৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ১১:২১

ভোটারের উপস্থিতি গুরুত্ব পায়নি ‘নির্বাচনী মহড়া’ দিয়েই তৃপ্তি!

দেশের নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনীহা কি স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে? ভোটের প্রতি আগ্রহ কি বিদায় নিচ্ছে? ‘নির্বাচিত’ বলে ঘোষিত ব্যক্তিরা কি অতি সামান্য ভোট নিয়েই জনগণের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করে যাবেন?

এসব প্রশ্ন উঠছে নির্বাচনসমূহে ভোটারের উপস্থিতি এবং নির্বাচিতদের প্রাপ্ত ভোটের হিসাব দেখে। কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়- স্থানীয় নির্বাচনের দৃশ্যপটও একইরকম দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতির হার সংশ্লিষ্টদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। যেনতেন প্রকারে ভোটের মহড়া দেয়াই যেন নির্বাচনী কৌশল হয়ে পড়েছে। অল্প ভোটেই নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি একেবারে বিনা ভোটে তথা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। বিগত কয়েকটি নির্বাচনের ভোট সম্পর্কে তথ্য যাচাই করতে গিয়ে এই হতাশাজনক চিত্র লক্ষ্য করা যায়। নমুনাস্বরূপ কিছু বিবরণ এখানে তুলে ধরা হলো।

সাড়ে ২২ লাখের মধ্যে ৬ এমপি’র ভাগের ভোট মাত্র সাড়ে ৩ লাখ! : গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, বর্তমান জাতীয় সংসদ থেকে বিএনপির সাত সংসদ সদস্য পদত্যাগ করায় গত ১ ফেব্রুয়ারি ৬টি আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ আসনগুলোর মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ২২ লাখ ৫৪ হাজার ২১৭ জন। এতে বিজয়ী প্রার্থীরা ভোট পেয়েছেন মাত্র তিন লাখ ৫৩ হাজার ৫৭০। ১৯ লাখ ৬৪৭ জন ভোট দেয়া থেকে দূরে ছিলেন। এতো কম সংখ্যক ভোট পড়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে বিশিষ্টজনরা বলছেন, নাগরিকরা ভোট দিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন।

বগুড়া-৪ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৮ হাজার ৪৬৯ জন। এই মোট ভোটারের মধ্যে মহাজোটের প্রার্থী জাসদের এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন পান ২০ হাজার ৪০৫ ভোট। প্রাপ্ত ভোটের হার ৬.২১%। বগুড়া-৬ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২৫৪। এর মধ্যে আ’লীগের রাগেবুল আহসান ৪৯ হাজার ৩৩৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। প্রাপ্ত ভোটের হার ১২.৭৪%। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৫ হাজার ৪৫০।

এরমধ্যে আ’লীগের মু. জিয়াউর রহমান ৯৪ হাজার ৯২৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। প্রাপ্ত ভোটের হার ২৩.৪১%। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ১১ হাজার ৪৯৫। আ’লীগের প্রার্থী আব্দুল ওদুদ ৫৯ হাজার ৯৩৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। প্রাপ্ত ভোটের হার ১৪.৫৬%। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩১৯। সরকারি দল সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া ৪৪ হাজার ৯১৬ ভোটে নির্বাচিত হন। প্রাপ্ত ভোটের হার ১২%। ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৪ হাজার ৭৪১ জন। এখানে সরকারের শরিক জাপার হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ ৮৪ হাজার ৪৭ ভোটে নির্বাচিত হন। প্রাপ্ত ভোটের হার ২৫.৮৮%। এই ৬টি আসনের নির্বাচনে মোট ভোটার যেখানে ২২ লাখ ৫৪ হাজার ২১৭ জন, সেখানে প্রার্থীরা বিজয়ী হলেন মাত্র ৩ লাখ ৫৩ লাখ ৫৭০ ভোটে। অর্থাৎ ভোট পেলেন গড়ে ১৫.৬৮% হারে।

এবিষয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ভাষ্য, তারা ভোটের হার কম হওয়ায় চিন্তিত হলেও মাঠের পরিস্থিতি শান্ত রাখতে তারা সক্ষম হয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি’র ভাষ্য, ভোট প্রদানের হার ইসি’র হিসাব অনুযায়ী ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বলা হলেও তাদের হিসাব মতে, এটা ৫ শতাংশের বেশি না। পত্র-পত্রিকায় ছবিগুলো দেখলে বুঝতে পারবেন একেবারে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো। ভোট কেন্দ্রে কুকুর শুয়ে আছে। আ’লীগ নির্বাচন ব্যবস্থাকে এই পর্যায়ে নিয়েছে। গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানকে তারা ধ্বংস করে ফেলেছে।
স্থানীয় সরকারেও একই দশা : দিনে দিনে নির্বাচন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ভোট প্রদানে ভোটারদের মধ্যে অনীহা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ জনমত হুমকিতে পড়ে গেছে। এবিষয়ে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বলতে যা বুঝায় দিনে দিনে তা কেবল খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করেই খুশি থাকছে নির্বাচন কমিশন-ইসি। প্রকৃতপক্ষে ভোটসংখ্যার বিচারে খুবই নগণ্য সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করছেন নির্বাচিতরা। বিশেষত দেশের তিনটি বৃহৎ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী বলে ঘোষিত মেয়ররা মোট ভোটারের মাত্র ১৫ থেকে ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করছেন বলে বিশ্লেষণে দেখা যায়। ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর এবং চট্টগ্রাম- এই তিন সিটির ভোট বিশ্লেষণ করে এই চিত্র উঠে আসে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন : ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেখা যায়, আনুমানিক ৬০ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই সিটিতে সর্বমোট ভোটার সংখ্যা ১৯ লাখ ৩৮ হাজার। ভোট পড়ে মাত্র ৪ লাখ ৩৬ হাজার। আর বিজয়ী ঘোষিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ভোট পান ৩ লাখ ৬৯ হাজার। অর্থাৎ মোট ভোটারের শতকরা ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব হাসিল করেছেন তিনি। এই সিটির ভোট নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক সমালোচনা উঠলেও এতে আমল দেয়া হয়নি যথারীতি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি : এর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। ৯০ লক্ষাধিক জনসংখ্যার এই নগরীতে মোট ভোটার ২৪ লাখ ৫৩ হাজার। এখানে নির্বাচনে ভোট পড়ে মাত্র ৭ লাখ ১১ হাজার। শতকরা হিসাবে ভোট পড়ে ২৯ শতাংশ। আর বিজয়ী নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৪ লক্ষ ২৪ হাজার। মোট ভোটার সংখ্যার হিসাবে এই ভোট প্রাপ্তির শতকরা হার মাত্র ১৭.২৮ ভাগ। বিজয়ী মেয়র এই সংখ্যক ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করছেন বলে দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি : ঢাকা উত্তর সিটিতে একই দিন অর্থাৎ ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৬০ লক্ষাধিক জনসংখ্যার এই সিটিতে মোট ভোটার ৩০ লাখ ১০ হাজার। ভোট পড়ে মাত্র ৭ লাখ ৬২ হাজার। শতকরা হিসাবে এই হার ২৫ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর বিজয়ী নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ৪ লাখ ৪৭ হাজার। মোট ভোটার সংখ্যার হিসাবে এই ভোট প্রাপ্তির শতকরা হার মাত্র ১৪.৮৫ ভাগ। বিজয়ী মেয়র এই সংখ্যক ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করছেন বলে দেখা যায়।

২০১৩ বনাম ২০১৫ সালের চিত্র : এর আগে ২০১৩ সালের পাঁচ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে সকল দল অংশগ্রহণ করে। সেই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার ছিল রাজশাহীতে ৭৬.০৯%, খুলনা ৬৯.৭৯%, সিলেট ৬২.৭৮%, বরিশাল ৭৩.৫৮% এবং গাজীপুরে ৬৩.৬৯%। এর সবক’টিতেই বিজয়ী হন ২০ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থীগণ। এরপর শুরু হয় নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের ধারা। তারই প্রভাবে ২৮ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইসি’র দাবি অনুযায়ী ঢাকা উত্তরে ভোট পড়ে ৩৭.৩০%, ঢাকা দক্ষিণে ৪৮.৪০% এবং চট্টগ্রামে ভোট পড়ে ৪৭.৯০%। এই তিন সিটির নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, অনিয়ম ও সরকারি পক্ষের দখলদারির প্রতিবাদে ভোট গ্রহণের মাঝখানে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন ২০ দলের সমর্থিত প্রার্থীরা। ঢাকা উত্তরে মোট ভোটার ছিল ২৩ লাখ ৪৪ হাজার ৯শ জন। এর মধ্যে ভোট কাস্ট হয় ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৮টি। যা মোট ভোটের ৩৭.৩০ শতাংশ। এ নির্বাচনে বৈধ ভোটের সংখ্যা ৮ লাখ ৪১ হাজার। বাতিল হয় ৩৩ হাজার ৫৮১টি ভোট। এই সিটিতে আ’লীগ প্রার্থী পান ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট। মোট ভোটের মাত্র ২০% পেয়ে তিনি নির্বাচিত হন। ঢাকা দক্ষিণে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৭৮ জন। ভোট কাস্ট হয় ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৮৪ জন। যা মোট ভোটের ৪৮.৪০%। এ নির্বাচনে বৈধ ভোটের সংখ্যা ৮ লাখ ৬৫ হাজার ৩৫৪টি। এছাড়া বাতিল হয় ৪০ হাজার ১৩০টি ভোট। এই সিটিতে আ’লীগ প্রার্থী পান ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট। মোট ভোটের মাত্র ২৮.৫৯% পেয়ে তিনি নির্বাচিত হন। চট্টগ্রাম সিটিতে মোট ভোটার ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৬০০জন। ভোট কাস্ট হয় ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৩। যা মোট ভোটের ৪৭.৯০%। এ নির্বাচনে বৈধ ভোটের সংখ্যা ৮ লাখ ২১ হাজার ৩৭১টি। এছাড়া বাতিল হয় ৪৭ হাজার ২৯২টি ভোট। এই সিটিতে আ’লীগ প্রার্থী পান ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট। যা মোট ভোটের ২৬.২০% মাত্র। ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল ও কারচুপির অভিযোগ এনে তিন সিটি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। একই অভিযোগ তোলেন বাম দলগুলোর প্রার্থীরাও।

বিনা ভোটে বিজয়ী হওয়ার প্রবণতা : ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের সবচেয়ে দুর্বল দিক ছিল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া। বলা হয়ে থাকে যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া কোনো অবৈধ বিষয় নয়। এর সংখ্যা বা মাত্রা সম্পর্কেও আইনে কিছু বলা নেই। তাই এটি প্রশ্নাতীত বিষয়। কিন্তু যখন জাতীয় সংসদে একটি সরকার গঠনের মতো সদস্যগণ একেবারে বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে যান তখন সেটির নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন না উঠে পারে না বলে বিশ্লেষকরা অভিমত দেন। দেশের উচ্চ আদালতও এবিষয়ে কোনো নির্দেশনা বা পর্যবেক্ষণ দেননি। বরং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত ঘোষণা সংক্রান্ত রিট ও এ বিষয়ে জারি করা রুল খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। এ রিট খারিজের মাধ্যমে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা পরোক্ষভাবে বৈধতা পেলেন বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ হাইকোর্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একক প্রার্থী নির্বাচিত করার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১৯ ধারা কেন সংবিধান-পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতরা কেন অবৈধ নয় মর্মে হাইকোর্টের দেয়া রুলের ওপর অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ছয়জন তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, বদিউল আলম মজুমদার এ নির্বাচনকে অসাংবিধানিক ও বেআইনি বলে তাদের মতামত পেশ করেন। অপরদিকে আজমালুল হোসেন কিউসি ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও মাহমুদুল ইসলাম নির্বাচনকে আইনগতভাবে সঠিক বলে উল্লেখ করেন। তবে এ নির্বাচন নীতিগতভাবে বৈধ ছিল না বলে আদালতে বাখ্যা দেন মাহমুদুল ইসলাম।

স্থানীয় নির্বাচনেও একই প্রবণতা : ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বাড়তে দেখা যায়। এটি এমন নয় যে, সেসব ইউনিয়নে আর কোনো যোগ্য প্রার্থী ছিল না। সরকারি দলের প্রার্থীদের দাপট ও প্রকাশ্য অথবা পরোক্ষ হুমকি এবং নিজের পক্ষের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারার ‘সাহস’ হারিয়ে ফেলাই এর মূল কারণ বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

২১ সেপ্টেম্বর দেশের ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) হওয়া নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়ার একটি জ¦লন্ত উদাহরণ। নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৬০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৫টিতে চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, যার অর্থ প্রায় ২৯ শতাংশ চেয়ারম্যান কোনো ধরনের ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া ছাড়াই নির্বাচিত হন। ৪৫ জনের মধ্যে ৩৮ জনই বাগেরহাটের প্রার্থী। তাদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই ক্ষমতাসীন আ’লীগের প্রার্থী। প্রথম পর্যায়ে ২১ জুন ২০৪ টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ হয়। তখনও একই চিত্র দেখা যায়। তখন ২৮ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। এছাড়াও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতিও কমেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ বিশ্বাস করছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিজয় অনিবার্য। ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ অনুষ্ঠিত সিলেট-৩ আসনের উপ-নির্বাচনে মাত্র ৩৪ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি দেখা যায়। ২০২০ সালের ২১ মার্চে অনুষ্ঠিত ঢাকা-১০ উপ-নির্বাচনের চিত্র আরো করুণ ছিল, কারণ ওই নির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি দেখা গেছে। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে ৪৫৬টি উপজেলায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৯৪ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তাদের মধ্যে ৯৩ জনই আওয়ামী লীগ সমর্থিত।

নিয়ম রক্ষাতেই খুশি ইসি! : নগর পর্যায়ের এসব নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকগণ খুশি হলেও প্রকৃত পরিস্থিতি হলো, সামগ্রিকভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা যেমন হ্রাস পেয়ে চলেছে তেমনই নির্বাচিতদেরও এতো স্বল্পসংখ্যক ভোটারের সমর্থন নিয়েই কৃত্রিম তৃপ্তির মধ্যে থাকতে হচ্ছে। একে একধরনের বিপর্যয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, নানা কারণে সামগ্রিকভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি ভোটারদের অনেকের আস্থা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। জনসাধারণ ধরে নিয়েছেন, ‘ভোট দিয়েও এর প্রতিফলন ফলাফলে মিলবে না। তাই ভোট দেয়া আর না দেয়া সমান।’ মানুষ মনে করেছে, ভোট দিলেও যিনি জিতবেন, না দিলেও তিনি জিতবেন। অর্থাৎ ভোটে কোনো পরিবর্তন হবে না। তবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের এনিয়ে কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয়নি। চট্টগ্রামের নির্বাচন শেষে ভোটের হার কম হওয়াকে একজন নির্বাচনী কর্মকর্তা এভাবে বাখ্যা করেছেন, ‘দেশ উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটের প্রতি মানুষের অনীহা বাড়ছে।’ এতে দেখা যায়, কোনো ‘অংশগ্রহণমূলক’ ও ‘সর্বজনীন’ নির্বাচন নয়- যে কোনোপ্রকারে দায়িত্বসম্পন্ন করার মধ্যেই নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব সীমিত রাখার পক্ষপাতী। এবিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক একটি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, এই পরিস্থিতির সমাধান করা কঠিন। কারণ, কোনো দলীয় সরকারের নির্বাচনে মানুষের আস্থা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এ জন্য একটি নির্দলীয় ব্যবস্থার অধীন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে মানুষ আর ভোটের প্রতি উৎসাহ দেখাবে না।

https://dailysangram.com/post/515763