিরিক্ত ফ্লাইট চালু করে কর্মী প্রেরণে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনের জোর দাবি জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মী জানান, কয়েক হাত বদল হয়ে সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে দেশটিতে যেতে জনপ্রতি গুনতে হচ্ছে কর্মীদের ৪ লাখ টাকা থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। সরকার দেশটিতে যেতে অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করেছিল ৭৯ হাজার ৯৯০টাকা। কর্মী প্রেরণের প্রক্রিয়া শুরুর প্রাক্কালেই সিন্ডিকেটের পকেটে অটো চলে যাচ্ছে ১ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা। এতে অভিবাসনের ব্যয়ের টাকা যোগাতে কর্মীদের চড়া সুদে ঋণ, জমিজমা বিক্রি এবং গবাদিপশু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারের নীতিমাল হচ্ছে অভিবাসন ব্যয় কমানো কিন্তু পদে পদে টাকা দিতে হওয়ায় হিমসিম খাচ্ছে বিদেশগামী পরিবারগুলো।
এ যাবৎ দেশটিতে কর্মী গেছে প্রায় ৭০ হাজার। আর স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া যাওয়ার আশায় দালাল চক্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে প্রায় ৬ লক্ষ কর্মীর। দেশটিতে কর্মী প্রেরণের জটিল প্রক্রিয়ার দরুণ কয়েক লক্ষ কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এফডব্লিউসিএমএস-এর মায়োগ্রাম বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার সিøপ উঠাতে জনপ্রতি ২৬শ’ টাকা করে নিয়ে গেছে। কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আরো সাড়ে ৮ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে। যা মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা থেকে আদায় করার কথা ছিল। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের প্রেক্ষিতে মালয়েশিয়া সরকার লেবার সোর্স কান্ট্রি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় অর্থাৎ কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা করবে, হঠাৎ করে শ্রম নিয়োগ বন্ধ করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ যেতে ঋণের জালে আবদ্ধ হওয়া, বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হওয়া বিষয়গুলো নিজেই তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফল দেখা যায় না। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সিন্ডিকেট নিয়ে বায়রার দু’টি মতবিনিময় সভায় তুমুল হট্টগোলের মধ্যদিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এ সভায় অনেক সাধারণ সদস্যরা দাবি তুলেছিলেন, বৈধ সকল রিক্রুটিং এজেন্সি যাতে দেশটিতে কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায়।

বায়রার যুগ্ম মহাসচিব মো. ফখরুল ইসলাম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী প্রেরণে অভিবাসন ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এফডব্লিউসিএমএস-এর সিস্টেমে সিন্ডিকেট চক্রের পকেটেই বিনা কারণে ১ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা চলে যাচ্ছে। এতে দেশটিতে অভিবাসন ব্যয় চার লক্ষ টাকার ওপরে চলে যাচ্ছে। অথচ সরকার দেশটির অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করেছিল ৭৯ হাজার ৯৯০ টাকা। আর মালয়েশিয়ার তৎকালীন মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান ঢাকায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, শূন্য অভিবাসন ব্যয়ে দেশটিতে কর্মী যাবে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সিøপ তুলতেই মায়োগ্রাম ২৬শ’ টাকা নিয়ে যাচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী এসব টাকা নিয়োগকর্তার দেয়ার কথা ছিল। এক প্রশ্নের জবাবে বায়রা নেতা বলেন, এ যাবৎ ৬ লক্ষাধিক কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। কয়েক লক্ষ কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এতে অভিবাসন ব্যয় দিন দিন আশাকচুম্বী হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

বিএমইটির সূত্র জানায়, বৈশ্বিক করোনার পর সউদীসহ বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানি বাড়ছে। ২০২১ সালে বিভিন্ন দেশে কর্মী গেছে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন। ২০২২ সালে বিভিন্ন দেশে ১১ লক্ষ ৩৫ হাজার ৯৮৬ জন নারী-পুরুষ কর্মী চাকরি লাভ করেছে। গত ১ ডিসেম্বর থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সউদীতে চাকরি লাভ করেছে ৩২ হাজার ৬৫১ জন এবং একই সময়ে মালয়েশিয়ায় চাকরি লাভ করেছে ২০ হাজার ৪৫১ জন। কুয়ালালামপুর থেকে গতকাল শনিবার শিউর ওভারসীজ রিক্রুটের পার্টনার মো. দেলাওয়ার হোসেন ইনকিলাবকে জানান, মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন সেক্টরে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে সফরে গিয়েছেন কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজীকরণের লক্ষ্যে। এফডব্লিউসিএমএস-এর জটিল প্রক্রিয়া নিরসন করে সিন্ডিকেট প্রথা ভেঙ্গে দিয়ে সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিই এখন থেকে দেশটিতে স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে কর্মী পাঠাতে পারবে । এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বাংলাদেশে গিয়েছেন বলেও তিনি দাবি করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ধীরগতির দরুণ অনেক নিয়োগকর্তা বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়ে অনীহা প্রকাশ করছেন। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় প্রায় ১শ’ প্রাইভেট রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যেতে কর্মীকে ধার-দেনা করে দিতে হচ্ছে চার লক্ষাধিক টাকা। অপরদিকে সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি বোয়েসেল-এর মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যেতে কর্মীকে খরচ করতে হচ্ছে না।

কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সূত্র জানায়, বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের লক্ষ্যে জমা পড়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার চাহিদা পত্রের আবেদন। এসব চাহিদার মধ্যে উপযুক্ত বিবেচনায় ১ লাখ ৫০ হাজার জনের ছাড়পত্র দেয় হাইকশিন। মালয়েশিয়া থেকে গতকাল আওয়ামী লীগ নেতা অহিদুর রহমান ইনকিলাবকে জানান, বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণে ধীরগতির মূল কারণ হচ্ছে বায়রার সাবেক নেতা স্বপন সাহেবের এমইএফসি। নেপাল থেকে বিনা বাধায় দেশটিতে কর্মী যাচ্ছে মালয়েশিয়ায়। আর বাংলাদেশ থেকে টোলমানির কারণে কর্মীদের অভিবাসন ব্যয়ের টাকা যোগাতে নাভিশ্বাস উঠছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/553360